চীন নিয়ে লেখা আগের পোষ্টগুলিঃ
২. "বিগ স্টোন ভিলেজ" জ্বালানী সাশ্রয়ী গ্রামঃ যেখানে পরিবেশ সচেতনতা পর্যটনকে প্রমোট করেছে
১. চংকিং (Chongqing): চীনা কসমোপলিটন শহরঃ আমার ভ্রমণ বিড়ম্বনা (!)
বসন্তের এই বিদায় বেলাতেও চীন দেশের আবহাওয়ার তাপমান পরিমাপক যন্ত্রের পারদ পুরোপুরি উপড়ে উঠে নাই। দিনের বেলাতেও মাঝারিমানের জ্যাকেটেও যেন শীত মানতে চায় না আর রাতে তো কথাই নেই আমাদের পৌষ মাস পার করে দেয়। সেই সংগে বৃষ্টির কারনে কুয়াশা মেশানো মেঘলা অবয়ব ঠান্ডাটাকে যেন আরোও বাড়িয়ে দিয়েছিল। চংকিং (Chongqing) শহরে দুই রাত্রী কাটিয়ে শি’আন এ এসে হঠাৎ ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল আর ফুরফুরে বাতাস মেশানো আবহাওয়া আমাদের চাঙ্গা করে তোলে। বাতাসের বিশেষ ঘ্রান আর এই ফুলেল শহর আমাদেরকে সদ্য ফোটা লাল সাদা ঝাঁকড়া চেরী ফুল দিয়ে স্বাগত জানায়।
শি'আন এয়ারপোর্ট এর বাহিরভাগ
এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে
শি’আন (Xi’an) উত্তরপূর্ব চীনের শানঝি (Shaanxi) প্রদেশে অবস্থিত প্রাদেশিক রাজধানী শহর। প্রাচীন চীনের যে চারটি রাজধানী ছিল তার মধ্যে শি’আন একটি। খৃষ্টপূর্ব ১০৪৬ সালে পশ্চিম জু সম্রাজ্য থেকে শুরু করে ৯০৪ খৃষ্টাব্দে তাং সম্রাজ্যের আমল পর্যন্ত শিয়ান সর্বমোট ১২ টি সাম্রাজ্যের শাসন আমলে প্রাচীন চীনের রাজধানী ছিল।
বহুতল আবাসিক ভবন
শি’আন শহর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল তাং রাজ বংশের আমলে বিশেষ করে ৭১২ থেকে ৭৬৫ খৃষ্টাব্দে, তখনকার সমসাময়িক সময়ে এই কসমোপলিটন শহরে প্রায় দুই মিলিয়ন অধিবাসী বসবাস করত আর তারা সেই সময়েই নিয়মিত পৌরকর পরিশোধ করত। এথেন্স, কায়রো আর রোমের সাথে সাথে শি’আনও প্রচীন সভ্যতার একটি ধারক শহর। প্রাচীন কালে চীন থেকে মধ্য এশিয়ার যোগাযোগের রাস্তা ‘সিল্ক রুটের” চীনের অংশের শুরু হয়েছিল শি’আন থেকে।
শহর পরিভ্রমণের সময়ের এলোমেলো ক্লিক
বর্তমানে শি’আন এর জনসংখ্যা ৮.৫৫ মিলিয়ন এর মধ্যে ৯৯ ভাগই হান গোত্রের আর বাকি ১ ভাগ অন্যান্য সংখ্যালঘু গোত্রের। ধর্মের দিক থেকে বেশীর ভাগই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি এ ছাড়া খৃষ্টানও রয়েছে। শি’আন শহরে প্রায় ৫০,০০০ হুই গোত্রের মুসলিম ধর্মের অনুসারীদের বাস।
প্রাচীন নিদর্শন, স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ শি’আন, এই সকল নিদর্শন দেখতে প্রতিবছরে অনেক সংখ্যক পর্যটক শি’আন ভ্রমন করে।মূল শহর ঘিরে মিং আর চিং সাম্রাজ্যের আমলে প্রাচীর (City Wall)তৈরি করা হয়, যা এখনো টিকে আছে আর এই প্রাচীর এখন “UNESCO World Heritage” হিসেবে এখন সংরক্ষিত। এ ছাড়া শহর থেকে একটু দূরে চিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা “চিং শাই হোং (Qin Shi Huang) এর সমাধিতে টেরাকোটা আর্মি (Terracotta Army)একটি অত্যন্ত সুপরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সম্রাটের সমাধিতে টেরাকোটায় নির্মিত অসংখ্য সেনা মূর্তি অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ছিল। ১৯৭৪ সালে এক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কালে এগুলো আবিস্কৃত হয়। এ ছাড়া শি’আন শহরে মোটামুটি কেন্দ্রস্থলে রয়েছে “জায়েন্ট ওয়াইল্ড গোল্ডেন গুজ প্যাগোডা (Giant Wild Goose Pagoda)” নামে বৌদ্ধ ধর্মীয় উপাসনালয়।
যাই হোক, শি’আন এ অনেক দর্শনীয় স্থান আর বিষয় থাকলেও আমাদের দাপ্তরিক কাজের কর্মসূচীর কারণে আমরা খুব কম সময়ই পেয়েছি এই শহরে ঘোরাঘুরি করতে। শেষ দুপুরে শি’আন বিমানবন্দরে নেমে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী “Big Stone Village” এ যাই, এই নিয়ে আগে একটি পোষ্ট দিয়েছিলাম। এখান থেকে বের হতে হতে বিকেল, আর লেট লাঞ্চ সারতে সারতে পুরোপুরি সন্ধ্যা। শেষমেশ আর কি করা নির্ধারিত হোটেলের দিকে রওনা। হোটেলে পৌঁছে চেক ইন করতে করতে আরো এক ঘণ্টা শেষমেশ টিম-মেট দের সাথে যখন ডিনার করতে বের হলাম তখন শহর মোটামুটি ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সঙ্গের চীনা সহকর্মী আমাদের কে গাইড করে শহরের কেন্দ্রস্থলে এক ম্যা্কডোনাল্ডের আউটলেটে নিয়ে যায় সেখানে আমারা সবাই ডিনার সারি। ইতিমধ্যে শহর মোটামুটি ফাঁকা, এতোও বড় শহর যে রাত ১০ টাতেই ফাঁকা হয়ে যায় তা আমাদের আগে জানা ছিল না। বেশ কিছু স্ট্রিট ফুড কোর্ট খোলা আর অনেকেই রাতের খাবার সারছে। শি’আনের সুপরিসর রাজপথের ফুটপাথ দিয়ে আমরা গল্প করতে করতে হোটেলে ফিরে আসি। যদিও পরদিন সকাল আটটাতে আমাদের নির্ধারিত মিটিং ছিল কিন্তু মোটামুটি ভোররাত পর্যন্ত আমরা আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেই।
লেট লাঞ্চের টেবিল
ডিনার সারা হল ম্যাকডোনাল্ডে
স্ট্রিট ফুডের আউটলেটগুলো তখনোও খোলা
পরদিন সকাল এ মিটিং শেষ করতে করতে ১১.৩০ বেজে যায় এরপরে আবার পরবর্তী কর্মসূচী বিকেল ৪ টাতে এটা শেষ করে আমারা সন্ধ্যা ৭.৩০ ফ্লাইট ধরে বেইজিং যাব। ১১.৩০ থেকে বিকেল ৪.০০ এই মধ্যবর্তী সময় আমারা সম্পূর্ণ ফ্রি, সবাই এই সময়টা কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। একদল চাচ্ছিল আমরা শি’আন এর বিখ্যাত ‘টেরাকোটা আর্মি’ দেখে আসি আবার আরেক দল চাচ্ছিল আমরা শহরেই থেকে “সিটি ওয়াল” আর “জায়েন্ট গোল্ডেন গুজ” প্যাগোডা দেখি। যাক শেষ পর্যন্ত আমাদের চীনা গাইড সময়ের স্বল্পতার কারনে আমাদের কে শহরের মধ্যেই থাকতে বলল।
পরিস্ফুটিত লাল চেরি ফুল
আমরা আমাদের বরাদ্দকৃত বাস নিয়েই চটজলদি শহর পরিভ্রমণ করি। শি’আন অনেক বড় আর প্রাচীন শহর হলেও অসাধারণ এক সুন্দর শহর। পুরানো শহরের উপরে বেশ কিছু পালিশ পরেছে এর প্লান-পরিকল্পনা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। এতো বড় শহর যে এতো নিরিবিলি হয় এই অভিজ্ঞতাও আমার প্রথম হল। শত কোটি মানুশের দেশে রাস্তায় মানুষের ভীড়ে হাটা যাবে না, কল্পনায় চীনের বড় শহর গুলোকে এই রকম দেখেছিলাম। কিন্তু শি’আন এর সাথে এই কল্পনার বিভেদ পেয়েছি হাজারো মাইলের। সুপরিসর সব রাজপথ তারসাথে মাননসই ফুটপাথ আর সাইকেল লেন, দুই পাশে ফুটন্ত লাল চেরীফুল আর অন্যান্য ফুল যেন হাসছে। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে ফুটপাথের পাশে সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চে জিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা আর অনেক বয়স্ক মানুষ জন সেখানে বসে আছে। অসাধারন সুন্দর ব্যবস্থা। শহরের রাস্তায় হাটতে গেলেই যেন মন ভালো হয়ে যায়।
ফুলে ছাওয়া সুপরিসর রাজপথ
অসাধারণ ফুটপাথ আর সাইকেল লেন
পরিভ্রমণ শেষে আমারা এক মুসলিম রেস্তরাঁতে দুপুরের খাবার খেতে ঢুকি। সাদর আহ্বান আর সুন্দর পরিবেশন আমাদের ক্ষুধাকে বেশ জাগিয়ে তোলে তবে সবাই খাবার কোনমতে সেরে আবার “জায়েন্ট ওয়াইল্ড গোল্ডেন গুজ” প্যাগোডায় যেতে ইচ্ছুক। মোটামুটি লাঞ্চ সেরে সবাই প্যাগোডার দিকে দ্রৌড় দেই।
জায়ান্ট ওল্ড গোল্ডেন গুজ প্যাগোডা
“জায়ান্ট ওয়াইল্ড গোল্ডেন গুজ প্যাগোডা (Giant Wild Goose Pagoda)” শিয়ান শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তাং সাম্রাজ্যের সম্রাট গংজং এর আমলে (৬৪৯-৬৮৩ খৃঃ) এই প্যাগোডা নির্মাণ করা হয়। শুরুতে এটি ১৭৭ ফিট হলেও সম্রাজ্ঞী উ জিনতিয়াং ৭০৪ খৃষ্টাব্দে এইটি আরো উঁচু করে নির্মাণ করেন। এর পড়ে ১৫৫৬ সালে এক প্রচন্ড ভূমিকম্পে এটি ধসে গেলে পড়ে একে তিনতলে বিশিষ্ট করে পূনঃনির্মাণ করা হয়ে। তবে বর্তমানে এই প্যাগোডা্র মূল ভবন সাত তলা বিশিষ্ট আর প্রাচীন পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত। মূল প্যাগোডা ঘিড়ে চার দিকে এক নান্দনিক উদ্যান এই শহরের পৌর কতৃপক্ষ তৈরি করেছে।
প্যাগোডা ঘিড়ে নান্দনিক বাগান
চীনা ঘুড়ি
ডাষ্টবিন তবে বোঝা মুশকিল
প্যাগোডার বাগানে বিভিন্ন নান্দনিক শিল্প কর্ম
এই প্যাগোডায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে আমাদের বরাদ্দকৃত সময় শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারি নাই। আমাদের চীনা গাইড আমাদেরকে বাসে উঠার তারা দেয় আর পরবর্তী কর্মসূচীর কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা কিছুটা ভগ্নমনোরথে “শিআনের শহর প্রাচীর” আর “টেরাকোটা আর্মি” না দেখার আফসোস নিয়ে পরবর্তী নিঃরস (!!!!) মিটিং এর দিকে রওয়ানা হই। তবে এই অসাধারণ নান্দনিক শহরে স্বল্প সময়ের এই ঝটিকা অবস্থানের সূখস্মৃতি আমাকে যে মাঝে মাঝেই নস্টালজিক করবে তা তখনই বুঝেতে পেরেছিলাম!!
++++++++++++++
ছবিঃ মানস চোখ
ক্যামেরাঃ ক্যানন ১১০০
লেন্সঃ ৫৫-১২৮ মি। মি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ২:২৭