বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান ও তুরস্ক অসন্তোষ প্রকাশের পরপরই ভারত আবারও এ বিচারের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশে এ বিচার নিয়ে নাক গলানো বিদেশিদের দিকে ইঙ্গিত করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ গত বৃহস্পতিবার রাতে বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিচারের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতিও ভারতের সমর্থন রয়েছে।’
যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ায় ভারতের সমর্থন নতুন নয়। এর পরও সাম্প্রতিক সময়ে মানবতাবিরোধী চিহ্নিত বড় অপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা নিয়ে দু-একটি দেশের উষ্মার বিষয়টি ভারতের নজর কেড়েছে। সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র মতে, এ বিচারকে বাংলাদেশ যে তার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলছে সে বিষয়েও নিকটতম প্রতিবেশী ভারত একমত পোষণ করে। তাই এ বিচার নিয়ে দু-একটি দেশ যখন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তখন ভারত বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েই অন্যদের বার্তা দিতে চেয়েছে। এ বিচার নিয়ে বাইরের কেউ নাক গলাক তা ভারত পছন্দ করছে না।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে দু-একটি দেশের অপতৎপরতা, বিশেষ করে দোষী প্রমাণিত হওয়া অপরাধীদের ফাঁসি না দিতে আকুতি এবং সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে উগ্রবাদী হামলায় পশ্চিমা কিছু দেশের উদ্বেগের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ড. এস জয়শঙ্কর গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকা সফর করেন। এ সফরকালে তিনি বর্তমান সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির আস্থা ও সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তাঁর ঢাকায় অবস্থানের সময়ই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রতিবাদে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব তাঁর ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিন সকালে সোনারগাঁও হোটেলে নাগরিকসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠকের সময়ও এ বিচারের প্রসঙ্গ উঠেছিল। সেখানে একজন প্রতিনিধি জানতে চান, পাকিস্তানি ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচারে বাংলাদেশ ভারতের সহযোগিতা চাইলে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? এর জবাবে ভারতীয় পক্ষ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখার কথা জানিয়েছে। নাগরিকসমাজের প্রতিনিধিরা পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে গুরুত্ব দিয়েছেন। http://goo.gl/klBsQH
১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে জানতে চাইবে বাংলাদেশ : এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল শুক্রবার ঢাকায় নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে ফিরিয়ে নিয়ে পাকিস্তান কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানতে চাইবে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের হয়ে পাকিস্তানের সামপ্রতিক তৎপরতায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশ নতুন করে ভাবছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অনেক দূর এগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় এসেছে। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাকে বিচারের আশ্বাসে নিজেদের জিম্মায় নিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান তাদের বিচার করবে—এ জন্য ওই যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানের জিম্মায় দেওয়া হয়েছিল, ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়। এখন আমরা জানতে চাইব, বিচার হলো না কেন বা হচ্ছে না কেন?’
বাংলাদেশ বারবার প্রতিবাদ জানানো সত্ত্বেও পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে। পাকিস্তানের সর্বশেষ ভূমিকার পর দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কোনো বন্ধু রাষ্ট্র এর বিরোধিতা করতে পারে না। তারা যেহেতু অব্যাহতভাবে বিরোধিতা করছে সেহেতু সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।’
এই বিচারের বিরোধিতাকারী তুরস্ক আর পাকিস্তান এক নয় বলে মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের কথা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনোভাবেই ঢাকাকে জানানো হয়নি। তুরস্ক দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার কথা এবং তাঁর অবর্তমানে কে দায়িত্ব পালন করবেন সে কথাও জানানো হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের খবর পরিবেশন করলেও তুরস্কের সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, পরামর্শের জন্য ঢাকা থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে আংকারায় ডাকা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর যে অভিযোগ এনেছে, সে প্রসঙ্গে ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, এটি নাক গলানোর বিষয় নয়। পাকিস্তানি মুখপাত্রের দাবি, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার পাকিস্তান তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের বিষয়। কারণ যাদের বিচার করা হচ্ছে তারা ‘ভদ্রলোক’।