মেয়েটার সাথে দেখা হলেই তার প্রাইভেটের কথা বলতে থাকে সারাক্ষণ।সে একটা মেয়েকে টিউশনি করায়।যার বাবা একজন আমদানি-রপ্তানী ব্যবসায়ী।সচরাচর দেশের বাইরে থাকেন।টিউশনিতে গিয়ে কবে কি খেল তার যখন বর্ণনা দেয় তখন অামার মত ব্যাচেলরের জিবে জল না এসে উপায় কি।মাঝেমধ্যে অাফসোস হয়, এরকম একটা প্রাইভেট হলে বেশ ভালই দিনকাল কাটতো।
মেসের খরচটা চালাতে অফিসে গিয়ে তিনঘন্টা হিসাব নিকাশে ঘুতোঘুতি করতে হতনা।তার সাথে অাবার মাঝেমধ্যে ডিনারের দাওয়াত।বুয়ার হাতের অত্যাধিক তেলের কাঁচাকাঁচা কুখাদ্যগুলো খেতে খেতে পেট যখন ঘুলাটে হয়ে যায় তখন ভালো কিছু দিয়ে পেটটা অন্তত ভালো করা যেত।
.
গতকাল ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির এক কোনে হঠাৎ মুরি বলে ওঠলো,
... রাহাত ! অামাকে একটা হেল্প করবি?
কিছুটা চিন্তায় পড়লাম। এ মেয়েটা অাজকাল যখন তখন সাহায্য চাইতে শুরু করেছে।
.. কিরকম সাহায্য ?
.. গ্রামের বাড়িতে ভাইয়া বিদেশ থেকে এসেছে।নতুন বাসা তৈরি করবে।অাগামীকাল বাড়ি যেতে হচ্ছে।অামার প্রাইভেট তুকে তিন-চার মাস পড়াতে হবে।না হলে প্রাইভেটটা থাকবে বলে মনে হয় না।জানিস তো কত ভালো প্রাইভেট।ওটা গেলে হোস্টেলের খরচ দেয়া বেশ ভারি হয়ে ওঠবে অামার।
কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
.. তারা কি পুরুষ টিচার নিবে?
.. অামি বলেছি যে পড়াবে সে দেশের একজন বিখ্যাত তরুণ কবি। অামার বেশ ঘনিষ্ট বন্ধু বলে অাপনাদের বাসায় রাজি হয়েছে।একজন কবির সাথে মেশা অাপনাদের খুব সহজ হবে। কবি বলতেই তারা বেশ লাফ দিয়ে মেনে নিয়েছে।এখন অামার থেকে বরং তারাই তুকে দেখার জন্যে বেশ উদগ্রীব।
.. অামি তো কবি নই।কবিতা অামার দ্বারা কখনো লিখা হয়নী। এতবড় একটা মিথ্যে বললি কেন?
.. অামার অার কোনো উপায় ছিলনা দোস্ত। এখন তুকে যা করতে হবে। খুব বিখ্যাত একজন কবি সাজতে হবে।চেহারা অার অাচরণে সবসময় একটা কবিত্বের ভাব ধরে রাখবি।
মেয়েটার কথা শুনে বেশ অবাকই হলাম।এত চালাকি শিখলো কবে থেকে সে।এইতো সেদিন ভার্সিটির প্রথম বর্ষে চা বাগানে তার সাথে ঘুরতে না যাওয়ায় বেশ কেঁদেছিল।অাজ এতটা পরিকল্পিত মিথ্যাচার কীভাবে শিখলো?
মুরির দেয়া ঠীকানা মত পৌছলাম।কলিং বেলে টিপ দিতেই কেউ একজনের ছায়া এসে পড়লো দরজায়।ডোর দূরবিন দিয়ে দেখে দরজা না খুলেই চলে গেল। মিনিট থানেক ওয়েট করে অাবার দিলে একজন ভদ্র মহিলা বের হলেন।
.. কাকে চাই?
.. এটা কি মনিদের বাড়ি ?
.. জ্বি।
.. অামি মনির নতুন টিচার হিসেবে পড়াতে এসেছিলাম।
ভদ্র মহিলা খানিকটা ইতস্তত হয়ে বললেন,
.. জ্বি।অাসুন অাসুন। অামরা সেই সন্ধ্যা থেকে অাপনার অপেক্ষায় অাছি।
ভেতরে ঢুকে ডায়নীং রুমে বসানো হল।রুমটা বেশ যত্ন করে সাজানো।অত্যাধুনিক সাজে সজ্জিত।বেশ মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।কারো নম্র ভদ্রোচিত সালামে তার দিকে তাকালাম।
.. অাসসালামু অালাইকুম স্যার !
.. অয়াস্সালাম।
ভদ্রমহিলা মেয়েটাকে দেখিয়ে বললেন, এই অাপনার ছাত্রী।নাম মনি।পরে কথা হবে। অাগে কিছু খেয়ে নিন।
খানিকটা হালকা-পাতলা এক মহিলা এসে বললো,
.. অাম্মাজান ! কবি সাবের জন্যে কি নাস্তা দিব? সব রেডি। চাল-চলনে বুঝা গেল, কাজের বুয়া।
ছাত্রী তখনই বলে ওঠলো, স্যার ! অাপনার জন্যে অামি চা, পানসুপারী জর্দা দিয়ে রেডি করে রেখেছি।কবি নজরুলের খুব পছন্দের খাবার ছিল বলে ভাবলাম অাপনারও পছন্দের হবে।
নজরুলের যা পছন্দ অামারও যে তাই হবে এমন কিছু অাছে? নজরুল পৃথিবীর অন্যতম কবিদের একজন।অাবার বঙ্গদেশের জাতীয় কবিও বটে, অার অামি সাধারণ একজন সাহিত্য প্রেমিক মাত্র। অাকাশ-পাতাল তফাৎ।
না না। মুহূর্তেই মনে হলো অামি কবি।অামায় কবি সাজতে হবে !
.. হ্যা ! পান-সুপারি অামার খুব পছন্দের।তোমাকে ধন্যবাদ অাগে বাগে পছন্দ অপছন্দ বুঝার জন্যে।
কলার জুস দিয়ে শুরু হল নাস্তা।তারপর একটার পর একটা অাসতেই লাগলো।এত ফল একসাথে দেখে নিজেই ভড়কে গেলাম।যাই হোক শেষ পর্যন্ত পানসুপারী দিয়ে শেষ হল।
নাস্তাপর্ব শেষ হলে ছাত্রীকে বললাম,বই নিয়ে অাসো। পড়ানো শুরু করি। তৎক্ষণাৎ মা বলে ওঠলেন,পড়ার রুম অালাধা অাছে।চলুন অাপনাকে নিয়ে যাই।অামায় নিচ তলা থেকে দু তলায় নিয়ে অাশা হল।বিশাল বড় রুম।দেয়ালে বেশ কয়েকজন কবির ছবি টাঙ্গানো।
নজরুল, রবীন্দ্রনাথ অার অাল মাহমুদের সংক্ষিপ্ত জীবনীর কয়েকটা ক্যালেন্ডার শোভা পাচ্ছে।ডানপাশে ছোট্ট একটা সেল্ফ ভর্তি কবিতার বই।বেশিরভাগ বিদেশী কবিদের। যাদের চেনা অামার পক্ষে ভার। কারণ অামি তো কবি নই। কপি !
সবচেয়ে অবাক হলাম টেবিলের দিকে তাকিয়ে। ওপর পাশে একজন ভদ্রলোক বসে অাছেন।বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। চেহারায় বেশ বয়সের ছাপ পড়েছে বলে দেখে যে কেউ বলবে পয়ত্রিশের কম হবে না। সামনে একটা কাগজ।সেখানে কিছু প্রশ্ন লিখা ।ভদ্র মহিলা পরিচয় করিয়ে দিলেন।এ অামার বোনের বড় ছেলে। গতকাল গ্রাম থেকে এসেছে।অাজ চলে যেতে চেয়েছিল।ভাবলাম কবির সাথে একটু দেখা করে যাক।
সালাম দিতেই ভদ্রলোক বসতে বললেন। চেয়ারে বসতেই প্রশ্ন লেখা কাগজটা অামার সামনে দেয়া হল।পাশে ভদ্র মহিলা দাঁড়ানো।পাশের রুমের দরজায় পর্দা ফাক করে ছাত্রী উৎসুক চেহারা নিয়ে তাকিয়ে অাছে।এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন অামি দেখতে না পাই।প্রশ্নগুলো ছিল এরকমই,
১. বাংলাদেশের বর্তমান শ্রেষ্ঠ কবির নাম কি?
২. Past perfect tense এর structure
3. (a+b)(a-b) এর সূত্র সহ অারো কিছু হাবিজাবি।
ভুরো কুচকে ভদ্রলোকের দিকে থাকিয়ে উত্তরগুলো লিখে দিলাম।উত্তরপত্র হাতে নিয়ে একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে বললেন।
.. চমৎকার।সব সঠীক হয়েছে। অাপনী অতি উত্তমভাবেই পাশ করেছেন। মনিকে পড়াতে পারেন।
অামি বেশ জোরে একটা হাঁসি দিয়ে মনিকে ডাক দিলাম,
..এক কাপ লাল চা নিয়ে অাসো। মনি বেশ তাড়াতাড়িই চা এনে টেবিলে রাখলো। চুমুক দিতে দিতে বললাম, অাপনাকেও একটা পরীক্ষা দিতে হবে। ভদ্রলোক বেশ অবাক হয়েই প্রশ্ন করলেন,অামাকে কেন পরীক্ষা দিতে হবে?
.. একটা ক্লাস এইটের মেয়েকে পড়াতে একজন অনার্স লেবেলের ছাত্রের যদি পরীক্ষা দিতে হয় তবে সে শিক্ষকের কাছেপড়াতে হলে অভিবাবককেও পরীক্ষা দিতে হবে।একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললাম "ক থেকে স "পর্যন্ত লিখুন।
ভদ্রলোক খানিকটা রেগে বিষ্ময় নিয়ে অামার দিকে তাকালেন।তবে এত সহজ প্রশ্ন করায় মনে মনে অনেকটা খুশি হয়েই
লিখতে শুরু করে দিলেন।
ছাত্রীর মা অামার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছেন।ছাত্রী পানি দিয়ে অাগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ জোরে জোরে চায়ে চুমোক দিয়ে চা খাচ্ছি।কিন্তু সমস্যা ঘঠলো পাচ-ছ'টা চুমোক দেয়ার পর।ভদ্রলোক ম পর্যন্ত লিখে অার সামনের দিকে এগোতে পারছেন না।মাথা কচলিয়ে বারবার মনে করতে চেষ্টা করছেন। শেষপর্যন্ত অপারগ হয়ে ছাত্রীর দিকে সাহায্যের অাবেদন নিয়ে তাকালেন।টান দিয়ে উত্তরপত্রটা অামার কাছে নিয়ে অাসলাম।
ব্যাগ কাধে নিয়ে বের হচ্ছিলাম। দরজা থেকে অাবার ভদ্রলোকের দিকে দু পা গিয়ে বললাম
.. ও হ্যা অাপনী ফেল করেছেন।
বাসায় এসেই মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।এত ভালো প্রাইভেট পেয়েও ছাড়লাম। অাজ এতটা রাগ অাসলো কোথা হতে। অামিতো রাগী না।ঠান্ডা মাথার মানুষ। ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি,কিংবা রাগ ওসব তো অামার বৈশিষ্ট্য না।তবে কি ঐ জর্দা দিয়ে পানসুপারী হঠাৎ খাওয়ায় মাথা গরম হয়ে গেছিল।মাথাটা এখনো ভনভন করছে।জর্দার প্রতিক্রিয়া যে এখনো চলছে তার স্পস্ট প্রমাণ পাচ্ছি।দুটা বিস্কিট খেয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করলাম।
রাত এগারটার দিকে মুরি ফোন দিল.,
... দোস্ত ! অাজ গেছিলি ওদের বাসায়?
.. হুম।
... পছন্দ হয়েছে? অাদর-অাপ্যায়ন করেছে?
.. হুম।
.. কনফার্ম করে এসেছিস?
.. হুম।
.. গ্রেট দোস্ত।এইতো অামার লককক্ষী
দোস্ত।
.. হুম।
.. কিরে শুধু হুম হুম করছিস কেন? মন খারাপ।
অামি ফোন কেঠে মোবাইল অফ করে শুয়ে পড়লাম।বেশ খানিকটা গড়াগড়ি করলেও ঘুম অাসলো না।ওঠে বেলকনিতে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।অাকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি। অাজকের অাকাশটা বেশ মেঘাচ্ছন্ন। চাঁদ মামা মাঝে মধ্যে এসে উকি দিচ্ছে।বেশ মুগ্ধ হয়ে চাঁদ অার মেঘের খেলা দেখতে লাগলাম।
কি দরকার ছিল রাগারাগি করে উনার পরীক্ষা নেয়ার।বাসায় একজন গৃহ শিক্ষক রাখবে, শিক্ষকের যোগ্যতা পরীক্ষা করে রাখতেই পারে।টাকা তো অার কম দিচ্ছে না। মাসের পাঁচ তারিখেই হাজার অাটেকের চেক হাতে গুজে দেবে।তারওপর অাবার প্রতিদিনকার চা নাস্তা।অার মাঝেমধ্যে ডিনারের দাওয়াত তো অাছেই।যা প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে হাজার পাঁচেকের দরকার।
মোবাইলটা অন করা দরকার। মুরিকে সব খুলে বলতে হবে।অন্যতায় তারও প্রাইভেটটা চলে যেতে পারে।নিজের ক্ষতি হলে হোক অন্যের ক্ষতি করে কি লাভ। মোবাইলটা অন করতেই একটা নতুন নাম্বার থেকে কল অাসলো। রিসিভ করেই বুঝতে পারলাম অাজকের প্রাইভেট থেকে।
.. অাসসালামু অালাইকুম।
.. অয়ালাইকুমুস সালাম। অাজ সন্ধ্যার পর যে প্রাইভেটে এসেছিলেন সে বাসার মনির মা বলছি।
.. অহ ! জ্বি বলুন।
.. অামি অাসলে দু:খিত। অামার বোন পুত্রের সব অাচরণের জন্যে অামি অাপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অামি তাকে অাগেই বলেছিলাম। ওভাবে পরীক্ষা টরিক্ষার ঝামেলা করলে কবি রাগ করতে পারেন।তখন বুঝতে পারেনী।সে নিজেও এখন খুব অনুশোচনায় ভূগছে।বারবার বলছে, একজন কবির সাথে অামার ওরকম করা মোটেও ঠীক হয়নী।অাজ তার চলে যাওয়ার কথা ছিল।যায়নী শুধু অাপনার কাছে কাল ক্ষমা চেয়ে নিবে বলে। দয়াকরে কাল একবার অাসুন।
.. অামি দু:খিত। অাপনাদের বাসায় অামার পক্ষে অার পড়ানো সম্ভব না। এ শহরে রাস্তায় রাস্তায়, কারেন্টের প্রতিটি খুটায় গৃহ শিক্ষক দিচ্ছি নিচ্ছি দিয়ে এড দেয়া অাছে।সেখান থেকে যেকোনো একজনকে রাখতে পারেন।অাপনী অামার মায়ের মত। দয়াকরে ওভাবে অার অনুরোধ করে বিব্রত করবেন না।
.. তা তো পারতাম। কিন্তু অামার মেয়ে কান্নাকাটি করছে।এই কবি ছাড়া অন্য কারো কাছে সে পড়বে না।বাচ্চা মেয়ে।কি করবো বলুন তো !
.. দু:খিত। অামি কবি নই।অামি একজন সাধারণ ছোটগল্পের পাঠক মাত্র।কবির অভিনয় ছিল সব মিথ্যে।
.. সে যাই হোক।অামার মেয়ে অাপনী ছাড়া অন্য কারো কাছে পড়বেই না।তার এক কথা।সামনে পরীক্ষা। দয়াকরে বিষযটা একটু ভেবে দেখুন।
বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম।ভদ্র মহিলা তবে অার ছাড়ছেনই না।ধুর এত ভাব নেয়ার কি দরকার।কথায় অাছে না, "দিলে খায় না, অার মাগীতে পায় না।" বেশি না ভেবে সোজাসোজিই বলে দিলাম, ঠীক অাছে। কাল সন্ধ্যার পর তবে দেখা হচ্ছে।