চলুন ঘু্রে আসি সিরাজগঞ্জ থেকে!! জ্বী!!! উত্তরবঙ্গের প্রবেশ দ্বার!
যমুনা সেতু থেকে নেমেই রাস্তার দুইপাশে মোটামুটি ঘন বন চোখে পরবে, সবুজে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে, দুই দিকে শান্ত প্রকৃতি আপনার মনে এক ধরনের স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেবে। আপনি যদি এসি গাড়ী তে থাকেন নামিয়ে দিননা গাড়ীর আরশিটা দেখবেন বাতাস টাও যেন অন্যরকম! সেতু থেকে নামার সাথে সাথেই আপনি ঢুকে পড়লেন সিরাজগঞ্জ জেলায় তথা উত্তরবঙ্গে। এগিয়ে যান আরো ৫/৬ মিনিট, মহাসড়কে কড্ডা নামের যায়গা থেকে ডানদিকের অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তায় ১৫ মিনিট গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন সিরাজগঞ্জ শহরে। উত্তরবঙ্গের আর দশটা জেলা শহরের মতই শান্ত ছিমছাম শহর সিরাজগঞ্জ। কিন্তু এর পরেরও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, এই ছিমছাম ছোট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রমত্ত ‘যমুনা’ যা শহরকে করেছে অপরূপ (যদিও মাঝে মাঝে শহরকে বেশ বিপদেও ফেলে) !!!!
সিরাজগঞ্জ শহর ও আশেপাশে দেখার রয়েছে অনেক কিছুই, অনেকের কাছে হয়ত মনে হবে এত গড়পড়তা মফস্বল শহর এখানে আর কি দেখব...? জ্বী!!! প্রকৃতপক্ষে যারা দেখতে ভালোবাসেন তার অনেক কিছুই দেখবেন !! ওইযে সেই ‘ধানের পাতার উপড়ের শিশির বিন্দু’ দেখার মত । কথা বাড়িয়ে লাভ নেই আসুন আমরা সিরাজগঞ্জ শহরের এদিক সেদিক একটু ঢুঁ মারি ।
সিরাজগঞ্জ শহর আসলে দুই ভাগে বিভক্ত, শহরের মাঝখান দিয়ে ‘কাটাখালী’ নামের এক খাল বয়ে গেছে। যদিও কালের বিবর্তনে এর প্রবাহ এখন আর গতিশীল নেই তার পরেও শহর ‘এপার’ আর ‘ওপার’ নামে চিহ্নিত ! এই খালের উপরেই শহরের এপাড় ও ওপাড় সংযোগ করতে ১৮৯২ সালের ৬ অগাস্ট তৎকালীন বাংলা ও আসামের গভর্নর স্যার চার্লস ইলিয়ট এই ব্রীজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তার নাম অনুসারেই পরবর্তীতে এই ব্রীজের নামকরণ হয় ‘ইলিয়ট ব্রিজ’।
ইলিয়ট ব্রীজের পূর্ব পাড়
স্থানীয় ভাবে এই ব্রীজ ‘বড়পুল’ নামে পরিচিত। মাঝখানে পিলার ব্যাতিত সম্পূর্ণ স্টিলের কাঠামোর উপড়ে এই ব্রীজটি দাড়িয়ে আছে। সাবেক কালে যখন কাটাখালী দিয়ে মালবাহী বড় বড় নৌকা ও বার্জ পিলার বিহীন এই ব্রীজের নীচ দিয়ে নির্বিঘ্নে পার হত।
ব্রীজের মাঝামাঝি
ব্রীজের নীচ দিয়ে বয়ে চলা 'কাটা খালী খাল'
পিলারবিহীন মূল ব্রীজ (নীচ থেকে)
আজও কালের সাক্ষী হিসেবে সেই ‘বড়পুল’ বহাল তবিয়তে শহরবাসী ও ছোট ছোট গাড়ী ঘোড়া পার করছে। আপনি ইচ্ছে করলে হেঁটে হেঁটে যখন ‘বড়পুল’ পার হবেন, একটু অবাকই হবেন বুঝতে পারবেন ‘বড়পুল’ নাম করনের সার্থকতা । কেমন হবে আপনার অনুভূতি যখন মনে হবে এই ব্রিজের বয়স আজ ১২৩ বছর, যে রেলিংটা দেখছেন তা হয়ত কোন এক ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ারের লাগানো...... এটা মনে করে অবশ্যই রোমাঞ্চিত হবেন !
ঐতিহাসিক ‘বড়পুল’ উপড়ে হাঁটাহাঁটিতে শিহরিত হতে হতে চলুন আমরা এক প্রবাদ পুরুষের স্মৃতি দর্শন করি। যার কথা বলছি তিনি উপমহাদেশের অগ্রজ মুসলিম সাহিত্যিকদের একজন, তিনি ‘সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী’। সিরাজগঞ্জ শহরের যে কোন স্থান থেকে যে কোন রিকশাওয়ালাকে ‘সিরাজী বাড়ী’ তে যাবেন বললেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনাকে ‘সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী’র বাড়ীতে নিয়ে যাবে।
ইসমাইল হোসেন সিরাজী'র মাজার আঙ্গিনা
মূল মাজার
পাঠাগার
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ১৩ই জুলাই ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। ১৯০০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনলপ্রবাহ’ প্রকাশিত হয়। তিনি তৎকালীন বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন আর পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের জাগরনের উদ্দেশ্যে বলিষ্ঠ লেখনী আর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহন করেন। বৃটিশ সরকার তার প্রকাশিত ‘অনলপ্রবাহ’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করেন এবং বৃটিশ বিরোধী অবস্থানের জন্য তাকে কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়। তার কাব্য গ্রন্থের মধ্য ‘অনলপ্রবাহ’, ‘উচ্ছ্বাস’, ‘উদ্ভোধন’, ‘স্পেন বিজয়ের কাব্য’ আর উপন্যাসের মধ্যে ‘তারা বাঈ’, ‘ফিরোজা বেগম’, ‘জাহানারা’ ও ‘রায় নন্দিনী’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই এই তেজস্বী পুরুষ ইন্তেকাল করেন।
সিরাজী বাড়ীতে আপনি এখন দেখতে পাবেন ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মাজার আর একটি পাঠাগার। গম্বুজে ঢাকা তার কবরের পাশে গিয়া এই প্রবাদ পুরুষের স্মৃতির প্রতি সন্মান জানিয়ে এক মিনিট নিরাবতা পালন করতে পারেন।
সিরাজগঞ্জ একটা গড়পড়তা ছোট শহর, তেমন একটা ভীরভাট্টা ছাড়া এই শহরে আসুন আমরা একটু রিকশা ভ্রমন করি। শহরের স্টেশনের নাম হচ্ছে ‘সিরাজগঞ্জ বাজার’, এক সময়ে খুবই প্রানচঞ্চল স্টেশন এখন খুবই স্তিমিত। যমুনা ব্রিজ চালু হওয়ার পড়ে সিরাজগঞ্জ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের মধ্যে চলমান রেলওয়ে স্টিমার চলাচল বন্ধ হওয়াতে এই রেল রুট আর এই স্টেশন তার সাবেক কালের গৌরব হারিয়েছে, তবে স্টেশন তার প্লাটফ্রম সহ কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। স্টেশনের সামনের খোলা চত্ত্বর এখন শহরবাসীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্থান।
সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন
পথ চলতে চলতে চোখে পড়বে সাবেক কালের এমন বাড়ী
শহরের সুন্দর রাস্তা
বাজার স্টেশন চত্ত্বর
ইচ্ছা করলে রাত্রীযাপন করতে পারেন
যমুনার পাড়ে বসেই দেখতে পাড়েন মাছ ধরা
শুরুতেই বলেছি সিরাজগঞ্জ শহরের পাশদিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্ত ‘যমুনা’ নদী আর এই নদী ভালোমন্দ মিশিয়ে শহরকে দিয়েছে এক অসাধারণ রূপ। নদীর বাঁধানো পার বিকেলবেলায় শহরবাসীর বিনোদন কেন্দ্র আর বেড়ানোর যায়গা সেইসংগে সকাল বেলার প্রাতঃভ্রমণের যায়গাও বটে। যেখানে গেলে অসহনীয় গরম কালের বিকেলে আর সন্ধ্যা বেলায় ফুরফুরে হাওয়ায় দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। শহরের পুরানো জেলখানা ঘাটে নদীর পাড়ে ধাপে ধাপে সিঁড়িতে সুন্দর বসার ব্যবস্থা, যেখানে ইচ্ছা হলে দিনমান বসে থাকতে পারবেন।
ভোরের শুনশান স্নিগ্ধ নদীর পাড়
খুব ভোরে উঠে চলে যান নদীর পাড়ে দর্শন করুন অপূর্ব সূর্যোদয়, ভোরের এই অপার্থিব আলো আপনার শরীর-মনকে দেবে এক অন্যরকম প্রশান্তি। সামনের এই অসাধারন ঊষারঙ্গা নদীবক্ষ আপনাকে বারবার আনমনা করে দেবে। আর সকালে যেতে পারেননি তাতে কোনই সমস্যা নেই বিকেলেই যান, বাঁধ ধরে হাঁটতে থাকুন, চলে যান মোটামুটি শেষ সীমায় একদম বাঁধের মাথায় ( যায়গাটি স্থানীয় ভাবে ‘ক্লোজার’ নামে পরিচিত), বেশ খোলা যায়গা এখান থেকে আপনি দেখতে পারবেন মায়াময় সূর্যাস্ত আর যদি বর্ষাকাল হয় দেখতে পাবেন পানির ভয়ংকর সৌন্দর্য আর ঢেউ এর গর্জন। গোধূলীরঙ্গা আকাশ আর তার ছায়া পড়ে বদলানো নদীর রঙ সেই সাথে স্রোতের ভয়ংকর সৌন্দর্য আপনাকে দেবে এক অপার্থিব অনুভূতি।
অপূর্ব সূর্যোদয়
সিরাজগঞ্জে আসলেন যাওয়ার সময় বন্ধু-বান্ধবের জন্য কিছু তো নিয়ে যেতেই হবে, তাই না? হুম ! সঙ্গে নিতে পারেন মজার মজার মিস্টি, সিরাজগঞ্জের রকমারি মিস্টি আর দই খুবই মজার।
দেখতে কেমন লাগছে
এছাড়া আপনি সিরাজগঞ্জের তৈরী কাপড়ও কিনতে পারেন, শহরের এস, এস রোডের বিভিন্ন মার্কেট অথবা নিউমার্কেটের কাপড়ের হাট থেকে আপনি সিরাজগঞ্জের তৈরী শাড়ী, লুঙ্গি আর গামছা কিনতে পারেন।
কেমন লাগলো উত্তর বঙ্গের প্রবেশ দ্বার...সিরাজগঞ্জ? ভালোই তো বেড়ালেন! তাই না?
============================================================
ছবিঃ মানস চোখ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১৮