বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই যেন উন্মাদনার এক রঙ্গমঞ্চ। তাইতো শত সহস্র, লাখো- কোটি মাইল দূরে থেকেও একই সুরে গলায় মিলায় সারাবিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল সমর্থক! সারাবিশ্বের মতো এমন আনন্দোৎসবের সামিল হয় আমাদের ছোট্ট এ দেশটাও। যেখানকার বিশাল জনগোষ্টির বেশির ভাগ অংশই দুটোমাত্র ফুটবল দলের সমর্থনে বিভক্ত। ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই বাসার ছাদে কিংবা গাড়িতে প্রিয় দলের পতাকা উড়িয়ে তাদের সমর্থন জানাই আমরা। আজ এই বিশ্বকাপ নিয়ে আমার কিছু স্মৃতি তুলে ধরলাম।
২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের কথা। মুখোমুখি স্পেন-নেদারল্যান্ডস। প্রথম ম্যাচে হেরে বিশ্বকাপ শুরু করা দলটা ফাইনালে উঠে যাবে তা হয়তো অনেক ফুটবল বোদ্ধা কল্পনাও করেন নি। যদিও বাকি ম্যাচগুলো দুর্দান্ত এবং দাপুটে- হিংস্রভাবে খেলে জিতেছিলো তারা। এবং যোগ্য দল হিসেবেই ফাইনালে উঠেছিলো। নেদারল্যান্ডস এর বিষয়টা বলি- রোবেন, স্নাইডার, ভ্যান পার্সি'দের প্রতি তখন আমার অগাধ ভালোবাসা। প্রতিটা প্লেয়ার'কে ভালো লাগতো ভিন্ন কোনো এক কারণে।
তবে সে ভালোলাগা আর ভালোবাসা সেদিন নিমিষেই ফুরিয়ে গেলো; যেদিন ব্রাজিল'কে তারা বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করলো! ১৫-২০ জন ফুটবল ফ্যান মিলে সেদিন ব্রাজিল নেদারল্যান্ডেস ম্যাচ দেখছিলাম। শুরুতেই রবিনহোর গোল'টায় প্রচন্ড খুশিতে লাফিয়েছিলাম; কিন্তু সেটি অফসাইড হয়ে গেল! পরবর্তীতে, ম্যাচে ব্রাজিল ১ টা গোলে এগিয়ে ছিলো। নেদারল্যান্ডস যখন পাল্টা গোল শোধ করলো; তখন আমার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিলো! এই বুঝি ম্যাচ হেরে যাই। ম্যাচটা তখনি হেরে গেলাম, যখন আমার প্রিয় একজন ফুটবলার ওয়েলসি স্নাইডার হেড থেকে দারুন এক গোল করলেন; এবং মাথায় হাত রেখে দৌড়ে হাস্যোজ্জল সেলিব্রেশন করলেন! ব্রাজিল ম্যাচটায় ব্যাক করতে পারতো; কাকা'র একের পর এক আক্রমন প্রতিহত হয়েছিলো সেদিন। ফুটবল বিধাতা হয়তো চান নি ব্রাজিল ম্যাচটা জিতুক; তাই গোলবার থেকে বল ফিরে এলো বার'কয়েক! ম্যাচ শেষে রিকার্ডো কাকা'কে দেখে যতটুকু না হতাশ মনে হয়েছিলো; তারচেয়ে বেশি হতাশ ছিলাম না আমি। কিন্তু সবার সামনেই আমি কেঁদেছিলাম সেদিন। সে কান্না অনেক্ষণ স্থায়ী হলো। বাসায় ফিরে যেতে যেতে দু'চোখ বেয়ে অশ্রু পড়তেই থাকলো; অন্ধকারে হয়তো কেউ খেয়াল করেনি!
পূর্বের কথায় ফিরে আসি। প্রিয় দল বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে যাওয়ায় ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে আমার মধ্যে খুব একটা ফিলিংস কাজ করলোনা। কিন্তু ব্যাপারটা যখন ফুটবল, এবং 'দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'- তখন আর নিজেকে ফাইনাল ম্যাচ দেখা থেকে বঞ্চিত রাখা যায়না। তাই ঠিক করলাম খেলা'টা দেখবো।
সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো; সেদিন মা'কে বলে রেখেছিলাম আমাকে তুলে দিও' ফাইনাল ম্যাচ দেখবো। মা আশ্বস্ত করেছিলেন ডেকে দিবেন। কিন্তু আমি সেই যে ঘুমোলাম, উঠার চিহ্ন-ই নেই! এদিকে মা'ও ডাকলেন না আমায়; অথচ খেলা শুরু হয়ে প্রথম ৩৫-৪০ মিনিট শেষ! হঠ্যাৎ লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম! উঠেই সে-কি কান্না! যেন আমার বিশাল বড় কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে! কান্না করছি আর বারবার মা'কে বলছি- 'তুমি আমাকে তুলে দাওনি কেন? কেন? ৪ বছর পর আবার খেলা আসবে, ৪ বছর পর! কেন তুলে দাওনি এতোক্ষণ!' যাইহোক, ম্যাচের বাকিটা দেখলাম। এবং অতিরিক্ত সময়ে ইনিয়েস্তার গোলে ম্যাচ জিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো স্পেন! আমার খারাপ লাগছিলোনা; নেদারল্যান্ড আমার স্বপ্নভঙ্গ করেছিলো; স্পেন না- এটা ভেবে! আমার সেদিনের কান্না আর পাগলামির সাথেসাথে মা'কে কি যে অসহায় আর অপরাধী লাগছিলো!
বিশ্বকাপ স্মৃতি মনে করতে গেলে যে সুখস্মৃতি'টি আমার মাথায় সবার আগে আসে সেটি হলো ২০১০ বিশ্বকাপের নক-আউট পর্বের কোনো একটা ম্যাচের কথা। উরুগুয়ের প্রতিপক্ষ কোন দল ছিলো তা মনে করতে পারছিনা এইমূহুর্তে। বাবা সে'বার কেবল ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছেন। দেশে যখন এসেছেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত। সে সময়েই উরুগুয়ের ম্যাচটা ছিলো। বাবা বললেন, ম্যাচটা চাচাদের বাসায় গিয়ে দেখবেন। একা খেলা দেখাতে মজা নেই। আমরা খুশিতে লাফঝাপ দিলাম কিছুক্ষন। অত:পর মাঝরাতে খেলা দেখতে গেলাম; এবং বেশ কয়েকজন মিলে খেলাটা দেখছিলাম। সে'বার দুর্দান্ত খেলেছিলেন উরুগুয়ের সোনালী চুলধারী ডিয়াগো ফোরলান। তার পায়ের কারিশমা এবং লং ডিস্টেন্স থেকে ফ্রি-কিক গোলগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম! বিশ্বকাপের সুখস্মৃতিতে সে ম্যাচটা যোগ করার পিছনে কারণ হলো- সে ম্যাচেও ফোরলান ৩৪ ইয়ার্ড দূরে থেকে অতিমানবীয় একটি ফ্রি-কিক গোল করেছিলেন! এবং আমরা সবাই-ই আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম, তেমনটিই হয়েছিলো- তাই সে ম্যাচটা সুখস্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।
২০০৬ বিশ্বকাপের কথা বলি। তখন আমি মোটামুটি ফুটবল বুঝতে শুরু করেছি। বাবা ইতালির ফ্যান। উনার কাছ থেকে জেনেছি ইতালি লং পাস এবং ডিফেন্সে কতটুকু শক্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা- ইতালিয়ান ফুটবলারদের প্যাশন। ন্যাশনাল এন্থম গাওয়ার সময় প্রত্যেকটা প্লেয়ার গলার সমস্ত জোর দিয়ে গাইবে; কান্না করবে! এই জিনিসটা নিখাদ। এদের দেশপ্রেমে ভেজাল নাই। অথচ আমি বড়ভাই আর চাচাতো ভাইদের মতোই ব্রাজিল ফ্যান। দুখের বিষয়, আমরা ফ্রান্সের সাথে হেরে সেবার বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়লাম। এবং বাবার সাপোর্ট করা দল ইতালি ফাইনালে গেলো; প্রতিপক্ষ ফ্রান্স! ফ্রান্সে তখন খেলেন সময়ের সেরা ফুটবলার জিদান। ইতালিতে বুফন, ডি রসি, ফ্রান্সিস্কো টট্টির মতো তারকা ফুটবলাররা। হাড্ডাহাড্ডি একটা ফুটবল ম্যাচের এক্সপেক্টেশন করেছিলাম এবং তা-ই হলো! কিন্তু বিপত্তিটা তখনি ঘটলো যখন জিদান মাথা গরম করে মার্কো মাতেরাজ্জি'কে ঢুষ মেরে ফেলেদিলেন! ফলস্বরুপ, রেফারি তাকে রেড কার্ড দেখালাম। সেটা ছিলো জিদানের শেষ বিশ্বকাপের শেষ ১০ মিনিট! অথচ কি ভুলটাই না করে বসলেন তিনি। শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত ইতালির গোল শোধ করতে ব্যর্থ হয় ফ্রান্স। ফলে ইতালি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়।
২০০৬ বিশ্বকাপের ছোট্ট আরেকটি স্মৃতি আছে। ব্রাজিলের ম্যাচ দেখতে বসেছি অন্যান্য দিনের মতো। সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখছি। বারবার এট্যাক করেও গোল করতে পারছেনা দিনহো'রা। ঠিক সে সময় আমার প্রশ্রাবের বেগ হলো। আমি যেই ওয়াশরুমে ঢুকলাম; রুমের ভিতর থেকে সবাই চিৎকার করে উঠলো! গোওওওল... রোনাল্ডো! আফসোস, সে গোলটা আমি দেখতে পারলাম না!
২০১৪ বিশ্বকাপের কথা। ২০১৩ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনকে হারিয়ে কনফেডারেশন কাপ জিতলো ব্রাজিল। সেজন্য ২০১৪ বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের অনেক বেশি এক্সপেক্টেশন ছিলো। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগেই এলাকায় ৩-৪ টা বড় বড় ফ্ল্যাগ উড়িয়ে দিলাম। এলাকায় তখন শুধু আমাদের রাজত্ব- এটা ভেবেই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতো। বিশ্বকাপে আমাদের একটা ম্যাচের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। ম্যাচটি ছিলো চিলির সাথে। এত্তো পরিমান হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ম্যাচ খুব কমই দেখেছি আমি। ম্যাচ দেখতে আসা ২০-২৫ এর মোটামুটি সবাই-ই এন্টি ব্রাজিল। ব্রাজিল গোল খেলে কিংবা হারলে আমাদের ক্ষেপানোর জন্যই এদের আগমন। দেখা গেলো, ম্যাচ ড্র হয়ে গেছে। এবং শেষপর্যন্ত টাইব্রেকারে গড়ালো সে ম্যাচ। ম্যাচটা তখন শুধুই গোলকিপার বনাম গোলকিপারের। আমি এতোটাই ভয়ার্ত ছিলাম যে, সবাই মনে করেছিলো এবারো কান্না করে দিবো! ভাগ্যে ভালো, আমাদের গোলি জুলিও সিজারের অসাধারণ নৈপূন্যে সে ম্যাচ আমরা জিতে গেলাম! আমাদের বাঁধভাঙ্গা আনন্দ তখন দেখে কে? চিৎকার চেঁচামেচি আর হৈ হুল্লোড় করতে থাকলাম! ঈদের কোলাকুলিও করলাম; যে ভাইটির সাথে এতোটা আনন্দ ভাগ করেছিলাম- তিনি এখন দেশের বাইরে। ২০১৮ বিশ্বকাপ জয় করলেও ২০১৪ বিশ্বকাপের সে ম্যাচের মতো জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতে পারবোনা! কোনো মানে হয়?
বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে পৌছে গেলো প্রিয় দল ব্রাজিল। প্রতিপক্ষ জার্মানি। আত্মবিশ্বাসী ছিলাম ম্যাচটা জিতবো এবং ফাইনালে যাবো আমরা। সে ম্যাচ একা একা দেখার কোনো প্লান ই ছিলোনা আমার। ঠিক করে রেখেছিলাম বাকি ম্যাচগুলোর মতোই সবার সাথে বসে খেলা দেখবো! কিন্তু কি এক অজানা ভয় আমাকে গ্রাস করলো! মনে হলো ওদের সাথে ম্যাচটা না দেখি। তাই গেলাম না। টিভি সেটের সামনে তখন আমি, বাবা আর আমার ছোটভাই। বাবা সোফায় বসে মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছেন। আমি অস্থির; কোনোভাবেই শান্ত থাকতে পারছিনা। তাই মেঝেতে বসে বসে খেলা দেখছি। একটু পরেই আমার সাথে যা ঘটলো তা লিখে প্রকাশ করার মতো না। আমি মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে দেখছিলাম কি হতে চলেছে। ১-২-৩-৪-৫!! চোখের সামনেই হাফটাইমের আগে ৫ টি গোল দিয়ে দিলো জার্মানি। আমি হতভম্ব! কাদঁবো না কি করবো বুঝতেছিনা।
স্পষ্ট মনে আছে সেহরিতে কিছু খেতে পারলাম না। অথচ তখনো আমি ভাবছিলাম ব্রাজিল কামব্যাক করবে! কিন্তু না, ৯০ মিনিট শেষে অস্কারের শান্তনাসুচক গোলের বিপরীতে আমাদের জালে ঢুকেছে ৭ টি গোল! আমি একটুও কাদলাম না। কিন্তু টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম ডেভিড লুইজ, জুলিও সিজার, অস্কার'দের কান্না। খেলা দেখা শেষ করে মানুষ তখন রাস্তায় নেমে পড়েছে। আমি শুনলাম, আমাদের বাসার সামনে দিয়ে বেশ কয়েকজন যুকব মিছিল দিয়ে যাচ্ছে! ব্রাজিলের এমন পরাজয়ে তারা খুশি। বাবা আদেশ করলেন, কেউ যেন আমাকে কিছু না বলে; হয়তো আমি মেজাজ হারাতে পারি- এই ভেবে। সকালে বের হয়ে দেখলাম আমাদের লাগানো একটি ফ্ল্যাগও আস্ত নেই! সবগুলো খুলে ছিড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফুটবল নিশ্চয়ই আমাদের এই শিক্ষা দেয়না।
আমি দেখেছি একজন চা বিক্রেতা বিশ্বকাপ এলে তার টি-স্টলে কিভাবে পরম মমতা আর ভালোবাসায় তার প্রিয় দলের পতাকা উড়ায়! রাইভাল দলের ফ্যানরা কিছু জিজ্ঞেস করে সেও তৃপ্ততার হাসি হেসে বলে- মামা, দেখে নিয়েন কাপ এবার আমাগো..
কিংবা গলির মুখের মুদি দোকানে কাজ করা ওই ছেলেটা; যে কিনা সারাদিন খুব ভালো ভাবে কাজটাজ করে- সন্ধ্যা হলেই বলবে- মামা আজকে তাত্তাড়ি যামুগা, ব্রাজিলের ম্যাচ দেখন লাগবো! শপিং সেন্টার কিংবা রাস্তার পাশের দোকানগুলোও আগেভাগে দোকানের সাটার ফেলে দেয়। প্রিয় দলের খেলা কিছুতেই মিস দেয়া যাবেনা। সারাবছর টিভির ধারেকাছে না যাওয়া ছেলেমেয়েগুলাও সে সময় টিভি দেখতে বসে; প্রহর গুনে কখন শুরু হবে ম্যাচ! আমি এমন এক পাগলা ভক্তের দেখাও পেয়েছি; যিনি তার ৬ তলা বিল্ডিংয়ের পুরোটাই সাজিয়েছেন ব্রাজিলের ফ্ল্যাগের আদলে। সে বাড়ির নাম 'ব্রাজিল বাড়ি' এবং সেটা মোটামুটি একটা ব্রাজিলিয়ান ফুটবল মিউজিয়ামের মতোই! মাঝে মাঝে ভাবী- চলুক না এমন পাগলামি আর আবেগ দেখানো। সর্বোপরি জয় হোক ফুটবলের।
© আহমদ আতিকুজ্জামান
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৮ রাত ৮:৫১