গুলি চলেছিল ঢাকায়, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে প্রথম কবিতাটি লেখা হয়েছিল চট্টগ্রামে। লিখেছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তিনি। ছিলেন চট্টগ্রামের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। কবিতার নাম ছিল ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’।
২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি যেন সফল হয়, তার জন্য চট্টগ্রামের নেতা–কর্মীরা কারখানায়, গ্রামেগঞ্জে প্রচার চালিয়েছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। জলবসন্ত হয় তাঁর। ঢাকায় গুলি হয়েছে, এ খবর যখন শোনেন তিনি, তখন তাঁর ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। এ অবস্থায় নিজ হাতে কিছু লেখা সম্ভব নয়। তিনি তাঁর পরিচর্যাকারী ননী ধরকে বলেন, ‘আমি তো লিখতে পারব না, আমি বলি, তুমি খাতা–কলম নাও।’ ননী ধর লিখে নিলেন কবিতাটি। সেদিন বিকেলে খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস এলেন তাঁকে দেখতে। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনি এসেছিলেন চট্টগ্রামে। অসুস্থ মাহবুব কবিতাটি পড়ে শোনালেন তাঁকে। ইলিয়াস বললেন, এখনই কবিতাটি ছাপতে হবে। আন্দরকিল্লার কোহিনুর প্রেস থেকে ছাপা হলো কবিতা। একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত সভায় কবিতাটি আবৃত্তি করলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন তরুণ প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী চৌধুরী হারুনুর রশীদ।
সরকার নিষিদ্ধ করেছিল কবিতাটি। মাহবুব উল আলমের নামে হুলিয়া জারি করেছিল। বোরকা পরে বাড়ি থেকে সরে পড়লেন কবি। আত্মগোপনে থাকলেন ৯ মাস। কবিতাটি লুকিয়ে রাখা ছিল তাঁর বাড়িতে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে কবিতাটিও পুড়ে গেল। আশির দশকে দৈনিক বাংলায় মাহবুব উল আলম চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। সেখানে কবি বলেছিলেন কবিতাটি তাঁর কাছে নেই। পুলিশ আর্কাইভেও তিনি খোঁজ করেছিলেন। কারও কাছে কবিতাটি আছে কি না, সেটা টেলিভিশনের মাধ্যমেই তিনি আবেদন করে রাখেন। নারী কণ্ঠের একটি ফোন পেলেন এরপর। মঞ্জুরা বেগম নামে সেই নারী বললেন, তাঁর কাছে কবিতাটি আছে। ভাষা আন্দোলনের সময় মঞ্জুরা ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্রী। তাঁর ভাই মীর আশরাফুল হক ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। এস এম হল তল্লাশি চালাতে গিয়ে তিনি কবিতাটি উদ্ধার করেছিলেন। মঞ্জুরাকে তিনি বলেছিলেন, কবিতাটি টুকে রেখে মূল কপি পুড়িয়ে ফেলতে। কবিতাটি কবির কাছে নিয়ে এসেছিলেন মীর আশরাফুল হকের ছেলে মফিদুল হক (সাহিত্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী)।
সেই কবিতাটিকে কবি পূর্ণাঙ্গ কবিতা হিসেবে ভাবতে পারেননি। এই ঘটনার কয়েক বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক জহুরুল হক পূর্ণাঙ্গ কবিতাটি উদ্ধার করেন। প্রসঙ্গ: একুশের প্রথম কবিতা নামে একটি বইও লেখেন তিনি। কবিতাটি মাহবুব উল আলমের সূর্যাস্তের রক্তরাগ কাব্যগ্রন্থে পরে প্রকাশিত হয়।
কবিতাটি হাতের লেখায় ছিল ১৭ পৃষ্ঠা। তার প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি এ রকম:
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি/ যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—/ রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/ ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।’
সূত্র: একুশের কবিতা প্রসঙ্গে কবির কথা: মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি, ২০০৬।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:২৭