সারা বাড়ি তোলপাড় করে ফেলার পর ও যখন চম্পাকলি তাদের বিয়ের কাবিননামা খুঁজে পেল না। তখন আর চম্পাকলির বুঝতে বাকি রইল না যে, এর মধ্যে গভীর কোন রহস্য আছে। আর সেটা না হলে তার কাবিনামা লাপাত্তা হল কি ভাবে?
তাহলে তার স্বামী মানে মতলব মিয়ার কি অন্য কোন মতলব আছে?
আর সে রকম যদি কিছু হয়েও থাকে তাহলে এটা তার বুদ্ধি না। এর পিছনে অন্য কেউ আছে। আর যায় হোক তার স্বামীর মুন্ডতে এত সার নেই যে, সে কাবিননামা গুম করে তাকে কোন ফাঁদে ফেলবে বা অন্য কোন ফন্দিফিকির করবে। মতলব মিয়া মোটে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছে, সে কোন মতে তার নাম লিখতে পারে আর সেইটা লিখতেও সময় লাগে প্রায় দুই মিনিট। তার কাছে কাবিননামা মানে হল শুধু একটা কাগজ। তবে চম্পাকলি জানে কাবিননামার কী গুরুত্ত। সে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। তার বিদ্যার জোর তার স্বামীর থেকে ঢের বেশি।
দুপুরে মতলব মিয়া বাড়ি খাবার খেতে এলো মাঠ থেকে। হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে বসতে না বসতে চম্পাকলি হাজির হল তার স্বামীর সামনে। তার স্বামী কিছু একটা কথা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু চম্পাকলি সেটা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলো
- মতলব মিয়া আপনার বিয়ের কাবিননামা কোথায় ?
মতলব মিয়া প্রশ্ন শুনে কিছুটা ভড়কে গেল
- কাবিননামা কি !?
চম্পাকলি এবার পুরাই খিঁচিয়ে বলে উঠলো
- সাদি মোবারক করার সময় যে কাগজে দুইডা কলম ভেঙে নিজের নাম লিখে ছিলেন সেই কাগজটার নাম কাবিননামা। এখন বলেন সেটা কোথায়? বিয়ের ছয় মাস পার হতে না হতে আর একটা বিয়ে করার ফন্দি করতেছ না? ঝাটাপিটা করে তোমার মাজা ভেঙে দিবো।
মতলব মিয়া তার বউ এই হুমকি শুনতে শুনতে ঘাড়ের গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে শুরু করে দিলো। চম্পাকলি এবার ঘাড়ের গামছা প্যাঁচ দিয়ে মতলব মিয়ার গলা এটে ধরলো। সাথে আবার ও একই প্রশ্ন
কাবিননামা কোথায়?
মতলব মিয়া বহুত কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে শেষ বলল যে, সে কোন এক কাগজের ভাঁজে রেখেছে কিন্তু সেটা এখন কোন কাগজের ভাঁজে মনে করতে পারছেনা। চম্পাকলি আবার ও তাকে হুমকি দিলো সে যদি কাবিননামা খুঁজে না পায় তাহলে তার ঝাটার বাড়ি খাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এতপর একদিন গেল দুইদিন গেল আর ও কত দিন গেল চম্পাকলি আর মতলব মিয়া কোন জায়গায় খুঁজে পেল না সেই কাবিননামা। মতলব মিয়া তো ঝাটার বাড়ি খাওয়ার ভয়ে ভয়ে সব জায়গায় তল্লাশি করতে লাগবো। পুরাতন ট্যাংক, জমির সব দলিল এর ভাঁজে ভাঁজে, আজেবাজে সব কাগজের ভাঁজে কিন্তু কোন ভাবেই পাওয়া গেল না সেই রঙিন কাগজ।
এই কাবিননামা খোঁজাখুঁজির মাঝে চম্পাকলি গোপনে সংবাদ নিতে লাগলো মতলব মিয়ার অন্য কারো সাথে নতুন করে ভাব হয়েছে কী না। কিন্তু সেই দিক থেকে ও কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। যদি ও চম্পাকলি জানে তার স্বামী কে অন্য কোন মেয়ে পছন্দ করবে না। শুধু অন্য মেয়ে না সে নিজে ও তার স্বামীকে পছন্দ করে না। তার বাপের ইচ্ছাতে শুধু মাত্র তাদের বিয়ে হয়েছে।
প্রথম যে দিন মতলব মিয়ার তাকে ঘটা করে দেখতে গিয়েছিল সেই দিনই তাকে বাতিলের খাতায় রেখেছিল কিন্তু বাপের গোঁ ধরার কাছে তার “না” পাত্তা পায়নি।
তাকে দেখার পর পরিবারে সবার একই মত ছিল ঐ রকম একটা ভাবাগোবা ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু তাঁর বাবা কারো কথা না শুনে তাকে বিয়ে দিয়ে দিলো।
মতলব মিয়াকে দেখে তাঁর পাশের বাড়ির চাচা বলেই ফেলেছিল
- ছেলের গায়ের রং কত কালো। আর যে ছেলে নিজের বিয়ের কন্যা দেখতে এসে তার মায়ের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত একটা মিস্টি ও মুখে দেয় না সেই ছেলে দিয়ে কোন কাম হইবো না।
তার নিজের মামা বলেছিল তাঁর আব্বা কে
-দুলাভাই আমার পাত্র পছন্দ হয়নি। ছেলে পাত্রী দেখতে এসেছে লুঙ্গী পরে, চুলের সরিষার তেল দেওয়া আর বাজারের গজ কাপড়ের একটা জঙ্গলি ছাপার র্শাট পরা। এ ছেলে মোটেও স্মার্ট না। আমাদের চম্পাকলির জন্য দরকার রুপসী সিনেমা হলের ঐ টিকিট ছেঁড়া পুলাডার মত। সেই পুলা কত স্মার্ট। সেই পুলা ও চুলে তেল দেয় তবে তার চুলে এমন ন্যাতায় পড়ে না। তার চুল তো দেখি শজারু কাঁটার মত খাঁড়াখাঁড়া হইয়া থাকে।
কিন্তু না তাঁর বাবা কারো কথা শুনলো না। তাঁর বাবার এক কথা। ছেলে ভাল, অনেক জমিজাতি আছে, গ্রামে মধ্যে মানিলোক তারা। আর কোথায় ছেলে কালো ? ছেলের গায়ের রং একটু কম। তার বাবা কোন ভাবেই কালো রং এর মানুষ কে কালো বলে না বলে “গায়ের রং একটু কম”।
চম্পাকলি যখন আর কোন ভাবে কাবিননামার আর হদিস পেল না তখন শেষ বারের মত তার স্বামীকে হুমকি দিলো “এক সপ্তাহের মধ্যে যদি কাবিননামার নকল কাগজ না তুলে এনে দিয়েছে চম্পাকলির হাতে, তাহলে ঝাটার বাড়ির গল্প এবার সত্যি হবে”।
মতলব মিয়া জানে তার বউ খুবই জল্লাদ আর তার পক্ষে অসম্ভব কিছু না স্বামীকে ঝাটাপিটা করা। তাই তিনি তদবির করতে লাগলেন কিভাবে সাতদিনের মধ্যে বিয়ের কাগজ তোলা যায়।
মতলব মিয়াকে হুমকি দেওয়ার সাত দিন পার হবার আগেই চম্পাকলি রান্না ঘরে খুঁজে পেল হাফবস্তা বাতিল জিনিসপত্র। কি মনে করে চম্পাকলি সেই বস্তার সব জিনিস নামিয়ে খোঁজ করতে লাগলো তার কাঙ্ক্ষিত কাগজটা। আর অবশেষে পেয়ে ও গেল সেই কাঙ্ক্ষিত কাগজ একটা বাতিল
জুতা বাক্স এর মধ্যে। এই বস্তা আর ও মাস খানিক আগে রান্না ঘরে রাখা হয়েছিল চুলা জ্বালানোর জন্য। আর সেই বস্তা রান্না ঘর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এসেছিল মতলব মিয়া নিজে। চম্পাকলি কাবিননামা হাতে নিয়ে মনে মনে বলল
“আজ রাতে তুমি ঝাটার বাড়ি খাবা মতলব মিয়া”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার আগেই মতলব মিয়া আর তার দুই রাখাল গরু সহ বাড়ী ফিরে এলো। চম্পাকলি কিছুই বলল না। সে শুধু অপেক্ষা করছে রাতটা হবার জন্য।
চম্পাকলি রাতের খাওয়ার পর সব কাজ গুছিয়ে ঘরে এসে দেখলো মতলব মিয়া খাটে বসে কানের কাছে তার ছোট লাল রেডিও নিয়ে পল্লীগীতি গান শুনছে।
চম্পাকলি কাবিননামা হাতে নিয়ে তার স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চম্পাকলির হাতে রঙিন কাগজ দেখে মতলব মিয়া প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো
-বউ পেয়েছিস বিয়ের কাগজ ?
চম্পাকলি সেই রাক্ষাসী মত চেহারা করে বলল
-রান্না ঘরে যখন এই বস্তা রেখে এসেছিলে তখন একবার ও আমার ঝাটার বাড়ির কথা মনে পড়েনি তোমার ?
- বিয়ের কাগজ তো পেয়ে গেছিস এখন কোন আবার এই কথা বলছিস তুই ?
- মতলব মিয়া তুমি আর একটা বিয়ে করার মতলব করবা আর আমি বসে বসে দেখবো না ? চম্পাকলি সেই রকম মেয়ে না বুঝলে মতলব মিয়া। আজ তোমার আর একটা বিয়ে করার সাধ আমি মিটিয়ে দেবো।
-আমি কবে বললাম আর একটা বিয়ে করবো ? এক বিয়ে করে নিত্য জ্বলে পুড়ে মরছি। আবার আর একটা !
চম্পাকলি এবার পুরাই ক্ষেপে উঠলো
-কি এত বড় কথা ! আমাকে বিয়ে করে তুমি জ্বলে পুড়ে মরছো। এত বড় কথা !! আজ তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না আমার হাত থেকে।
চম্পাকলির এই ডাইনীর রুপ দেখে মতলব মিয়া কান্দতে শুরু করলো নিঃশব্দে খাটের এক কোণায় গোটমোট হয়ে। কারন সে বুঝতে পেরেছে এখন আর সে বাঁচতে পারবে না এই ডাইনীর হাত থেকে। এই ছয় মাসে তার এইটুকু বোঝা হয়ে গেছে।
চম্পাকলি রাগের মাথায় খুঁজতে লাগলো মারার জন্য কিছু একটা। আর হাতের কাছে পেয়ে ও গেল বিছানা ঝাড়ার শলার নতুন ঝাটা খানা। চম্পাকলি এই রাগের মাথায় ও হিসাব করলো কোথায় মারলে সে, ঐ মারের দাগ কাওকে দেখাতে পারবে না লজ্জায়।
শলার ঝাটা হাতে নিতে দেখে মতলব মিয়া এবার শব্দ করে কান্দতে শুরু করলো। আর চম্পাকলি সেই ঝাটা দিয়ে মতলব মিয়া পশ্চাদ্দেশে উপর দিতে লাগলো সপাং সপাং করে বাড়ি।
এরপর মতলব মিয়া কী অবস্তা হল-
সেটা না হয় আমরা আর একদিন শুনবো।
------------------