নচিকেতার একটি গানের কিছু অংশ দিয়েই শুরু করতে হচ্ছে লেখাটি-
‘... মন্ত্রীরা সব হারামজাদা, আস্ত বদের ধাড়ি, তুড়ুক নাচে, মন্ত্রিসভা এখন বাঈজী বাড়ি। আজকে যিনি কয়লা মন্ত্রী- কালকে তিনি শিক্ষা, তাই, কয়লা কালো শিক্ষা নিয়ে মানুষ করে ভিক্ষা। আর মানুষ শালাও মাথা মোটা, ভোট দিতে যায় নেচে, দেশের মানুষ তো কোন ছার, মন্ত্রী গুলো কুলাঙ্গার; ভালো দাম পেলে এরা বাপকেও দেবে বেচে...’
গানটি ভারতীয় প্রেক্ষাপট ও সেখানকার মন্ত্রীদের নিয়ে লেখা। মূলত নচিকেতার মনে ব্যাপক ধরনের অসন্তোষ আসার জন্যই তিনি এই গানটি লিখেছেন। এবার ভেবে দেখার বিষয়-যে দেশে একটি বড় ধরনের রেল দূর্ঘটনা ঘটলেই মন্ত্রীমহোদয় পদত্যাগ করেন, দেশের মধ্যে কোন গোলযোগ বা খারাপ কিছু ঘটলে নিজ দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পদত্যাগ করার মানসিকতা রাখেন। সেই দেশের শিল্পী এই রকম একটি গান গাইতে পারেন। অথচ আমাদের দেশে এক সময় জনৈক মন্ত্রী টাকার বস্তা নিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়বার পরও তিনি পদত্যাগ তো দূরের কথা, দফতরবিহীন মন্ত্রী নামের একটি হাস্যকর পদেও থাকবার মতো লজ্জাহীন হতে পারেন। সাভারের ভয়াবহ দূর্ঘটনার পর আমাদের মহামতী একজন মন্ত্রীর মুখের কথায় সারা বাংলাদেশের জনসাধারণ অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। কিন্তু উনার কোন বোধদয় হয়নি। সোনালী ব্যাংকের বিপুল টাকা হতাহতের পরও আরেক বিজ্ঞমন্ত্রীর অন্তরদগ্ধকর বাণী আমাদের সবারই মনে আছে। কিন্তু উনারা এরপরও স্বপদে বহাল থেকেছেন। শুধু বহালই থাকেননি, নিজের যোগ্যতার সাথে এই সব উক্তি আরো একটু জৌলুস এনে দিয়েছে। কোন লজ্জার আবরণ উনাদের চোখে মুখে প্রত্যক্ষ করা যায়নি। আমাদের দেশের সংস্কৃতিই এইরকম। এই মুহূর্তে দেশের সংগীত শিল্পী, কবিতা, লেখকগণের ভূমিকা কি? কেন নচিকেতার মতো কোন কণ্ঠ গেয়ে উঠে না প্রকৃতসত্য নিয়ে কোন উচ্চারণ? নাকি আমরা জাতি হিসেবে সবসময় সর্বোচ্চ সন্তুষ্টিতে ভুগি? এটা অনেক অংশে একদম সত্য। জাতি হিসেবে আমরা সব সময় স্যাটিসফিকশন সাথে নিয়ে ঘুরি। এ প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেলো। সেই বন্ধু কথায় কথায় একবার বলেছিলো- ‘ট্রেন জার্নিটা আমার কাছে খুবই আরামের’। একথা শোনার পর বাঙালী সম্পর্কে আমার ধারনাটা নতুন ভাবে জন্ম নিয়েছে। সেই বন্ধুর সাথে কয়েকমাস আগে আমি একবার ট্রেনযোগে ঢাকা যাই। ষ্টেশনে রাত্রি এগারটায় ট্রেন ছাড়বার কথা। প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি। রাজনৈতিক সমস্যার জন্য ট্রেন বিলম্ব। প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত শত শত যাত্রি প্লাটফর্মে নির্ঘুম অপেক্ষা করে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ট্রেন এসে পৌঁছলো রাত্রি আড়াইটার দিকে! সেই ট্রেনে ঢাকা যেতে আমাদের প্রায় তের ঘন্টা সময় লেগে গিয়েছিলো। ঢাকা থেকে ফিরবার সময় আমাদের সময় লেগেছিলো প্রায় সতের ঘন্টা! মাত্র আড়াইশত কিলোমিটারের একটু বেশি রাস্তা যেতে আমাদের এই অবস্থা। অবশ্য সেবার রাজনৈতিক গোলযোগের জন্যই এতো বেশি সময় লেগেছিলো। আমাদের বাংলাদেশ রেলওয়ে মোটেও অতো ধীরগতি সম্পন্ন নয়। স্বাভাবিক সময়ে এই আড়াইশ কিলোমিটার রাস্তা যেতে প্রায় ছয় ঘন্টা লাগে আমাদের ট্রেনের। আর ভাড়া! মাত্র তিনশ পনের টাকা। আমাদের দেশের জনসাধারণের পকেটের অবস্থা নিশ্চয় অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক ভালো, নইলে এই অস্বাভাবিক ভাড়া কেন? ভারতের ট্রেনগুলো প্রায় আটশত কিলোমিটার যায় মাত্র পাঁচ/ছয় ঘন্টায়। ভাড়া মাত্র একশত পঞ্চাশের বেশি নয়। তারপরও সেদেশের মানুষের মধ্যে মাঝে মধ্যেই ট্রেনের সেবা নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। অথচ আমাদের দেশে আমার বন্ধু একবাক্যে বলে উঠে- ট্রেন জার্নিটা খুব আরামের! কিন্তু অন্যান্য প্রগতিশীল দেশে বনধ, বিপ্লব, অনশন লেগেই থাকে। আমাদের দেশের এক ধাক্কায় ট্রেনের ভাড়া দ্বিগুণ বেশি করা হলো- এতো কোন রাজতৈনিক দল, সুশিল সমাজসহ কারো কোন মাথা ব্যথা দেখলাম না। কেন দেখলাম না সেটা নিয়ে আলোচনা করবার জন্য আমাদের কোন সুস্থ্য প্লার্টফরম নেই। টিভিতে দুপুররাত পর্যন্ত মুখে ফেনা তুলে দেয়া টকশো অবশ্যই এসব নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করতে আগ্রহী নয়।
সবশেষে আমার কাছে মনে হয়েছে, কবি, লেখক, কলামিস্ট, শিল্পী ও সুশিল সমাজের লোকদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু উনাদের বেশির ভাগই ফেসবুক নামের একটা জগা-খিচুড়ি মার্কা জগতেই বেশি বিচরণ করেন। চরম সন্তুষ্টিজনক মনে কিছু একটা লিখে- ডজন ডজন লোকের গায়ে পিন দিয়ে আঁটকে (ট্যাগ) দেন, ব্যথায় সম্বিত ফিরে পেয়েও যেন উনার লেখায় একটি লাইক দিয়ে যান! এই রকম হতে থাকলে আমাদের অচিরেই পথে বসতে হবে। একসময় নচিকেতার গান শুনতেও ভালো লাগবে না। কারণ কারো কারো কাছে আঙ্গুরফল টক!