রঙ্গিন দুনিয়া কাঁপানো আত্মঘাতী, কিংবা উদ্ভ্রান্ত এক মাফিয়ার সাথে পরিচিত হওয়া যাক। যদিও তাকে মাফিয়া বলাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হচ্ছে, তা এখনি বলা যাচ্ছে না।
'মাফিয়া' শব্দ শুনলেই আমাদের চোখমুখে উজ্জ্বল হয়ে ভাসে যে ফেনিল অথচ ধ্রুব চিত্র, তা আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি আর মাদকের রমরমা হট্টগোল; অবাধ যৌনাচার কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির, ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের এক অলিখিত অসম যুদ্ধমান পরিস্থিতি। আশ্বস্ত থাকুন- আমাদের গল্পের এই মাফিয়া অন্তত তাদের কেউ না।
-
ম্যাগালিজবার্গ পর্বতমালার পাদদেশস্থ অসীম সৌন্দর্যরূপ এপিজ নদী; তারও খানিকটা পূর্বদিক দিয়ে এগুলো গুটেং; দক্ষিন আফ্রিকার উঞ্চরাঞ্চলের শহর *প্রিটোরিয়া*র এক প্রদেশ। সে শহরের একপ্রান্তে সকালের খাবার টেবিলে তুমুল ঝগড়ায় ব্যস্ত বাবা- মায়ের চিৎকার তুলোধ্বনি চেয়ারে বসে থাকা ৯ বছর বয়েসী ছেলেটার বুকে তীরের মতো বিঁধছিলো। হঠ্যাৎ-ই টেবিল চাপ্টে বাবার উদ্দেশ্যে 'তুমি খুব খারাপ লোক' বলে উঠার মূহুর্তেই ছেলেটার চোখেমুখে ক্ষোভের আগুন দেখতে পেলেন মা বাবা। বহুদিনের তিক্ততার সম্পর্ক ওই সময়েই বাবা মায়ের বিচ্ছেদ ঘটালো। সুপার মডেল মায়ের সাথে ভাইবোনদের নিয়ে দিন কাটাতে থাকলো ছেলেটা। একটা সময় বইপ্রেমিক ছেলেটা প্রোগ্রামিংয়ের বই ঘেটে ঘেটে কিসব যেন তথ্য নিয়ে খেলতে শুরু করলো। সেবার, তার বয়স যখন মাত্র ১২, বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে গোটা একখানা ভিডিও গেম তৈরি করে ফেললো! *ব্লাস্টার* নামের ওই গেম'টির স্বত্ত্ব 'পিসি এন্ড টেকনোলোজি ম্যাগাজিন' কিনেও ফেললো ৫০০ ডলারের বিনিময়ে; আমি ১৯৮০ সালের কথা বলছি।
ছেলেটা পড়তো বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক 'আইজাক আসিমভ'র ফাউন্ডেশন সিরিজের বই; যেখান থেকে সে শিখলো 'সভ্যতার বিকাশে, অন্ধকার যুগের সম্ভাবনা ও স্থায়িত্বকাল কমাতে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।' ব্যাপারটা ভাবালো তাকে। ওদিকে, সে তখন গ্রেড স্কুলের ছাত্র। সহপাঠীরা মিলে একবার তাকে সিড়ি থেকে ফেলো দিলো বিনা কারণেই। হাসপাতালের সাদা বিছানায় শুয়ে সে ভাবলো, 'যার ক্ষমতা আছে, তার কাছেই সবাই মাথা নত করে; ক্ষমতার আরেক নাম শক্তি।' শক্তি প্রয়োগে যদি সবাইকে বশবর্তী করা যায়- তবে সেই শক্তি প্রয়োগেই সে উঠে দাঁড়াবে- ত্রাস করবে। সেদিন, সবাইকে তার শক্তি দেখাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া সে ছেলেটা তার কথা রেখেছে অক্ষরে অক্ষরে। সেদিনের সে বালক আজ পুরো পৃথিবী একচেটিয়া শাসন করছে; ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে দিনকেদিন! আখ্যা পেয়েছে মাফিয়ার। যে মাফিয়া অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখায় না; কিন্তু মাথা খেলিয়ে অখ্যাত অচেনা চাঁদের দেশ তার বশবর্তী করে ফেলে!
অবাক হওয়ার কিছু নেই; বাস্তবতা এটাই। গল্প শুরুর টেবিল চাপ্টে উঠা সে ছেলেকে আপনাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেই। নামেই যার পরিচয়- ইলন রিভ মাস্ক; টেক দুনিয়ার শ্রেষ্ট মাফিয়াদের একজন!
২০১৮ সালে 'ফেলো অব দ্যা রয়েল সোসাইটি'র সদস্য হওয়া ইলন মাস্ক'কে সে বছরই ফোর্বস সাময়িকী 'বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি'দের একজন ঘোষণা করেছে। পরের বছর, ফোর্বসের 'আমেরিকার সবচেয়ে উদ্ভাবনী নেতৃত্ব' তালিকায় যৌথভাবে প্রথম স্থান অধিকারকারী ইলন মাস্কের রয়েছে বহুজাতিক পরিচয়! তিনি মহাকাশ ভ্রমণ সংস্থা স্পেসএক্সের সিইও এবং সিটিও, বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা মোটরসের সিইও ও পণ্য প্রকৌশলী, সোলারসিটির চেয়ারম্যান, দি বোরিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, নিউরালিংকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ওপেনএআইয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান এবং পেপালের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। লেখার শুরুতে বলেছিলাম, সে রঙ্গিন দুনিয়ার এক আত্মঘাতী- উদ্ভ্রান্ত মাফিয়া; ভুল বললাম কিছু?
ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালের ২৮ জুন, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রিটোরিয়াতে। বাল্যকালে ইলন উদ্ভাবন ক্ষমতার এতোই মোহে পড়ে যান যে তাকে ডাক্তারেরা শ্রবণশক্তি পরিক্ষা করতে বলেন।
যদিও তার কোনো সমস্যাই ছিলোনা। ১৯৮৯ সাল, ইলনের বয়স তখন ১৭ বছর; আফ্রিকায় এই বয়েসী যুবকদের বাধ্যতামূলক মিলিটারি ট্রেনিং নিতে হয়। মিলিটারি ট্রেনিং থেকে বাঁচতে ইলন চলে গেলেন কানাডায়, সেখানকার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হলেন। ইলন বুদ্ধিমান মানুষ, সে জানতো কানাডা থেকে সহজেই আমেরিকা যাওয়া যায়- তাই আফ্রিকা ছেড়ে কানাডায় চলে আসা। কুইন্সে বছর তিনেক পড়ে ইলন এবার গন্তব্য পাল্টালেন, পাশাপাশি পড়াশুনার ধরণও। এবার তাকে দেখা গেলো পেনসেল্ভিনিয়ায়, ফিজিক্সের মতো রসকষহীন বিষয় তখন তার মাথায় উইপোকার মতো বাসা বেঁধেছে। এখানে ব্যাচেলার ডিগ্রি সম্পন্ন হলে, ইলন পেনসেল্ভিনিয়াও ছাড়লেন। এবার যাত্রা ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। মজার ব্যাপার, স্ট্যান্ডফোর্ডে ইলন ছিলেন মাত্র দুই দিনের ছাত্র! পিএচডি করতে গিয়েছিলেন শক্তি পদার্থবিদ্যা বিষয়ে, তা আর হলোনা। সে এক অবিস্মরণীয় দিন। কয়েক বছর পর ইলন মাস্কের নাম যখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে- তখন সেদিনের প্রতি ইলন মাস্ক নিশ্চইয়ই কৃতজ্ঞ থাকবেন।
যেভাবে ইলন মাস্ক মাফিয়াদের একজন হয়ে উঠলেনঃ
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সফল সব ব্যক্তিদের শুরুর গল্পটা অসাধারন হয় না, বরং নানা প্রতিকূলতা আর ব্যর্থতার সব উপাখ্যান লেখা থাকে সেসব গল্পে। আশ্চর্যজনক হলেও এটা সত্য যে, ইলন মাস্কের বেলায় শুরুর আবহাওয়া ছিলো অনুকূলে। স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার তৃতীয় দিন ইলন মাস্ক তার ভাইকে নিয়ে শুরু করলেন তার বর্নাঢ্য জীবনের প্রথম ব্যবসা, মুলত একটি কোম্পানি। এবং তাতেই বাজিমাত। Zip2 Corporation নামের ইলনের ওই কোম্পানি স্থানীয় শহর গাইড প্রদান করতো, পাশাপাশি তারা দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস ও শিকাগো ট্রিবিউন এর অনলাইন পত্রিকার জন্য কনটেন্ট দেয়া শুরু করলো। কোম্পানির বয়স যখন মাত্র ৪ বছর, কমপ্যাক কম্পিউটার কর্পোরেশন ইলনের গোটা কোম্পানিটাকেই কিনে ফেললো ৩০৭ মিলিয়ন ডলার ক্যাশ আর ৩৪ মিলিয়ন ডলার স্টক শেয়ারের বিনিময়ে! এই চুক্তিটাই পাল্টে ফেললো ইলন মাস্ককে। ১৯৯৯ সালের প্রেক্ষাপটে এতবড় অংক ছিলো সত্যিই অভাবনীয়। তাইতো, ইলনকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হলো না।
পেপালের জন্মঃ
নিজেদের গড়া কোম্পানি বিক্রির সমস্ত টাকা দিয়ে এবার মাস্ক ভাতৃদ্বয় শুরু করলেন অনলাইন পেমেন্ট সার্ভিস কোম্পানি। নাম দিলেন X ডট Com, বিশ্ববাসী পরে যাদেরকে চিনেছে পেপাল নামে। পেপালের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়লে আরো বড় ধরনের লাভজনক ব্যবসার আশা খুঁজে পেলেন ইলন। অবশ্য এখানে বলে রাখা জরুরি, পেপাল এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ইলন মাস্ক ছাড়া আরোও ছিলেন পিটার থিয়েল, ম্যাক্স লেভচিন, কেন হোউরি, লিউক নোসেক ও ইউ পান। শুরুর গল্প বলি; পেপাল ১৯৯৮ সালে জন্ম নিলেও প্রথমে তারা সিকিউরিটি সফটওয়্যার ডেভলাপ করতেন। এই ব্যবসা তাদের হতাশ করে। অত:পর, তারা
ভাবলেন এটাকে ডিজিটাল ওয়ালেট বা পেমেন্ট মেথড সার্ভিস হিসেবে পুনরায় চালু করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। এই প্রসেস পর্যন্ত লেভচিন- থিয়েলদের সাথে ছিলেন না ইলন। তারা যখন অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থার কথা নিয়ে কাজ করতে চাইলো তখন তিনি তার নিজস্ব কোম্পানি X ডটকম'কে পেপালের সাথে একত্র করে ফেললেন। এবং দুটো আলাদা কোম্পানি থেকে এক নামে এক কোম্পানিতে চলতে থাকলো পেপাল। সেটা ২০০০ সালের মার্চ মাসের কথা। তবে সব কার্যক্রম প্রকাশ্যে আনতে পেপাল সময় নিয়েছিলো পরবর্তী দুই বছর।
স্পেসএক্স এবং স্বপ্নজয়ের যাত্রাঃ
মানুষ তার স্বপ্নের থেকেও বড় হতে পারে- এমন ভারিক্কি কথা শুনলে হয়তো কেউ কেউ বিনয়ে কিন্তু অত্যন্ত তিরষ্কারমূলক বাণী শুনাতে পারেন। এখানে-ই স্রোতের বিপরীতে দিব্যি দাম্ভিকতা নিয়ে হেঁটেছেন ইলন। মানুষ যে তার স্বপ্নের থেকেও বড় হতে পারে; তা-ই যেন করে দেখালেন তিনি।
বাল্যকালে, রুপকথার গল্পে চাঁদের দেশ ভ্রমণের মতো চমকপ্রদ ব্যাপার নিয়ে কৌতুহলে কিংবা আগ্রহে চোখ কপালে উঠে যেতো আমাদের। আর এদিকে, দুটি ব্যবসা সফল কোম্পানির পরপরই 'মহাকাশ গবেষণা সংস্থায়' বানিজ্যিক স্পেসক্রাফট পাঠানোর ভাবনা থেকে জন্ম নিলো ইলন মাস্কের ৩য় কোম্পানি 'স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলোজিস কর্পোরেশন' বা স্পেসএক্স। ২০০২ সালে গড়া এই প্রতিষ্টান এতোটাই কর্মদক্ষতা আর যোগ্যতার প্রমাণ রাখে যে, বছর ছয়েক পর খোদ নাসা-ই স্পেসএক্সের সাথে এক লিখিত চুক্তিতে সাক্ষর করে, যেখানে বলা হয় 'স্পেসএক্সের নির্মিত স্পেসক্রাফট মহাকাশ গবেষণা স্টেশনে কার্গো পরিবহণ করবে।'
স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি স্বপ্নকে বাস্তবেও রূপ দিতে হয় বলে একটা কথা প্রায়ই গুণীর বলেন। নাসা'র সাথে চুক্তির চার বছর পর, সেদিন ছিলো ২২ মে, ২০১২; ইলন মাস্ক আর তার গড়া স্পেসএক্স যেন বিশ্বজয় করে ফেললো! এ যেন পৃথিবীকে তার শক্তি পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা বলা সে বালকের সহজ সমীকরণে রুদ্ধশাসে বিশ্বজয়। স্পেসএক্স এ'দিন সাফল্যের সাথে তাদের ডিজাইনকৃত ও বানানো 'ফ্যালকন-৯' রকেট প্রায় ১ হাজার পাউন্ড সরঞ্জামাদি নিয়ে সাফল্যের সাথে মহাকাশ স্টেশনে অবতরণ করে। রাতারাতি বিশ্বব্যাপী খবরের শিরোনাম বনে যান ইলন মাস্ক! স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার এই কারিগর এখানেও সফল।
তারপরের বছরগুলো ইলন মাস্ক আর স্পেসএক্সের জন্য কেটেছে স্বপ্নের মতো। পরের বছর ডিসেম্বরে আরেকটি ফ্যালকন-৯ রকেট স্যাটেলাইট পরিবহন করে জিওসিনক্রোনাস বদলি অরবিটে পৌঁছায়, যেখানে সাধারণত পৃথিবী ঘুর্ণনের ফলে অরবিটে আটকে যাওয়ার সম্ভবনাও থাকে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি এবং '১৭ এর মার্চের পর ফ্যালকন-৯ রকেট পর আবার নভেম্বরে ও '১৮ সালে দু'বার মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছায়। এ যেন এক রূপকথার গল্প। আর একজন বিজনেস মাফিয়া, ইলন মাস্কের সাফল্যের কীর্তিগাঁথা ইতিহাসের স্বর্নাক্ষরে খোদিত হচ্ছিলো।
টেসলা মোটরস; কিংবা এক উপাখ্যানঃ
মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। অজানাকে জানার আর জেনে সেটা সফলতায় রুপান্তরের নেশা- সেতো বহুদিনের। একজন ইলন মাস্কও তার ব্যতিক্রম নন। তার শুরুর গল্পটা দারুণ; সাফল্যের গ্রাফটাও চমৎকার। সেখানে বড় কোনো ব্যর্থতা নেই বলেই কি ইলন বারবার সাফল্যকে নিজের বশবর্তী করে ফেলতে চান? উত্তরটা বোধহয় 'হ্যাঁ'ই হবে। নয়তো এতো এতো সফলতার গল্পের রচয়িতা এবার কেন হাত বাড়াবেন ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মানে?
এবার বললে ভুলই বলা হবে। পেপাল প্রতিষ্টার বছরখানেক পরই এই উদ্ভাবনী চিন্তায় আসক্ত হয়ে গেলেন ইলন মাস্ক। ২০০৩ সালে বিদ্যুৎ যন্ত্রপাতির একটি কোম্পানি খুলে বসলেন তিনি।
ইলন-ই সে কোম্পানির প্রতিষ্টাতা, প্রোডাক্ট আর্কিটেক্ট পাশাপাশি সিইও! কোম্পানির নাম দিলেন টেসলা মোটরস। টেসলা তখন ব্যাটারি প্রোডাক্টস এবং সৌরশক্তি নিয়ে কাজ করতো। তবে তাদের প্রধান টার্গেট ছিলো বিদ্যুতিক গাড়ি নির্মান করা। সে পথেই যেন হাটছিলো তারা। অবশেষে, কোম্পানি প্রতিষ্টার ৫ বছরের মাথায়, ২০০৮ সালে ইথিয়াম আয়ন ব্যাটারিচালিত 'রোডস্ট্যার' নামের একটি স্পোর্টস কার বানিয়ে সবাইকে হকচকিয়ে দেয় টেসলা। গাড়িটি মাত্র ৩.৭ সেকেন্ডে ০-৬০ মাইল গতিবেগে চলতে পারত!
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ পেলো না ইলন মাস্কের কোম্পানিটি। রোডস্ট্যারের পর একে একে বাজারে নিয়ে এলো মডেল এস, মডেল-৩, সেমি ট্র্যাক ও বহুল কাঙ্ক্ষিত মডেল ওয়াই! এই মডেলের গাড়িটা নিয়েই যত আলোচনা আর প্রশংসা! এক কথায় বোমা মেরে দিয়েছেন ইলন মাস্ক।
'দ্যা বোরিং কোম্পানি' : আসলেই বোরিং?
পর্বতের পাদদেশের আরোহীরা স্বপ্ন দেখে পর্বতের শীর্ষ চূড়া ডিঙ্গিয়ে দেখার। ইলন মাস্ক, এই মানুষটা সফলতার শীর্ষচূড়ায় বসে ভাবেন- আর কিভাবে কিভাবে সাফল্য অর্জন করা যায়! জিনিয়াস'রা সাধারণত সহজভাবে সবকিছু দেখেন, সিদ্ধান্ত নেন ভেবেচিন্তে। ইলন মাস্ক তাদের একজন। অনেক ভেবেচিন্তে ২০১৭ সালে আরেকখানা তরতাজা কোম্পানির জন্ম দিলেন, যার নাম 'দ্যা বোরিং কোম্পানি!' এই কোম্পানির কাজ সড়কের ট্রাফিক জ্যাম কমানো। অদ্ভুত লাগছে না শুনে? আরোও অদ্ভুত বিষয় হলো, কোম্পানি তাদের প্রথম পরীক্ষা চালিয়েছে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের বিল্ডিংয়ের নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণ করে।
২০১৯ সালের মে মাসে 'দ্যা বোরিং কোম্পানি' লাস ভেগাস কনভেনশন সেন্টারের আন্ডারগ্রাউন্ড লোপ সিস্টেমের কাজ একাই ভাগিয়ে নিয়েছে ৪৮.৭ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে।
মাস্কের উদ্ভাবন প্রীতিঃ পেশা না নেশা?
বাল্যাকাল থেকে বিজ্ঞানের নেশায় মত্ত থাকা ইলন মাস্ক পেশায় বিজ্ঞানের এক বিরল দৃষ্টান্ত। টাইম ট্রাভেল রূপকথার গল্পে আর সিনেমার ফ্রেম নিয়ে সবাই যেখানে সবাই ব্যস্ত, ইলন মাস্ক যেনো সেটি বাস্তবে দেখিয়ে দিতে চলেছেন! ২০১৩ সালে 'হাইপারলুপ' নামক এক কনসেপ্ট নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দেন ইলন মাস্ক। প্লেন কিংবা ট্রেনের থেকেও নিরাপদ অথচ দ্রুততম পরিবহন মাধ্যম হিসেবে হাইপারলুপ' কনসেপ্টের জন্ম। কে জানে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এটি হতেও চলেছে মাস্কের হাত ধরে।
নিউরোলিংক- ইলন মাস্কের আরেক উদ্ভাবনী ক্ষমতার ফসল; একটি যুগান্তকারী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। তাছাড়া, হাই-স্পিড ট্রেন কিংবা 'শিখা' নিয়ে তার অতি আগ্রহ! কোনোকিছুই বাদ যাচ্ছেনা।
কিছুই যখন বাদ যাচ্ছেনা তখন সেখানে রাজনীতি- কূটনীতি বাদ যাবে কেন? এই সেক্টরেও মাঠ গরম করেছেন ইলন মাস্ক। তবে রীতিগত প্রথার বাইরে ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'স্ট্রাটেজি এবং পলিসি ফোরাম' এর বিশেষ দূত হিসেবে তাকে দেখা যায়। পরের বছর তাকে প্রেসিডেন্টের ম্যানুফেকচারিং জবগুলোর এডভাইজার হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। যদিও সে বছরই প্রেসিডেন্টের এডভাইজার পদ থেকে সরে আসেন ইলন মাস্ক।
ইলন মাস্ক বর্তমান বিশ্বের কততম ধনী, তার আয়ের প্রধান উৎসগুলো কি; কিভাবে তার জীবন চলে- এসব জৌলুসহীন প্রশ্নের উত্তর আমরা না-ই খুঁজলাম। তাকে কোন অবদানের জন্য কি আখ্যা দিবো সেটিও না হয় পরে ভাবলাম; শুধু এতোটুক বলতে বাঁধা কিসে- টেক দুনিয়ার এক মাফিয়া ইলন মাস্কের উত্থানে আমাদেরও শেখার আছে। আর সেটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি দিয়ে প্রকাশ করা যাক, 'স্কুল শিক্ষার সাথে জ্ঞানের তুলনা করে দ্বিধান্বিত হইয়োনা। আমি কখনো হার্ভাডে যাইনি, কিন্তু আমার কোম্পানিতে যারা কাজ করে তারা সেখান থেকেই এসেছে।'
আরোও শক্তিশালী কিছু শুনতে চান? ইলন বলেন, 'ব্যর্থ হওয়া এখানে একটি অপশন; আপনি যদি ব্যর্থ না হন তবে বুঝতে হবে আপনি নতুন কিছু আবিষ্কার করতে সমর্থ্য না।'
.
ইলন মাস্কঃ এক মাফিয়ার উত্থান! | আহমদ আতিকুজ্জামান।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১১:১৫