টমেটো যুদ্ধ স্প্যানিশ ভাষায় যাকে বলে “লা তমাতিনা”। এটা বিশ্বের বৃহত্তম ‘ফুড ফাইট’ বা খাবারের যুদ্ধ। প্রতি বছর আগস্টের শেষ বুধবার স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী এই অনুষ্ঠানটি। শুরু হয়েছিল প্রথম ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে। ভূমধ্য সাগরের বলা যায় প্রায় কোলের মধ্যে অন্যমত একটা শহর “বুনিয়ল”। স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া প্রদেশের স্বায়ত্তশাসিত এই এলাকা এমনিতেই নিজস্ব সংস্কৃতিতে বিশিষ্টে ভরপুর। তবে, টমেটোর লড়াই ছাপিয়ে গেছে সেই সব ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি কে।
এখনকার রীতি অনুসারে আগস্টের শেষ সপ্তাহজুড়ে সাংস্কৃতিক উত্সব চলে বুনিয়ল শহরে। কিন্তু উত্সবের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই টমেটোর লড়াই। দুনিয়াজোড়া পরিচিতি পাওয়া এই টমেটো লড়াইয়ের নাম ‘লা তমাতিনা’ (এটা স্পেনের দাপ্তরিক নাম)। প্রতিবছর আগস্টের শেষ বুধবার সকালে এই টমেটো লড়াই শুরু হয় আর মাত্র এক ঘণ্টা চলে এই লড়াই।
লা তমাতিনার ইতিকথাঃ
শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে দৈত্য-দানো আর বড় বড় মাথার মুখোশধারীরা। বাদ্য বাজনা বাজিয়ে নেচেগেয়ে চলতে থাকা মাপেটের মিছিলে শামিল হতে চায় ছেলেপুলেরাও। মিছিলে ঢুকতে বন্ধুদের সঙ্গে হুড়োহুড়িতে পা পিছলে চিতপটাং এক কিশোর। পা পিছলে গেল বলে ঠাট্টা-তামাশা! অভিমানে ফেটে গিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছে তার দিকেই খ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে যাচ্ছে সে। মানুষজনও কম যায় না! সবাই মিলে লেগে গেল বিশাল হুল্লোড়। পাশেই ছিল এক সবজির দোকান। ভ্যানভর্তি টমেটো! মুহূর্তের মধ্যেই টমেটোগুলো সব আকাশে উড়তে লাগল যেন! সবাই একে অন্যের দিকে টমেটো ছুড়ে মারছে! কি দোকানি, কি বাজারি, কি পথচারী, সবাই টমেটোর রঙে-রসে লালে-ছালে মাখামাখি। শহরের কোতোয়াল আসার পরই কেবল সেই টমেটো ছোড়াছুড়ি থামল। লোকজনও ততক্ষণে ক্লান্ত। কিন্তু কী নিয়ে যে এই গোলমালটা শুরু হয়েছিল, তা যেন কারোরই খেয়াল নেই, হট্টগোল শেষ, কিন্তু কোনো হার-জিত নেই!
কাহিনিটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু না পরের বছর আবারও দৈত্য-দানো বড় মাথার মুখোশ মিছিলে ঢুকে পড়ল ডানপিটে ছেলের দল। এবার বস্তা বস্তা টমেটো ওরা নিয়ে এসেছে বাড়ি থেকেই। আর লোকজন যদি ঝগড়া করতে না আসে তাহলে আর কী করা! নিজেরা নিজেরাই ঝগড়া বাধিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু। মানুষ টমেটো ছুড়ে মারছে আর পথের ধারে বস্তাভর্তি টমেটো পড়ে থাকবে, এটা কেমন কথা!। সবাই হাত লাগাল সেই বস্তাভর্তি টমেটো শেষ করতেই! এবারও এল শহর কোতোয়াল। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই কারও অভিযোগ না থাকলে কোতোয়ালের কাজটা কী? রাশভারী কোতোয়ালরা শাসাল বাজারসুদ্ধ লোকজনকে। আর বলে গেল, ফের এমন ঘটলে সবাইকেই জেলের ঘানি টানতে হবে। কিন্তু পরের বছরও ঘটল একই ঘটনা। এবার লোকজনের প্রস্তুতি আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি। এভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রতিবছরই একটু একটু করে জমে উঠতে শুরু করল কাহিনিটা।
“লা তমাতিনার” শুরুর কাহিনি হিসেবে এই গল্পটাই সবচেয়ে বেশি চালু স্থানীয় লোকজনের মাঝে। তবে এ ছাড়াও আরও দু-তিনটি গল্প শুনতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, মাপেটের মিছিলে কোনো এক বাজে গায়ককে উদ্দেশ্য করে টমেটো ছুড়ে মারা থেকে। কেউ বলেন, টাউনহলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে বিবাদে শহরের লোকেরা টমেটো ছুড়ে মারতে থাকলে এই ঘটনা ঘটেছিল। আবার কারও মতে, টমেটো বোঝাই একটা লরি রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে গেলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে ওই টমেটো লড়াই শুরু হয়েছিল। কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই-ই একমত, শহরের কোতোয়াল এসেই লড়াই থামিয়েছিল এবং পরের বছর শহরবাসী নিজেরাই এই লড়াইয়ে উত্সাহী ছিল।
টমেটো যুদ্ধ দিনে শুরু হয় যে ভাবেঃ
বেলা ১১ টায় বুনিয়লের শহরকেন্দ্র প্লাজা ডেল পুয়েবলোয় এসে জড়ো হয় পেকে টুমটুমা টমেটো ভর্তি ট্রাকের সারি। শহরকেন্দ্রের চত্বরে রাখা থাকে দোতলা সমান উঁচু একটা গ্রিজ মাখানো কাঠের থাম। ওই থামের শিখরে রাখা থাকে একটা হ্যাম (মাংসজাত খাবার)। আনুষ্ঠানিকতা অনুযায়ী কোনো এক সাহসী প্রাণ ওই তৈলাক্ত থাম বেয়ে শিখর থেকে হ্যামটা জিতে না নেওয়া পর্যন্ত এই টমেটো লড়াই শুরু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা কখনোই হয় না! বরং টাউন হল থেকে ছোড়া জলকামানের জলদ গম্ভীর গোলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় এই মহা হুল্লোড়।
অংশগ্রহণকারী লোকজনের সবাইকে চোখ বাঁচানোর জন্য গোগলস পরে আসার পরামর্শ দিয়ে থাকে শহর কর্তৃপক্ষ। আর টমেটো তা যত পাকাই হোক, অন্যের দিকে ছুড়ে মারার আগে তা অবশ্যই হাতের চাপে চ্যাপটা করে নিতে হবে, যাতে কেউ ব্যথা না পায়। সঙ্গে কোনো পানির বোতল বা গ্লাস আনা যাবে না। আর নারী বা পুরুষ কারও শার্ট, টি-শার্ট জামা ছেঁড়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে লড়াইয়ের ময়দানে এই শেষ নিষেধটি কেউই যে মানেন না।
টমেটো লড়াই শুরুর ঠিক এক ঘণ্টা পর আবারও শোনা যাবে জল কামানের গর্জন। আর তক্ষুনি শেষ লড়াই। এরপর আর কেউ কাউকে টমেটো নিয়ে তাড়া করতে পারবেন না, বা নাজেহাল করতে পারবেন না। টমেটো লড়াই শেষের পর শুরু হয় আরেক যজ্ঞ। ১০০ টন পাকা টমেটোর রসে-রঙে পাল্টে যাওয়া শহর ধুয়ে মুছে সাফ সুতরো করার যজ্ঞ। শহর কর্তৃপক্ষ যেহেতু শহর পরিষ্কার করা নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তাই টমেটো লড়াইয়ের যোদ্ধাদের অনেককেই দেখা যায় পাশের বুনিয়ল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তবে, শহরের অলিগলির বাসাবাড়ির অনেক দয়ালু গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীকেও দেখা যায় হোস পাইপ নিয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের গোসল করিয়ে দিতে। শহরের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে চালু কথাটা হলো—পানি দিয়ে কেবল টমেটোর ছাল-বাঁকল-মণ্ডটা সরাতে পারলেই হলো, টমেটোর অ্যাসিডে তো বাকি সবই পরিষ্কার হয়ে যায়।
বুনিয়ল শহরের টমেটো উত্সব ‘লা তমাতিনা’ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, দুনিয়ার নানা প্রান্তে ইতিমধ্যেই এই উৎসবের আদলে টমেটো লড়াইয়ের উৎসব চালু হয়ে গেছে।
যদি ও বুনিয়ল শহরের টমেটো যুদ্ধ সামলাতে আর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ২০১৩ সাল থেকে মাত্র ১০ ইউরোর টিকিট কাটার ব্যবস্থা করে শহর কর্তৃপক্ষ সাথে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়। টমেটো যুদ্ধ কে কেন্দ্র করে প্রতি বছর বুনিয়ল শহরের ঐ দিন জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় শহরের জনসংখ্যার চার-পাঁচ গুণ বেশি।
দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এবার লা তমাতিনায় ১০০ মেট্রিক টনের বেশি অতিপাকা টমেটো আনা হয়েছে গ্রামের খামারগুলো থেকে। মাত্র ঘণ্টাব্যাপী এই টমেটো লড়াইয়ের জন্য ব্যয় হচ্ছে আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার ইউরো। সেই হিসাবে প্রতি মিনিটে খরচ ২ হাজার ৩০০ ইউরো।
আমার ও যাইতে মুন চাইতেছে টমেটো যুদ্ধ করতে। ট্যাকাটুকা জমাইতে থাকি, সামনের বছরের ভাবতাছি আমি ও যামু “টমটুম যুদ্ধ করতে” ।
আমার Facebook Page : Click This Link