আজ আমি আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো পৃথিবী বদলে দেয়া যুগান্তকারী এবং চমৎকার এক ব্যক্তির সাথে।
থাইল্যান্ডের রাস্তায় রাস্তায় সে ঘুরে বেড়াতো বিচিত্র এক কাণ্ড করে৷ আর তা হচ্ছে, অশুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলতো সে। মানুষ- জীব জড় বস্তু এমনকি শহরের পাব্লিক টয়লেটের দেয়ালগুলোও রক্ষা পায়নি তার অশুদ্ধ উচ্চারণের ইংরেজি ভাষা থেকে৷ প্রথম প্রথম সে পরিবারের মানুষদের সাথে ইংরেজি ভাষায় কথায় বলতে থাকে; কিন্তু তার এমন উদ্ভট ইংরেজি শুনে পরিবার মনে করলো মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তার৷ তারপর এলাকার মানুষদের সাথেও যখন অশুদ্ধ ও অশ্রাব্য ভাষায় ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো- তারা ভাবলো নেহায়েত ই পাগল হয়ে গেছে মানুষটা! কিন্তু সে তার ইংরেজি ভাষায় কথা বলার প্রচেষ্টার আত্মাহুতি দিলোনা। সে বরং মানুষদের পাগল বলাবলিতে হাসতো আর বলতো- 'আমি মোটেও পাগল না। আমি ইংরেজিতে কথা বলতে চাই৷ তোমরা সাহায্যে করছোনা কেন?'
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় সে ইংরেজি ভাষা কারোও কাছ শেখার থেকে সুযোগ পায়নি। তবুও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে এবং মানুষের মুখ থেকে শুনা শব্দগুলো দিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগলো। একটা সময় দেখা গেলো সে মোটামুটি ভালোই কথাবার্তা বলতে পারছে, তবে কোনো মানুষ তার কথা শুনছেনা৷ সে কথা বলতো গাছ কিংবা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে! কখনোও বা কুকুরের সাথে হাত দুলিয়ে ইংরেজিতে দীর্ঘ ভাষণ দিতো৷ কুকুর তার কথা বুঝতে পারুক না পারুক- লেজ নাড়িয়ে ঘেউঘেউ শব্দ করে তাকে সমর্থন দিতো৷
এখন বর্তমানের কথা বলবো। বর্তমানে প্রতিদিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে থাইল্যান্ডের প্রায় ২ লক্ষ শিক্ষার্থীর ইংরেজি শিক্ষক সে! নাম হিরোদাতা ওতোতা ৷ থাইল্যান্ডের প্রধান ৭ টি ইউনিভার্সিটি থেকে সে অফার পেয়েছে ইংরেজির প্রফেসর হিসেবে যোগদানের জন্য। শ্রোতার অভাবে সে যখন কথা বলার প্লাটফর্ম খুঁজে পাচ্ছিলোনা, তখন গাছ-কুকুর কিংবা দেয়াল হয়েছে তার শ্রোতা। সে সবসময় একটা কথাই বলতো- "আমাকে বলতে দাও৷"
(২)
একবার আমি রেডিও'তে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। সুযোগটা এসেছিলো ঘটা করেই; তবে আমার চোখমুখ উজ্বল করে। ফুটবল বিষয়ক গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে সেদিন ১০ মিনিট আমার সাপোর্ট করা দলকে ডিফেন্ড করে, বিশ্বকাপে আমাদের অতীত এবং বর্তমান সম্ভবনার আশার বাণী শুনিয়েছিলাম৷ যেহেতু পূর্ব অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা ছাড়া কথা বলতে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, সেহেতু যথেষ্ট নার্ভাসনেস কাজ করছিলো। আর সেইসাথে টুকটাক আঞ্চলিকতা চলে এসেছিলো কথায়৷ ঘটনাটা যখন ভার্সিটি ফ্রেন্ডরা জানলো, তখন তাদের মধ্যে থেকে একজন এমন ভাবে উপহাসের ভঙ্গিতে বারবার বলতে লাগলো- তুই! তুই গিয়েছিস রেডিওতে! হা হা হা! অবজ্ঞা, উপহাস আর অপমান সহ্য করতে আমি বেছে নিয়েছিলাম একটি কথাই- ওই প্লাটফর্মে যাওয়ার যোগ্যতাই তো তার নাই!
'তার এবং তাদের' অবজ্ঞা আর উপহাসের পাত্র আমি পূর্বে থেকেই হয়ে আসছি। এখনো হচ্ছি ৷ ওই বান্ধবীকে সমর্থন করে বরিশালের আরোও বন্ধু আমাকে দেখলেই উপহাসের অঙ্গভঙ্গি করে৷উচ্চারণ শুনে হাসে, কিংবা ওটা ব্যাঙ্গাত্মকভাবে রিপিট করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেও বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাতেই আমাকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে! যেন সিলেট বাদে সব এলাকার ভাষাই খাঁটি, বিশুদ্ধ!
আসল কথা হচ্ছে আঞ্চলিকতা! আমার কথা বলায় কখনোও সখনোও আঞ্চলিকতা চলে আসে। দেশের বিভিন্ন জায়গার মানুষের সাথে চলাফেরা করতে শহুরে ভাষাটাই ব্যবহার করা লাগে৷ কিন্তু আঞ্চলিকতা ব্যবহার করলেই যেন কিছু মানুষের কাছে আপনি হয়ে গেলেন লেখার শুরুর চমৎকার মানুষ হিরোদাতা ওতোতা!
দিব্যি মনে আছে, মহাখালী থেকে সপ্তাহে দু'তিন হলেও টানা ৬ মাস খিলক্ষেতে যেতাম। কারণ একটাই- ওখানে আমার অঞ্চলের এক ভাই আছেন। তার সাথে প্রাণ খোলে আঞ্চলিক ভাষায় আড্ডা দেয়া যাবে; চা'য়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিকুঞ্জের সে মাঠের পাশে বসে কত্তবার যে বলেছি- আমার ভাষাটা কত্ত সুন্দর! কি আবেগ মিশ্রিত ভাষা।
লেখার সাথে শিরোনামের জোড় এনে দিচ্ছি এখন। হিরোদাতা ওতোতা যেভাবে পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপড়শীর অবজ্ঞা উপহাস সহ্য করেও শহর ছেড়ে পালিয়ে যান নি; বরং ওই শহরের প্রত্যেকটা ইট পাথরও জানে ওতোতা কিভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন। ফলস্বরূপ হয়েছেন প্রতিদিনের ২ লক্ষ শিক্ষার্থীর শিক্ষক! আমিও ঠিক সেভাবেই আঞ্চলিকতা দূর করে শহুরে বাতাস গায়ে লাগিয়ে শুদ্ধ ভাষায় উঠতে বসতে কথা বলছি! আর তোমাদের বলছি- আমাকে কথা বলতে দাও। এটা না হয় আমার সংগ্রাম। হিরোদাতা হতে পারবোনা; কিন্তু তার শিক্ষা গ্রহণ করে শুদ্ধভাষায় কথা বলার সংগ্রাম নাহয় চালিয়ে যেতে পারি। আর তাতেও যদি 'তাহা'দের মন না ভরে, তবে তোমাদের শহর থেকে বিদায় করে দাও আমায়।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:১৯