আমি যে মুহুর্ত থেকে প্রথম শুনতে শুরু করেছিলাম, আমার আজো মনে আছে সেই মুহুর্তটির কথা। ভীষণ চমকে উঠেছিলাম। কী জোরালো সেই শব্দ!
ধুকপুক! ধুকপুক! ধুকপুক!--------
একটানা------
বিরামহীন------
অভূতপূর্ব এক ছন্দে-------
কী গুরুগম্ভীর সে আওয়াজ! আমার ছোট বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আর আমি শিউরে উঠছিলাম বারবার।
এভাবে কতক্ষণ চলছিল জানি না। হঠাৎ শুনতে পেলাম সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি আওয়াজ। আমার ভয় কেটে গেল। ভাল লাগতে শুরু করল। কী মধুর সেই শব্দ---আমার সো-না বাবুটা।
ধীর!
মোলায়েম !
আশা জাগানিয়া!
সে অভয়বাণী আমাকে সাহস জোগালো। ধীরে ধীরে সে আমাকে চিনতে শেখালো - আমি চিনলাম সে আমার মা। বলত সে, আমি তোর মা, দুষ্টু ছেলে। আমাকে এত ব্যথা দিস কেন? ছি, মাকে এভাবে কেউ মারে! থামবি না? আমি কিন্তু বকে দেব তোকে। দেখ দামাল ছেলের পাকামো। একটুও যদি কথা শোনে। আজ আসুক তোর বাবা। বলে দেব তাকে। তোকে অনেক বকা দেবে, দেখিস। সে কিন্তু আমাকে অনেক ভালবাসে বুঝলি?
বুঝি তো। বাবা মাকে অনেক ভালবাসেন। মাঝেমাঝেই মাকে অনেক আদর করেন। আমি মায়ের খুশি, আনন্দ ঠিকঠিক বুঝে ফেলি।
বাবা মাঝেমাঝেই আমার শরীরে কান পাতেন, মাথা রাখেন। আমি আমার ছোট্ট দুপায়ে ঠুক করে লাথি লাগালে খুব খুশি হন। বলেন, দেখো এটা ঠিক মেসি হবে। আর মা কাতরে ওঠেন, উহ! তারপর আমাকে বলেন, বাবা-না? বাবাকে লাথি মারতে নেই। মা ব্যথা পায়তো।
মা যে কী, আমি বুঝতাম না। কিন্তু মায়ের মুখে শুনতে শুনতেই আমি বুঝে ফেললাম মায়ের মানে। জেনে ফেললাম বাবা আমার কী হন, আমি তাদের কী হই, তারা আমাকে কতখানি ভালবাসেন। আমার সাহস বাড়তে লাগল। আমি দিনেদিনে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে লাগলাম। আরও বেশি পরিণত। আরও বেশি প্রাজ্ঞ। এখন আমি ধুকপুকানি ভয় পাই না। জানি, ওট আশ্বাসঃ মায়ের বুক থেকে আসে।
মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতেই আমি চিনে ফেললাম পৃথিবীটাকে। তার মুখে শুনতে শুনতেই আমি যেন দেখে ফেললাম পৃথিবীর মুখ। পৃথিবীটাকে আমি আপন ভাবতে শুরু করলাম, ভালবাসতে শিখলাম। মায়ের মুখে শুনতে শুনতে এখন আমি অনেক কিছু চিনি। অনেক কিছু বুঝি। এখন আমার অনেক বুদ্ধি।
মা আমাকে কত নামে যে ডাকে – কখনো সোনামনি, মামনি, বাবামনি; কখনো বাবুটা, আম্মুটা, আব্বুটা; কখনো লক্ষিমেয়ে, মিষ্টি মেয়ে, দুষ্টু মেয়ে; রেগে গেলে, এই পাজি ছেলে। মায়ের এই ডাকগুলি আমার কাছে ভাল-ভাল লাগে। মিষ্টি -মিষ্টি লাগে। অ-নে-ক মজা-মজা লাগে।
কদিন থেকে মায়ের মন ভাল নেই। বাবাকে নিয়ে খুব টেনশনে থাকেন। বাবা ছোট্ট একটা চাকরি করেন। প্রতিদিন সকালে বের হয়ে রাতে ফেরেন। বাবা ঘরে ফিরলে আমি টের পেয়ে যাই। মা যখন বলেন, এই, তোর বাবা এসেছে; মায়ের খুশি খুশি ভাব আর স্বস্তিতে আমিও খুশি পাই খুব। যাক খারাপ লোকেরা আমার বাবাকে ধরতে পারেনি। মা বলেছে, কিছু হিংস্র পশুমানুষ পেট্রোল বোমা মেরে গাড়ি, গাড়িভরা মানুষ পুড়িয়ে দিচ্ছে। আর সাথে সাথে পুড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বপ্ন। বাংলাদেশের আশা। মা অনেক বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বলেন, আহারে! মায়ের সাথে সাথে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। আমিও শ্বাস ছেড়ে বলি, আহারে!
বাবা ফিরে এলে আমার অনেক আনন্দ হয়। বাবাকে ওরা পুড়িয়ে দিতে পারেনি। বাবা এসেই মাকে জড়িয়ে ধরেন। মা খুব লজ্জা পানঃ আহ, ছাড়ো। তারপর বাবা আমার কথা জিজ্ঞেস করেন, আমাদের বাবুটা কেমন আছে গো? মা বলেন, আল্লাহর রহমতে ভালই আছে। আমাকে সারাদিন জ্বালিয়ে মেরেছে।
আমি বাবার আদর খাওয়ার জন্য নড়েচড়ে উঠি। মা কাতরে ওঠেন, ঐ দেখো, আবার শুরু হল। উহ---
বাবা আস্তে করে মাকে শুইয়ে দেন। ডাক্তারের কাছে আবার কবে চেকআপের জন্য যেতে হবে, জানতে চান। তারপর আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেনঃ এই বিচ্ছু, মাকে এভাবে ব্যথা দিস কেন? আর কটা দিন, তারপর তোকে আমি মজা দেখাব।
আমি হেসে ফেলি। জানি তো বাবা আমাকে কী করবে। আমাকে সে কতবার বলেছে। আমাকে কোলে নেবে। ঘাড়ে-পিঠে-বুকে নেবে। আমার জন্য সে ঘোড়া হবে। ঘোড়া নাকি অনেক সুন্দর। জোরে জোরে দৌড়ায়।
ইস আর কতদিন। আমার আর ধৈর্য ধরে না।
মা যে আমার সাথে সারাদিন কত কথা বলে। দাদী মাঝেমাঝে বকেন, ও বৌ, তুমি একলা একলা কার লগে কতা কও? মা লজ্জা পায় – একা একা বলি নাতো, মা। ওর সাথে বলি। আমাকে দেখিয়ে মা জবাব দেন।
পাগল আর কারে কয়! দাদী বলেন।
তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন, তোমার শরীলের অবস্থা কি? নরম নরম ঠেকতাছে! কিছু ভাঙতাছে নাকি?
না, মা। তবে কেমন যেন লাগতেছে।
হুম, সময় ঘনাইতাছে। সাবধানে থাক বৌ। সন্ধ্যায় বারান্দায় যাইও না। বাতাস-টাতাস লাগতে পারে।
দাদী তার নিজের ঘরে চলে গেলে মা আবার আমার সাথে কথা বলতে শুরু করে। মা আমার সাথে যত কথা বলে আমি তত খুশি পাই। মা আমাকে অনেক ভালবাসে, আমি বুঝিতো। আমিও মাকে কত ভালবাসি।
মা আরও নরম হয়ে পড়ল। দাদী বারবার বাবাকে ছুটি নিতে বলতে লাগলেন। বাবা আজকে ছুটি নিতে পেরেছেন। মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন। সময় নাকি হয়ে এসেছে। আমাকে আর বেশি ধৈর্য ধরতে হবে না। আমার খুব খুশি-খুশি লাগে। হাত-পা ছড়িয়ে আমি আড়মোড়া ভাঙি। মা কঁকিয়ে ওঠে। বাবা মাকে ধরে ধীরে ধীরে গাড়িতে তোলেন। গাড়ি চলতে শুরু করে। আমি সব কিছু টের পাই। গাড়ির গর-গর আওয়াজ, প্যাঁ-পুঁ, পিঁ-পিঁ স-ব ....।
কিন্তু আমার গাড়ির শব্দ ভাল্লাগে না। মায়ের কথা ভাল্লাগে। দাদী বলেন, গুটুর-গুটুর। আমার সেটাই পছন্দ। আমার মায়ের গুটুর-গুটুর।
গাড়িতে ওঠার পরে মা একটা কথাও বলেনি। বাবাও না। উহ, সবাই এত চুপচাপ কেন? শুধু গাড়ির গরগর! গাড়ির শব্দ আমার পছন্দ না। আমার পছন্দ মায়ের গুটুর-গুটুর! বাবার গমগম আওয়াজঃ সাহানা, সাহানা।
ইস এত চিৎকার চ্যাঁচামেচি কেন? মা, তুমি কাঁদছ কেন? বাবা? বাবা? আমার এত গরম লাগছে কেন? উহ, আমি পুড়ে যাচ্ছি। মা? মা?
পেট্রোল বোমায় পুড়ে যাওয়া বাসটি থেকে জড়াজড়ি করে থাকা দুটি লাশ নামানো হল – একটি পুরুষ, আরেকটি মহিলা। পোড়া মাংসের গন্ধ এড়াতে লোকজন নাকে রুমাল চেপে লাশদুটি ঘিরে দাঁড়াল। নানা রকম মন্তব্য, চেনা-অচেনার প্রশ্ন, রাজনীতির বর্বর নেতানেত্রিদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ; স-ব, স-ব ছাপিয়ে হঠাৎ বিমূঢ়তার একটি বেমক্কা ধাক্কা লোকজনের বুকে গিয়ে লাগলে সবাই চোখে পলক ফেলতে পর্যন্ত ভুলে গেল। দগ্ধ নারীটির পুড়ে গলে যাওয়া পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি হাত! ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র অথচ মুষ্টিবদ্ধ একটি হাত!