“…বাঁশখালী মইশখালী
পাল উড়াইয়া দিলে
সাম্পান গুরগুরাই টানে
আয় তোরা হন্ হন্ যাবি
আঁর সাম্পানে….”
অ...নে...ক, অ...নে...ক পুরনো গান, চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক গানটি ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত “সাম্পানওয়ালা” সিনামাতে চিত্রায়িত হয়েছে। গানটি শুনলেই চোখে ভেসে ঢেউয়ের দোলায় দুলতে থাকা সাম্পান আর সেই সাথে অনুভব করা যায় সাগরের নোনা ঘ্রাণওয়ালা বাতাস...... আহ্......!!!!! কেমন যেন আনমনা করে দেওয়ার মত দৃশ্য! আর মহেশখালী... বাঁশখালী নাম গুলোর মধ্যেও যেন কেমন যেন একটা যাদু আছে শুনলেই যেতে ইচ্ছে করে।
মহেশখালীতে বেশ কয়েকবার গেলেও বাঁশখালীতে কখনো যাওয়া হয় নাই। অবশেষে কর্মসূত্রে দুই সহকর্মী সহ ফেব্রুয়ারীর এক সন্ধ্যায় বাঁশখালীতে উপস্থিত হলাম। তখনো পর্যন্ত বাঁশখালী সম্পর্কে তেমন কিছু তথ্য জানতাম না। শুধু জানা ছিল বাঁশখালী চট্টগ্রাম জেলার একটি উপজেলা। আর যে গ্রাম ও ইউনিয়নে কাজ করব তার নাম ও অবস্থান টা জানতাম। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস টারমিনাল থেকে বাসে করে সোয়া ঘণ্টায় বাঁশ খালীতে গিয়ে নামলাম। তখনো শঙ্খ নদীর উপরে সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি, একদিকে সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে আর পাশ দিয়ে আমাদের ফেরিতে পার হতে হল।
সন্ধ্যাবেলা নেমেই বেশ ঝামেলায় পরে গেলাম। থাকার কোন জায়গা ঠিক করে আসি নাই আর তেমন কোন হোটেলও নাই। তবে জেলা পরিষদের একটা ডাকবাংলো আছে তা জানতাম, তাই প্রথমে সেখানে গেলাম কিন্তু বিধি বাম, ডাকবাংলো সরকারী লোকজনে ভর্তি। তবে বাংলো কেয়ারটেকার আমাদেরকে জানালো এখানে এনজিও প্রশিকার গেস্ট হাউজ আছে ওইখানে যোগাযোগ করতে, কেয়ারটেকার আমাদের প্রশিকার গেস্ট হাউজের অবস্থান ভালো করে বুঝিয়ে দিল আর জানালো আগামীকাল থেকে আমরা কয়েকদিন বাংলো তে থাকতে পারব। অবশেষে প্রশিকার গেষ্টহাউজে আমরা সেই রাত্রের জন্যে জায়গা পেলাম।
বাঁশখালী বাংলাদেশের একটি উপকূলীয় জনপদ। নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খবরের শিরোনাম হয়েছে। প্রশাসনিক দিক থেকে এটা চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত একটা উপজেলা। এর উত্তরে আনোয়ারা উপজেলা আর দক্ষিনে কক্সবাজারের পেকুয়া ও চকোরিয়া উপজেলা, পূর্বে চট্টগ্রামের লোহাগড়া আর সাতকানিয়া উপজেলার পাহাড়ী এলাকা এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। বাঁশখালী সদরের নাম ‘জলদি’ আর ‘জলদি বাজার’ প্রধান এলাকা।
গ্রামের একটি সাধারন বসত বাড়ী
গ্রামের ঘূর্ণি ঝড় আশ্রয় কেন্দ্র
নৈসর্গিক দিক থেকে বাঁশ খালী যে একটা অনন্য এলাকা তা ওইখানে ঘুরাঘুরি করে জানলাম। একদিকে যেমন দিগন্ত বিস্তৃত সাগর আর অন্যদিকে সবুজ পাহাড়ের সারি। জীবন-যাত্রাও অনন্য যা সচরাচর বাংলাদেশের অনন্য অঞ্চলের সাথে তেমন মেলে না। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই এলাকা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি।
গ্রামের একটি চায়ের দোকান
পরদিন আমাদের কাজের অংশ হিসেবে সদরের কাছাকাছি একটা ইউনিয়নের কয়েকটা গ্রামে গেলাম, এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হল সাগরে মাছ ধরা আর লবণ চাষ, সাগরের কাছাকাছি বাঁধের ভেতরের জমিগুলোতে চাষীরা লবণ চাষ করে আর পূর্ব দিকের পাহাড়ের পাদদেশের উঁচু জমিগুলোতে কিছু ফসল ফলানো হয়।
ছোট খাল থেকে বড় খালে লোনা পানি ঢুকানো হচ্ছে
লবণের খেত তৈরী হচ্ছে
সমুদ্রের লোনা পানি থেকে যে লবণ চাষ করা হয় এইটা জানতাম বইয়ে আর পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। এই যাত্রায় বাঁশখালী এসে লবণ চাষ সামনাসামনি দেখলাম। বাঁশখালী বাংলাদেশের অন্যতম লবণ উৎপাদনকারী এলাকা। বাঁশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী তে বাংলাদেশের সিংহভাগ লবণ উৎপাদিত হয়।
রোদের তাপে পানি শুকিয়ে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে
শুষ্ক মৌসুমেই প্রধানতঃ লবণ চাষ করা হয়। আমরা ফ্রেব্রুয়ারী তথা ফাল্গুন মানে ওইখানে যাওয়াতে লবণ চাষ সুন্দর ভাবে দেখতে পারি। বড় জমিগুলোতে ছোট ছোট করে প্লট তৈরী করে যার মধ্যে ৫/৬ ইঞ্চি গভীরতায় পানি আটকে থাকে আর জমির বেড শক্ত কাদা দিয়ে মসৃণ করা হয় এর পরে কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে জমিটি লবণ চাষের জন্য প্রস্তুত করা হয়। জোয়ারের সময়ে স্লুইচ গেট খুলে বড় খাল থেকে ছোট খালে লোনা পানি ঢুকানো হয়। এর পরে পাম্প দিয়ে জমিগুলোতে এই পানি ঢুকানো হয়।
উৎপাদিত লবণের আস্তরণ এখন খেত থেকে তোলা হবে
ফাল্গুন চৈত্র মাসের কড়া রৌদ্রে জমিতে ধীরে ধীরে পানি শুকাতে থাকে, কৃষকেরা এই সময়ে নিয়মিত জমির পরিচর্যা করতে থাকে, জমির লবণের মধ্য থেকে ময়লা পরিষ্কার করে। পানি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে গেলে জমিতে লবণের সাদা স্তর পরে থাকে। এর পর এই লবণ পরিশোধন করে বাজারজাত করার জন্য চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন লবণ ফ্যাক্টরির কাছে বিক্রি করা হয়।
বাঁশখালীতে যে ইকো পার্ক আছে তা জানা ছিল না, একদিন জলদিবাজারের এক রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে খেতে জানতে পারলাম যে এখানে একটা ইকোপার্ক আছে যা খুবই সুন্দর, তখনি আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওইখানে অবশ্যই যেতে হবে। পরদিন বিকেলে আমরা সময় করে ইকোপার্ক দেখতে রওনা দিলাম। জলদিবাজার থেকে সিএনজিতে ২০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম বাঁশখালী ইকোপার্কে, খুব একটা দর্শনার্থী চোখে পরল না। টিকেট কিনে ভিতরে ঢুকলাম, বেশ সুন্দর ছিম-ছাম মনে হল। বসন্তের আগমনে এই শেষ দুপুরের ঝিরঝিরি বাতাসে লেকের কাকচক্ষু পানিতে ছোট ছোট ঢেঊ উঠেছে, সামনে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি, অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যপট।
ইকোপার্কের অনিন্দ্য সুন্দর লেক
বাঁশখালী ইকো পার্ক মূলতঃ একটা ছোট্ট মাত্রার সেচ প্রকল্পের জলাধার ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে, পাহাড়ের ফাকে ফাঁকে দুইটা বড় বড় লেক ‘ডানের ছড়া’ আর ‘বামের ছড়া’ এই ইকো পার্কের মুল আকর্ষণ। এটা চুনাতি বন্যপ্রানী অভয়ারণ্যের পশ্চিম সীমানায় বাঁশখালীর দিকে অবস্থিত।
ইকোপার্কের মাঝে ওয়াচ টাওয়ার
একটা লেকের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত ঝুলন্ত সেতু আর দুইটি স্থাপনা দেখলাম, স্থাপনা গুলো নতুন তৈরী করা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এগুলো বন বিভাগের রেস্ট হাউজ। আমরা নিরিবিলি এই বিকেলে লেকের পাশে বসে বসে কিছুক্ষন এই নির্জন সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
লেকের পাড় ঘেষে বন বিভাগের রেস্ট হাঊজ আর লেকের উপরে ঝুলন্ত সেতু
দূরে পাহাড়ের উপড়ে একটা টাওয়ারের মত দেখলাম। আমারা উৎসুক হয়ে টাওয়ারটার দিকে এগোলাম। এটা বেশ উঁচু একটা ওয়াচ-টাওয়ার। ৫ তলার মত উঁচু হবে। আমরা উৎসাহের সঙ্গে উপড়ে উঠলাম। উপড় থেকে আশেপাশের পাহাড় নিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়, যে দিকে তাকাই শুধুই ঢেউ খেলানো পাহাড় দেখি। সন্ধ্যা পর্যন্ত ইকোপার্কে সময় কাটিয়ে আমরা ফিরলাম।
জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে ৩ দিন থাকার পরে কেয়ারটেকার জানালো আগামী কয়েকদিন আর থাকা যাবে না আমরা যথারীতে আবার আবাসন খোঁজা শুরু করলাম। অবশেষে এক সরকারী সংস্থার সুন্দর একটা গেষ্ট হাউজে থাকার সুযোগ পেলাম এবং বাকি এক সপ্তাহ আমরা ওই গেষ্ট হাউজেই ছিলাম। এখানে আসাতে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার বেশ সুবিধা হল। কেয়ারটেকার আমাদের ফ্রেশ রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করল এবং ওইখানেই আমি প্রথম সামুদ্রিক মাছ খাওয়া শুরু করি। সে প্রতিদিন সকালে সাগরে ধরা একদম টাটকা মাছ কিনে আমাদের রান্না করে দিত। এক দিন আমি জিজ্ঞাসা করলাম আজকে কি মাছ রান্না করেছেন? সে জানালো আজকে ‘পোকা’ মাছ রান্না হয়েছে। আমি তো মোটামুটি ভরকে গেলাম, যাই হোক আমার এক সহকর্মী জানালো এইটা হচ্ছে ‘পোয়া’ মাছ ।
উনার কাছ থেকে সাগর পারে যেখানে মাছ বাজার তার সন্ধান নিলাম আর এক বিকেলে আমরা সেই মাছের বাজার দেখতে গেলাম। কিন্তু আমারা যেতে যেতে বাজার মোটামুটি শেষ আর উনারা জানালো মাছ দেখতে হলে ভোরে আসতে হবে, সকালেই প্রধানতঃ বড় বাজার বসে।
পড়ন্ত বিকেলে সাগর বেলাভূমি
আমারা মাছ বাজার ঠিক মত দেখতে না পারলেও বাঁশখালীর বন্য সৈকত দেখলাম, যেখানে কোন ধরনের ভীর-ভাট্টা নাই প্রকৃত পক্ষে আমরা কয়েকজন ছাড়া কেউ ছিল না। কক্সবাজারের মত নীলাভ পানি নাই তবে পানিতে বেশ বড় বড় ঢেউ রয়েছে। শেষ বিকেলের রঙ্গিন আলোয় চারদিকে আলোকিত এবং নির্জন সৈকতে আমরা কয়েকজন, সাগরে ছোট ছোট অর্ধ চন্দ্রাকৃতির মাছ ধরার সাম্পান গুলো মাছ ধরছিল।
বেলাভূমিতে কাঁকড়ার শিল্পকর্ম
ভাটার সময় আসন্ন হওয়ায় আমাদের পানিতে হাঁটাহাঁটি
আমাদের সেই মাঝি ভাই
সেই স্মৃতিময় সূর্যাস্তের ছবি, প্রকৃতপক্ষে ক্যামেরায় এই দৃশ্য কখনও ধরা যাবে না
আমাদের সামনে একটা মাছ ধরার ট্রলার নোঙ্গর করা ছিল, মাঝিকে প্রস্তাব করলাম আমাদের নিয়ে কিছুক্ষন সাগরে ঘুরতে। মাঝি ভাই রাজী হলে আমরা কয়েকজন ট্রলারে উঠে পরলাম। সন্ধ্যার আগমনী এই সময়ের অপূর্ব মায়াবী আলোতে আমরা ট্রলারে সাগরের ঢেঊয়ে দুলতে লাগলাম, বেশ কিছু দূর গিয়ে যেখান থেকে সৈকত আবছা আবছা দেখা যাচ্ছিল সেখানে গিয়ে মাঝিকে বললাম থামাতে বেশ ঢেঊএর দোলায় ট্রলার দুলতে থাকল আমরা কয়েকজন নিঃস্পলক দৃষ্টিতে সূর্য ডুবে যাওয়া দেখলাম। যা এখনো আমার দৃষ্টি পট ছুঁইয়ে রয়েছে আর চোখ বন্ধ করলেই সেই সূর্যাস্ত দেখতে পাই যা আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা সূর্যাস্ত।
=========================================================
পুনশ্চঃ স্মৃতি থেকে লেখা এই ভ্রমণের সময়কাল ২০০৬, অনেক কিছুই মনে করতে পারছি না। স্মৃতি ঘাটতে আমার সংগে ভ্রমণকারী দুই সহকর্মীকে বারবার ফোনে জ্বালাতন করেছি, তাঁদেরকে অসংখ্য ধন্যবা আমার এই জ্বালাতন হাসি মুখে (!!!!) সহ্য করার জন্য।
ছবিঃ 'মানস চোখ'
ক্যামেরাঃ সনি সাইবার শট
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৬