আগের দিন রাতের খাবারের সময়ই বার বার মনে করিয়ে দেয়া হয়েছিল সকাল ৮.৩০ শে আমাদের রওনা হতে হবে। সবাইকে হোটেল লবি তে ৮.২০ এর মধ্যে তৈরী হয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। আমাদের গন্তব্য ইলি-আলাতু ন্যাশনাল পার্ক, কাজাখস্তানে অনেক গুলো ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে, ইলি-আলাতু ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে অন্যতম আর এই পার্কটি আলমাতি শহরের সবচেয়ে কাছে।
কাল রাত থেকেই আলমাতি শহরে বেশ তুষার ঝরছে। পার্কটি শহরের কাছে হলেও পাহাড়ের ঢালে তাতে আমাদের বেশ কিছুটা উপরে উঠতে হবে। তাপমাত্রা মাইনাস ১০-১২ হতে পারে বলে আমাদেরকে পোষাক পরিচ্ছদে ঐভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে বলা হয়েছে। এই বঙ্গ সন্তান যদিও বরফের রোমান্টিসিজমে ভুগছে তবে শীতে খুবই কাবু। যার মাইনাস তো দূরের কথা মার্চ-এপ্রিল মাসের কাঠমন্ডু আর দার্জিলিং এর তাপমাত্রা তার জীবনের সর্ব নিম্ন তাপমাত্রার অভিজ্ঞতা। কি কি পড়ব আর কি না পরবো এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে সাথের সুটকেস উল্টিয়ে শীতের কাপড় যা ছিল সব পড়ে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে নিচে নামি।
পার্কের অফিসের বিভিন্ন গ্যালারী আর ব্রিফিং চলছে
ভারতীয়, নেপালী, ভূটানি, মালদ্বীভিয়ান, উজবেক, আজারবাইজান, কাজাখ আর আমি বাংলাদেশী মিলে এক বহুজাতিক দল। প্রাতঃরাশ করে আমরা নির্ধারিত বাসে উঠি প্রথমে আমাদের গন্তব্য ন্যাশনাল পার্কের অফিস। ওখানে আমাদের পার্ক সম্পর্কে আমাদের ব্রিফ দেয়া হবে। পার্কের অফিস দেখে তো আমি বেশ টাস্কিত হলাম। একটা ন্যাশনাল পার্কের অফিস যে এত বৈচিত্র্যময় হতে পারে না দেখলে বুঝতাম না।
রাস্তা-ঘাট সবই বরফে ঢাকা
ত্রিমাত্রিক মানচিত্র দিয়ে শুরু হল, এর পরে বিভিন্ন গ্যালারী, উদ্ভিদ গ্যালারী, প্রানী গ্যালারী, স্কুলের বাচ্চাদের জন্য গ্যালারী, তথ্যচিত্র দেখানোর জন্য মুভি থিয়েটার, বিভিন্ন মডেল ইত্যাদি। সবগুলো গ্যালারীই ঘুড়ে ঘুড়ে দেখলাম, পার্ক করত্বিপক্ষ আমাদেরকে এই সকল বিষয়ে ব্যাখ্যা দিল। পার্ক অফিস পরিদর্শন শেষে আমরা আবার বাসে উঠে পার্কের দিকে রওনা হলাম।
এর মধ্যেও পর্যটকদের বিরাম নেই
কাজাখস্থান সরকার ১৯৯৬ সালে ‘জাইলিস্কি আলাতু (Zailiyskiy Alatau)’ পাহাড়ের উত্তর পার্শ্বে প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর এলাকার প্রকৃতি সংরক্ষনের উদ্দেশ্যে ইলি-আলাতু ন্যাশনাল ন্যাচারাল পার্ক ঘোষনা করে। জাইলিস্কি আলাতু (Zailiyskiy Alatau) অর্থ ‘উঁচু পাহাড়’ আসলে এই ন্যাশনাল পার্কটি আলাতু পাহাড়ের উত্তর পাদদেশে অবস্থিত। আলমাতি শহর থেকে এই পার্ক মাত্র ৩০ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত। এতো বড় শহরের পার্শ্বে এতো সুন্দর সংরক্ষিত প্রাকৃতিক উদ্যান মনে হয় খুবই কম আছে। এই পার্কটি পূর্ব-পশ্চিমে ১২০ কিলোমিটার আর উত্তর দক্ষিনে ৩০ কিলোমিটার। সমুদ্র সমতল থেকে এই পার্কটি ৬০০ থেকে ৫০০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে।
সাদা কালোয় জীবন !!!
জীব বৈচিত্র্যের দিক থেকে এই পার্কটি খুবই সমৃদ্ধ। নর্থ আলপাইন গোত্রের ১২০০ প্রজাতির উদ্ভিজ আর বন্যপ্রানীর মধ্যে ১৫০০ প্রজাতীর অমেরুদন্ডী, ২১৩ প্রজাতির মেরুদন্ডী, ৪৭ প্রতাতীর স্তন্যপ্রায়ী আর ১৪৮ প্রজাতীর পাখি আর ৮ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে।
বৃক্ষরাজিঃ তুষার রূপ দিয়েছে এই অদ্ভুত চিত্রের
ইলি-আলাতু ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে সুন্দর সময় মে থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত, তখন এই পার্কের প্রকৃতি থাকে ঝকঝকে, বরফে ঢাকা সুউচ্চ পাহাড় চুড়াগুলো দেখা যায়। হাইকিং এর ট্রেইল গুলো খুব সন্দর থাকে। শহর ছাড়িয়ে ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই আমাদের বাস পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো, কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের অবাক করে দিয়ে চার পাশের দৃশ্য বদলাতে শুরু করলো আমরা যেন এক বরফের রাজ্যে প্রবেশ করলাম।
চড়ে বেরাচ্ছে বন্য ঘোড়া
গেষ্ট হাউজ না বাড়ী, ঢেকে আছে বরফে
অসুস্থ ও আহত ঈগল দের পরিচর্যা কেন্দ্র
অবশেষে দুপুরে খাবারের জন্য রেষ্টুরেন্টও পাওয়া গেল
চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা। পুরু বরফের স্তর পড়ে আছে চারদিকে, গাছ-পালা রাস্তা সবই বরফে ঢাকা। পুরোপুরি শীত তখনো শুরু হয়নি তাতেই এই অবস্থা। ফ্যাকাশে কালো আর তুষার সাদা ছাড়া চার পাশে আর সকল রঙ এর অনুপস্থিতে। তুষার যে প্রকৃতিকে এতোও ম্রিয়মান করে ফেলে আগে জানা ছিলনা।
=======================
ছবিঃ মানস চোখ
ক্যামেরাঃ ক্যানন ১১০০ ডি
লেন্সঃ ১২৮ মি। মি।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:২৯