somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘন বর্ষায় সিলেটে

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গতবছর শুষ্ক মৌসুমে কর্মসূত্রে সিলেটে গিয়েছিলাম, সময়ের ব্যাপক টানাপোড়ান সত্যেও সহকর্মীরা কয়েকজন মিলে এক সকালে জলজবন রাতারগুলে ঝটিকা সফরে যাই, যা নিয়ে সামুতে একটা লেখা দিয়েছিলাম (লিংকঃ "জলজবনঃ যেখানে বৃক্ষ ও জলের একত্রবাস" )। জলজবনে সেই সংক্ষিপ্ত সফরে আমরা এর সৌন্দর্যে ব্যাপক বিমহিত হয়ে বর্ষায় এর সুন্দরতর দৃশ্য কল্পনা করেছিলাম। তখন সবাই উপলব্ধি করেছি যে আমাদেরকে আবার আসতে হবে এবং তা অবশ্যই বর্ষায়।
যাইহোক, সহকর্মীরা মিলে বর্ষায় আবার সিলেট যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার ব্যাপক পরিকল্পনা করলেও সময়ের চলমান চাকায় আর বাস্তবতার চিপায় পড়ে সেই পরিকল্পনা যখন আর বাস্তবতার মুখ দেখছিল না, শেষমেশ গত অগাস্ট মাসের শেষদিকে আমিই বর্ষায় সিলেট দেখার জন্য রওনা হলাম। এবার সঙ্গী হল স্ত্রী ও পুত্র, আউলা টাইপের পর্যটক আমি, আমার সাথে বেড়াতে গেলে কপালে কোন দুর্গতি নেমে আসে তার ঠিক নেই তার পড়েও তারা আমার সঙ্গী হল :) । এদিকে বরষা মানে একদম ঘনঘোর বর্ষা, ২/৩ দিন ধরে অঝোরধারায় ঝরছে আর কয়েকদিন আগেই সিলেটের সীমান্ত এলাকায় ঢল হয়ে গেছে এর পড়েও ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনার সাথে আমরা যাত্রা করলাম।
কিছু দুর্গতি যে হবে তা স্ত্রী মেনে নিয়েই সঙ্গী হয়েছে, কিন্তু এটা যে শুরুতেই হবে আমি নিজেও তা বুঝতে পারিনি। রাজারবাগ গ্রীন-লাইন কাউন্টার থেকে দুপুর ১.০০ তে আমাদের বাস। মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রওনা দিলাম ১১.১০ কিন্তু বিজয় সরণি হয়ে ফার্মগেট আসতে আসতেই ১২.১০, কে জানে এতো জ্যাম হবে! বাংলা মোটর আসতে আসতেই ১২.৪০। স্ত্রীর মুখ যথারীতি কালো আর আমি তো ধরেই নিয়েছি বাস আমাদের ফেল। আমি ৫/১০ মিনিট দেরী করে বাস, ট্রেণ স্টেশনে গিয়ে সেই বাস বা ট্রেন ধরতে পেড়েছি এই রকম ইতিহাস আমার জীবনে নাই :((, উল্টা বাস ট্রেন ফেল করার ব্যাপক রেকর্ড আমার আছে, তবে এযাত্রায় ওরা সঙ্গে থাকায় মনের কোনে হালকা আশার সঞ্চার হয়, হয়তো ওদের কল্যাণে আজকে দেরি সত্যেও বাস ধরা যাবে। যদিও ওদের বলছিলাম এই বাস ফেল হলে সমস্যা নাই পরেরটাতে আমরা যাব কিন্তু মুখে বললেও সেদিন বৃহস্পতিবার হওয়ার এই আশাতে খুব ভরসা পাই না। বেইলী রোড এর চিপা-চাপা দিয়ে যখন মালীবাগ মোড়ের সিগন্যালে পড়লাম তখন ঘড়ির কাঁটা ১.০৫ এ ছোঁয় আর সেই সাথে আমাদের বাস ধরার সকল আশা সামনের জ্যামের সমুদ্রে মিশে যায়। অবশেষে আমরা ১.২০ টাতে গ্রীনলাইন বাস স্ট্যান্ডে আসি এবং জেনে অবাক হই যে ১.০০ টার বাসে তখনো বোর্ডিং শুরু হয়নি :D, যাক বাবা বাঁচা গেল আর দেরি করে বাস ধরার বিষয়টা আমার জীবনে এই প্রথম ঘটল B-)
সারা রাস্তাই মোটামুটি ঝুম বৃষ্টির সঙ্গে ভ্রমণ। বাসের জানালার পর্দা সরিয়ে রাস্তার পাশের টইটম্বুর হওয়া খাল, জলমগ্ন প্লাবনভূমি আর দূরের ঘোলাটে গ্রাম-জনপদের উপরে অবারিত বর্ষণের মধুর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা সিলেটের দিকে চললাম। দীর্ঘদিন শহরে অনাভ্যাস চোখে এই দৃশ্য মোটেও ক্লান্তিকর মনে হয় না। রাত ৮.০০ টার দিকে আমরা সিলেট পৌঁছে পূর্ব নির্ধারিত হোটেল মেট্রোতে উঠি। পরদিনের আমাদের বের হওয়ার ইন্তেজাম চুড়ান্ত করলাম, এযাত্রায় আমরা ব্যাপক আলোচিত 'বিছানাকান্দি', 'পান্তুমাই ঝর্না' আর বর্ষায় জলমগ্ন 'রাতারগুল' জলজবনে যাব।
সকাল আট টাতে চা-নাস্তা খেয়ে আমরা মাইক্রোবাসে উঠি। ড্রাইভার আব্দুর রহিম, ডবল পান মুখে দিয়ে তার গাড়ী চালু করে বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে আপাততঃ হাদারপাড় বাজারের দিকে রওনা দেই। 'বিছানাকান্দি' নাম শুনেই আমার কেমন জানি ঘুম ঘুম লাগে :P, আবেশে চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছা করে। ড্রাইভার মশাইয়ের কাছে জানতে পাই গত সপ্তাহের পাহাড়ী ঢলে সরাসরি রাস্তা কয়েকদিন বন্ধ ছিল। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা বিমানবন্দর রাস্তায় পড়ি। বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে আমরা রাস্তা বদলে ডান দিকে কোম্পানিগঞ্জ-ভোলাগঞ্জের রাস্তা ধরে আগাতে থাকি। থেমে থেমে যথারীতি বর্ষণ চলছে, মেঘলা আকাশের কারণে প্রকৃতি আরো ঘন সবুজ দেখায়। বিমানবন্দরের পেছনের রাস্তা এত খারাপ যে আমদের চোখে বড় বড় পুকুরের মত মনে হয়। স্ত্রী ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করে আমরা রাস্তায় আছি না অন্য কোথাও :D। ড্রাইভার দক্ষতার সাথে পানিতে টইটুম্বুর বড় বড় খানা খন্দ বাঁচিয়ে গাড়ী চালাতে থাকে। প্রায় আধা ঘন্টারও বেশী আমরা এইভাবে সামনের দিকে আগাতে থাকি এর পরে মোটামুটি ভালো রাস্তা পাই। কিছুক্ষন পরে সালুটিকর নামক স্থানে গোয়াইন নদীর সেতু পাড় হয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে সালুটিকর বাজার পাড় হয়ে গোয়াইনঘাট রাস্তা ধরে হাদারপাড় বাজারের উদ্দেশ্যে আগাতে থাকি। হাদারপাড় থেকে আমাদের বিছানাকান্দি আর পান্তুমাইএর নৌকা যাত্রা শুরু করতে হবে।
হাদারপাড় বাজারের কাছাকাছি আসতে না আসতেই ঝুম বৃষ্টি নামে। পুত্রকে বর্ষাতি পড়িয়ে আমরা ছাতা নিয়ে গাড়ী থেকে নামি। এর মধ্যেই হাদারপাড় বাজারে গাড়ী পারকিং এর যায়গা তৈরি হয়ে গেছে। ড্রাইভার ৫০ টাকার বিনিময়ে গাড়ী পার্ক করে। আমরা লোকজনের প্রদর্শিত পথে বাজারের মধ্যদিয়ে আগাতে থাকি। নৌকা ঘাটে যাওয়ার আগে পাকশী হোটেল নামে এক রেস্তরাঁয় ঢুকে চা-নাস্তা খাই। চা নাস্তা খেয়ে নৌকা ঘাটে এসে দেখি এই ঘন বর্ষায়ও পর্যটক দের কমতি নেই। আমার খুবই ভালো লাগে মানুষজনের নিজ দেশের এই সৌন্দর্য আবিস্কার ও উপভোগ করার।


এমনই ঝুম বৃষ্টিতে যাত্রা শুরু হল
প্রথমে বৈঠাওয়ালা দেশী নৌকার অনুসন্ধান করলে মাঝি-মাল্লাদের কাছে মোটামুটি হাসির পাত্রে পরিণত হই B-)। গুগল ম্যাপে হাদারপাড় বাজার থেকে পিয়াইন নদী ধরে বিছানাকান্দি দূরত্ব ৫/৬ কি। মি। দেখায়, তাই আমার মনে হয়ে একটা দেশী বৈঠা বাওয়া নাও এ এই দূরত্ব সহজেই যাওয়া যায় আর অন্ততঃ শব্দ দূষণের হাত থেকে বাঁচা যায়। আমরা সব মিলিয়ে আড়াই জন হওয়াতে বেলাল নামের এক মাঝির একটু ছোট সাইজের নৌকা ভাড়া করি। তবে পুরো ঘাট খুঁজেও আমি একটা ছইওয়ালা নৌকা পাইনা, আমার মনে হয় বর্ষা পুরোপুরি উপভোগের জন্য এরা কেউ নৌকাতে ছই রাখে নাই :D। মাঝির সাথে চুক্তি হয় যে আমাদের বিছানাকান্দি আর পান্তুমাই ঝর্না দেখিয়ে নিয়ে আসবে আর আমরা এই দুইটা যায়গাতে যতক্ষন থাকতে চাই ততক্ষন থাকবে, সময় নিয়ে কোন ঝামেলা করবে না।
যাক, অবশেষে আমরা বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে রওনা হই, যথারীতি মুষলধারে বৃষ্টি চলছেই এবং সেই সংগে একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে ঠাডা (বাজ) পড়ছে। পুত্রের মা তার জন্য শঙ্কিত হয়, আমি মনে মনে শঙ্কিত হলেও বাইরে প্রকাশ করিনা বরঞ্চ তাদের কে প্রকৃতির দিকে নজর দিতে বলি। পুত্র বর্ষাতি পড়লেও তাকে ছাতা দিয়ে ঢেকে দেই আর আমরা ভিজতে থাকি। নদী কানায় কানায় পূর্ণ দুই দিকের প্রকৃতি ঘন সবুজ আর নদীকে ঢেউ ছাড়া সমতল চাদরের মত মনে হয়, সমতল চাদরের উপরে বৃষ্টির একধরনের ছন্দ তৈরি করছে। নৌকার ইঞ্জিনের শব্দের কারনে বৃষ্টির শব্দ খুব একটা পাওয়া যায় না বলে মনে একটু আফসোস হতে থাকে।



দূরে মেঘালয় পাহাড় দেখা যাচ্ছে
কিছুক্ষন পড়েই মেঘে ঢাকা মেঘালয় পাহাড় চোখে পড়ে। পাহাড়ের প্রকৃতি যেন কিছুক্ষন পর পর বদলে যাচ্ছে, এই মেঘে ঢেকে যাচ্ছে কিচ্ছুই দেখা যাচ্ছে না একটু পরেই আবার মেঘ যেন পাহাড়ের উপরে ভাসছে আবার একটু পড়েই মেঘ পাহাড়ের নিচে, অদ্ভুত দৃশ্য :)





বিছানাকান্দির স্রোতস্বিনী ছড়া আর মেঘালয় পাহাড়ে মেঘের অপরূপ খেলা
স্ত্রী আর পুত্র একটু আগের ঠাডা পড়ার আশংকার কথা ভুলে যায়, তারা একটু পর পরই 'ওয়াও' 'ওয়াও' করে চলমান মেঘের খেলা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতে থাকে । আমাদের নৌকা বিছানা কান্দিতে এসে থামে আমরা নৌকা থেকে নামি।



পাথরের বিছানা বিছানো বিছানাকান্দি
বিছানাকান্দির এই ছড়াটি সীমান্তের ওপাড়ের দুই পাহাড়ের মাঝের উপত্যকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। পানির সাথে সাথে মেঘালয় পাহাড় থেকে পাথর আর ভারী বালি নিয়ে আসে। এতোদিন ছবিতে দেখতাম অনেক পাথরের মধ্যে দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে কিন্তু অবিরাম বর্ষণের কারণে পানি বেশী থাকায় ছড়াটিকে বেশ স্রোতস্বিনী মনে হয়। পরিষ্কার ঝকঝকে পানি গর্জন তুলে সবেগে ধাবিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি না থাকায় আমরা ধীরে ধীরে পানির কাছে যাই এবং প্রবাহমান পানির মাঝে উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বড় পাথরের উপরে বসি। একটু দুরেই বাংলাদেশ-ভারত সীমানা চিহ্নিত পিলার আর ভারতীয় ভূখন্ডে ওদের সীমান্ত রক্ষীদের স্থাপনা দেখা যাচ্ছে। দূরে এই ছড়ার উপরে একটি সেতুর মত দেখা যায়। মেঘের খেলা যথারীতি চলছে, একটু পর পর পাহাড়ে মেঘ সরে গেলেই পাহাড় থেকে পতিত ঝর্না গুলো দৃশ্যমান হচ্ছে।
ছড়ার পাড়ে পাথরের উপরে অনেক গুলো অস্থায়ী দোকান বসেছে। চা-পান তো আছেই এমনকি ভাত ও বিরিয়ানী ও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে এবং সেই সংগে যত্রতত্র ময়লাও পড়ছে আর নোংরা হচ্ছে। আচ্ছা বলতে পারেন... আমাদের পর্যটন সম্পর্কিত অভ্যাস গুলো এমন কেন? আমাদের কেন সব জায়গাতে সব সুবিধার দরকার হয়? এই রকম যায়গাও আমার জন্য কেন খাবারের দোকান লাগবে? হাদারপাড় বাজার থেকে এই যায়গার দূরত্ব ১ ঘ্নটারও কম আমরা তো ঐখান থেকেও খাওয়া-দাওয়া করে আসতে পারি অথবা গিয়ে করতে পারি। যাই হোক এই সব বিষয়ে আমাদের আরো ব্যাপক সচেতন হতে হবে।




অপরূপ মেঘের ভেলা


বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে পর্যটকদের নাও
প্রায় দুই ঘণ্টা সময় কাটানোর পরে আমরা বিছানাকান্দি থেকে পান্তুমাই ঝর্না দেখার উদ্দেশ্য আবার নৌকাতে উঠি।চারদিকে পানি থাকায় আমরা আড়াআড়ি ভাবে এসে আবার পিয়াইন নদীতে পড়ি।


নদীতে বালি সংগ্রহে ব্যস্ত শ্রমিকেরা


পান্তুমাই ঝর্নার উদ্দেশ্যে চলছে আগ্রহী পর্যটকেরা
আমাদের সামনে পিছনে পর্যটকবাহী অনেক নৌকা যেতে দেখা যায়। পান্তুমাই অবস্থানগত দিক থেকে বিছানাকান্দির পূর্বে এবং সীমান্তের একটা ঝর্না। পাশের গ্রামের নাম পান্তুমাই বলে ঝরনাটি পান্তুমাই নামে পরিচিত আর সীমান্তের ওপারে মেঘালয়ে ‘বড়হিল ফলস’ নামে পরিচিত। এই ঝর্নার স্রোত এসে পিয়াইন নদীতে মিশেছে। যথারীতি সীমান্ত বরাবর মেঘালয় পাহাড়ের উপরে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে আমরা পান্তুমাই ঝর্নার কাছে উপস্থিত হই।
নৌকা থামলে আমরা পাড়ে নেমে ঝর্নার দিকে অগ্রসর হই, একটু আগালেই এক সাইনবোর্ড আমাদের সামনে এগোতে বাঁধা দেয় “সামনে ভারত জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ” কি আর করা শেষ বিন্দু থেকে আমরা ঝর্না দর্শনে ব্যস্ত হই। পুত্র বার বার আরো কাছে যেতে চায় আর প্রশ্ন করতে থাকে কেন যাওয়া যাবে না :(, তাকে বুঝাতে গিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট হয়। অনেক উপড় থেকে সবেগে পানি পড়ছে সেই সংগে পানির গর্জন আমারা কিছুক্ষন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। কাছে না যেতে পাড়ার কষ্ট মনে নিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরি :)


এই সেই বেরসিক সাইনবোর্ড


মেঘে ঢাকা পান্তুমাই


মেঘ সরলে এই ছবিটি জুম করে তুলি
কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের ঝর্নার চেয়ে বর্ষায় নদীর দৃশ্য অনেক বেশী সুন্দর মনে হয়। হংসকুল নিরন্তর সাঁতার কাটছে, ওই যে গাঁয়ের কিশোরী কলসিতে পানি ভরছে, মাছরাঙ্গা ছোঁ মেরে মাছ ধরে উড়ে যায়......... ওহহহ কি মধুর দৃশ্য। আমরা খুশী হই আর যাই হোক পুত্রকে এই সকল দৃশ্যের সাথে পরিচয় করা গেল বলে।


গ্রামের পাশে হাঁসের দল
আমরা হাদারপাড় বাজারের কাছাকাছি আসলে আমাদের মাঝি ভাই এর বাড়ীর ঘাটে থামি। ওনার বাড়ীতে গিয়ে আমরা ভেজা জামা-কাপড় বদলিয়ে বিকেল ৪ টার দিকে হাদারপাড় বাজারে নামি। আবারও সেই পাকশী হোটেলে যাই এবং দুপুরের খাবার খেয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হই।

পরদিন সকাল ৭.৩০ টাতে আব্দুর রহিম মিয়া গাড়ী নিয়ে হাজির, আজকে আমাদের গন্তব্য জলমগ্ন ‘রাতারগুল জলজবন’ যথারীতি সে ডবল পান মুখে দিয়ে গাড়ী ছাড়ে। সকালের দিকে বৃষ্টি না থাকলেও আমরা রাতারগুলের কাছা-কাছি আসাতেই আবারও বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি আমাদের মনের কথা মনে হয় বুঝতে পেরেছে। রাতারগুলে যাওয়ার জন্য নৌকাঘাটে নেমে কিছুদিন আগের দেখা দৃশ্যের সাথে কিছুই মিলাতে পারি না। চারদিকে থই থই করছে পানি আর পানি, দূরে মনে হচ্ছে রাতারগুল পানিতে ভাসছে।


দূরে ভাসমান রাতারগুল বন
এখানে আমরা ঘাটে বাঁধা বৈঠা বাওয়া বেশ কয়েকটা নৌকা দেখতে পাই, এই সকালে আমরা আড়াইজন ছাড়া আর কোন পর্যটক দেখতে পাই না। আমরা একটা নৌকায় উঠে পরি তবে নৌকার মাঝি একটা অল্প বয়সী ছেলে হওয়াতে সে ঠিক মত চালাতে পারবে কি না এই নিয়ে আমার স্ত্রী কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে।


বনের মধ্যের খাল থেকে তোলা
যাইহোক আমরা দূরে দৃশ্যমান বনের দিকে আগাতে থাকি, পুত্র জিজ্ঞাসা করে বনে ঢুকলে বাঘ দেখতে পাবে কি না? তাকে নিরাশ করি না বলি দেখাও যেতে পারে :), সে খুব বিস্ময় প্রকাশ করে! ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমরা বনের দিকে আগাতে থাকি। মা ও ছেলে খুবই খুশী তারা বারাবার এই সুন্দর জায়গাতে নিয়ে আসার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতে থাকে। তবে কিছুক্ষন পড়ই ঘটনা উলটো হয়ে যায়! আমরা বনে প্রবেশ করি কিছুক্ষন বনের মধ্যের খাল দিয়ে ঘুরতে থাকি। সত্যই আমার আগের দেখা দৃশ্যর সাথে কিছুই মিলাতে পারি না। করচ আর হিজল গাছ গুলো পুরোপুরি পানিতে ভাসছে এবং কোথাও একটু খানি শুকনো জায়গাও নাই।




পানিতে ভাসছে হিজল করচ গাছ
খাল থেকে আমরা এবার নৌকা মূল বনের মধ্যে ঢোকাই, নৌকার শব্দে আশপাশের গাছ থেকে বেশ কয়েকটা ব্যাঙ ঝুপ ঝুপ করে পানি লাফ দেয়, একটা আবার নৌকার উপড়ে পড়ে :), পুত্র আর তার মা কিঞ্চিত ভয় পায়। ঘন গাছের ভেতর দিয়ে নৌকা সোজা যেতে পারে না, এঁকে বেঁকে চলতে থাকে। চারদিকে সুনসান নির্জন, বৃষ্টির টুপ-টাপ শব্দ, ২/১ টা মাছ আর ব্যাঙের লাফা-লাফি ছাড়া আর কোন শব্দ ও নাই। আর বৃষ্টির কারনে তেমন কোন পর্যটকের দেখাও পাই না। তারা দুই জনে এই নির্জনতা নিয়ে আবার কিছুটা শঙ্কিত হয়। আমরা বনের আরও গভীরে ঢুকি, গাছের গায়ে দুই চারটা জোঁক দেখতে পাই, মা আর ছেলে জোঁক চেনা না বলে আমি তাদেরকে কিছু বলি না :P। কিন্তু কিছুক্ষন পরে নৌকা একটা বড় সড় ঝকড়া করচ গাছে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাছের কোটরে বিশ্রামরত অবস্থায় একটা ঢোঁড়া সাপ দেখে ওরা দুইজন খুব ভয় পেয়ে যায় এবং মাঝিকে বলে নৌকা তারাতারি বনের বাইরে আনতে। মাঝি আর আমি তাদের যতই বুঝাই এটা ঢোঁরা সাপ তারা কোন কথাই শুনতে চায় না এবং আমার সাথে বনে-বাদাড়ে ঘুড়তে আসাটাই বিরাট বোকামী হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়। কি আর করা আমরা বন থেকে বেড়িয়ে আবার খালে চলে আসি। মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে আগের বারের দেখা সেই নির্মাণাধীন ‘ওয়াচ টাওয়ারের’ কাছে আসে, এবারও এই নিরন্তর প্রকৃতির মাঝে কংক্রিটের এই স্থাপনা কেমন যেন বেমানান লাগে! এই ভাবে আমরা বনের মাঝের খালে অনেকক্ষণ ভেসে বেড়াই।
বাংলাদেশের বর্ষা ঋতুর আসলে কোন তুলনা হয় না, শহরে বর্ষা আমাদের বিভিন্ন নাগরিক যন্ত্রণা দিলেও গ্রাম-বাংলার স্বাভাবিক বর্ষা আসলেই অসাধারন। বিছানাকান্দি, পান্তুমাই অথবা রাতারগুলের উপলক্ষে দীর্ঘদিন পরে আমরা এই রকম ঘনবরষার রূপ দেখতে পাই। এই বর্ষার রূপ আসলে শুধু অনুভব করা যায় কিন্তু এই অনুভবকে ভাষায় প্রকাশ করা সত্যই কঠিন, অনেকে হয়ত পারেন কিন্তু আমার এই দুর্বল লেখনিতে (কীবোর্ডে) কখনোই সম্ভব না।
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =



সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:৩১
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×