জেলখানার কাছ থেকে বলছি

ভর দুপুরবেলা আমি আর বন্ধু নীলক্ষেত এর বইয়ের দোকানে উঁকিঝুঁকি মারিতেছিলাম। কিন্তু শুধু বই দেখিয়া মন ভরিলেও পেট খালিই থাকিয়া যায়। তাই খালি পেট ভরিবার উদ্দেশ্যে আমি আর বন্ধু রিকশাযোগে ঢাকা জেলখানা অভিমুখে রওয়ানা হইলাম।
পাঠক, তুমি ভুল বুঝিতেছ। বাংলা ছায়াছবির কোন নায়ককে জেলখানা থেকে বাহির করিয়া পুষ্পমালা সহিত অভ্যর্থনা জানাইবার কোন ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। আমাদের গন্তব্য ছিল জেলখানা সংলগ্ন নাজিমুদ্দীন রোডের বিখ্যাত “নিরব হোটেল’’। পথিমধ্যে আমাদের জ্ঞানী বন্ধুর (তাহাকে তুমি চেন। রসগোল্লা দ্রষ্টব্য) বিদ্যাপীঠ ক্রশ করিতেছিলাম। মুঠোফোনে কহিলাম, বন্ধু তুই কোথা? চ’ দ্বিপ্রহরের খাবার খাইতে যাই। বন্ধু নানারূপ দুঃখ প্রকাশ করিয়া জানাইলো যে, তাহার ব্যবহারিক কাজকর্ম (ক্লাস) ছাড়িয়া সে আসিতে পারিবে না। আমি যদি আগে জানাইতাম তবে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাহাকে সমবেদনা জানাইয়া মুঠোফোন রাখিলাম।
জেলখানার সামনে দিয়া কিছুদূর যাইবার পর আমরা বুঝিলাম, রিকশাওয়ালা পথ হারাইয়াছে! কোন এক দোকানে নিরব হোটেলের সন্ধান জানিতে চাইবার সাথে সাথে চার-পাঁচজন মিলিয়া আমাদের সন্ধান বাতলাইয়া দিল। আমরা পুরাতন ঢাকার বাসিন্দাদের সাহায্য প্রবণতার প্রশস্তি গাইতে গাইতে নিরব হোটেলের সামনে থামিলাম। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ একখানা হোটেলের এত সুনাম কেন চিন্তা করিতে করিতে তৃতীয় তলায় ও উঠিলাম। (মাঝখানে যে বিশ্রাম নিতে হইয়াছিল তাহাকে অগ্রাহ্য করুন)
হোটেলের এক কোণে আরাম করিয়া বসিলাম। কিছুক্ষণ পর বেয়ারা আসিয়া জিজ্ঞেস করিল কি খাইব। আমি আর বন্ধু দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। তা দেখিয়া বেয়ারা বলিল, যা যা আছে সব নিয়া আসিতেছি। যা খাইতে ইচ্ছা করিবে খাইবেন। আহা! মধু মধু! এমন একটা খাবার দোকানই তো খুঁজিতেছিলাম। বাবা বেয়ারা তোমার শনৈ শনৈ পদোন্নতি হোক।
বন্ধু আর আমি হাত ধুইয়া বসিলাম। বেয়ারা আস্তে আস্তে বিভিন্ন খাবার দাবার আনিয়া টেবিল ভরাইল। ৬-৭ রকমের ভর্তা ভাজি, রুই মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছ, কই মাছ, মুরগীর মাংস আনিয়া কহিল, এইগুলা খাইতে থাকেন। আরো আনিতেছি। আমি আর বন্ধু ব্যস্ত হইয়া বেয়ারাকে থামাইলাম। করলা ভাজি, বেগুন ভাজি আর কই মাছ ফেরত দিয়া কহিলাম, এতেই চলিবে। ও আর সাথে দুই প্লেট ভাতও ছিল।
হৃষ্ট চিত্তে আমরা খাওয়া শুরু করিলাম। প্রথমেই মসুর ডাল ভর্তা। ডাল ভর্তা এমনিতেই সুস্বাদু। তাই আমি আর বন্ধু কাড়াকাড়ি করিয়া ডাল ভর্তা শেষ করিলাম। বেয়ারা এর মধ্যে এক খানা বড় বাটিতে আরো ভাত দিয়া গেল। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হইতে লাগিল, এই মহাশয় মনোবিজ্ঞান লইয়া কখনো পড়াশোনা করিয়াছে কিনা।
ডাল ভর্তার পর বেগুন ভর্তা আর বরবটি ভর্তা খাইলাম। বন্ধু ততক্ষণে মুরগীর মাংসের দিকে হাত বাড়াইয়াছে। আমি তাহাকে শাকসবজির উপকারিতা সংক্রান্ত থিসিস পরিবেশন করিতে করিতে কাঁচকলা ভর্তার দিকে অগ্রসর হইলাম। এই ভর্তা খাইয়া মনে হইলো, কাঁচকলা খাও কিছুতেই কোন গালি হইতে পারেনা। এরপর থেকে কেউ কাঁচকলা খাইতে বলিলেই ভর্তা বানানোর জন্য প্রস্তুত হইয়া যাইব। বন্ধুকে বলিলাম, এই কাঁচকলা ভর্তা না খাইলে তোর জীবনই বৃথা। বন্ধু একটুখানি নিল। তাহার অভিব্যক্তি দেখিয়া বুঝিলাম তাহার মনে বাকিটাও সাবাড় করিবার কুবুদ্ধি চাপিয়াছে। চোখ রাঙ্গাইয়া কাঁচকলাকে বন্ধুর হাত থেকে উদ্ধার করিলাম।
চার রকম ভর্তা শেষ করিবার পর মনে হইলো, ডাল ভর্তা আরেকটু থাকিলে ভালো হইতো। দুঃখভারাক্রান্ত মনে রুই মাছ ভাজার দিকে হাত বাড়াইলাম। বন্ধু দেখি করুণ চোখে রুই মাছের দিকে তাকাইয়া আছে। ঘটনা কি!
বন্ধু দুঃখিতমনে জানাইল, মাছের কাঁটা বাছিতে পারেনা বলে সে মাছ ভাজার স্বাদ হইতে বঞ্চিত! হঠাৎ মনে হইলো বাঙ্গালী জাতির ঐতিহ্য রক্ষা করার দায়িত্ব আমার উপরই বর্তিয়াছে। মাছে ভাতে বাঙ্গালী মাছ খাইতে পারিবেনা! এও কি সম্ভব! তাই আমি নিজ হস্তে তাহাকে মাছ বাছিয়া দিলাম। সাথে হুমকিও দিলাম, এর পরেও মাছে কাঁটা পাওয়া গেলে বিনা বাক্যব্যয়ে গিলিয়া ফেলিতে হইবে। এই সুযোগে তাহার মাছ ভাজার অধিকাংশই আমি খাইয়া ফেলিয়াছিলাম অবশ্য।
তারপর ভাত রিফিল করিয়া মুরগীর মাংস খাইলাম। সবশেষে চিংড়ি মাছ খাওয়া শুরু করিলাম। বন্ধু ততক্ষণে খাওয়া শেষ করিয়া হাত ধুইয়া আসিয়াছে। আমার অক্লান্ত খাওয়া দেখিয়া অবাক হইতেছে দেখিয়া আমি কহিলাম, সবকিছু একসাথে মিলাইয়া খাইলে তো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ হবেই। প্রত্যেক তরকারি আলাদা আলাদা না খাইলে স্বাদ বুঝবি ক্যামনে!
চিংড়ি মাছ আমার খুবই পছন্দের খাদ্য। চিংড়ি মাছ ভাজা, নারিকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি মালাইকারি, শাক দিয়ে চিংড়ি রান্না দেখলেই আমার ক্ষুধা প্রবলতর হয়। তাই আয়েশ করিয়া একটা একটা করিয়া তিনটা মাঝারি সাইজের চিংড়ি গলধকরণ করিলাম। সে কি স্বাদ! মনে হইলো সময় থমকে দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু বন্ধুর তাড়া ছিল। তাই খাওয়া শেষ করিলাম।
শেষে শশার টুকরা খাইতে খাইতে বন্ধুকে জ্ঞান দিলাম- শশা খাইলে মোটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। বন্ধু হাসিতে হাসিতে কহিল, এত খাওয়া দাওয়া করিবার পরে এক টুকরা শশা খাইয়া তোমার কোন লাভই হইবেনা। থাকুক গে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! এতক্ষণ পানীয় খাইনাই বেশি খাইতে পারিবনা দেখিয়া। অবশেষে এক বোতল কোকাকোলা খাইয়া তৃষ্ণা নিবারণ করিলাম।
উঠতে উঠতে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করিলাম সবচাইইতে ভালো লাগিয়াছিল কি খাইতে। বন্ধু কহিল- মাছ ভাজা। অবশেষে বাঙ্গালী ঐতিহ্য রক্ষা পাইয়াছে ভাবিয়া খুশিতে ডগোমগো হইয়া গেলাম। আমার অবশ্য সবচাইতে ভালো লাগিয়াছিল চিংড়ি মাছ। তবে আমরা দুইজনেই ডাল ভর্তাকে বিশেষ সুস্বাদের পুরষ্কার দিতে সম্মত হইলাম।
হোটেল থেকে বাহির হইবার সময় মনে হইলো এই এলাকার বিখ্যাত বাকরখানি খাইনা অনেক দিন। একখানা ছোট্ট দোকান থেকে এক প্যাকেট বাকরখানি কিনিলাম। বাটীতে যাইয়া খাইব বলিয়া আনন্দে প্রায় নাচিতে নাচিতে ফিরিলাম। বাটীতে আসিয়া দেখি বাকরখানি খাওয়ার মত শক্তি অবশিষ্ট নাই। নিজেকে সাবধান করিয়া দিলাম। ভবিষ্যতে এত বেশি খাওয়া যাইবে না।
সন্ধ্যায় বাকরখানির মোড়ক উন্মোচন করিলাম। নানা রকম উৎকন্ঠা আমাকে ঘিরিয়া ধরিল। বাকরখানির যেইরূপ স্বাদের কথা মনে আছে ইহা সেইরূপ হইবে কি! একখানা বাকরখানিতে কামড় দিয়া আমার যাবতীয় উৎকন্ঠা দূরীভূত হইল। আহা! সেই হাওয়াই হাওয়াই স্বাদ। নোনতা বাকরখানির কোথায় যেন একটুখানি মিষ্টি! খাইবার সময় দেখি জ্ঞানী বন্ধু মুঠোফোনে বার্তা পাঠাইয়াছে। আমি তাহাকে যাইবার কথা আগে বলিনাই দেখিয়া তাহাকে দারূণ মনঃক্ষুণ্ণ মনে হইলো। আমি ভাবিলাম লিখিব- হায় বন্ধু তুমি জাননা তুমি কি হারাইয়াছ। কিন্তু বাকরখানি আমাকে তা লিখিতে দিলনা। আমি হারাইয়া গেলাম।

বি।দ্র।- নিন্দুক কে জানাইতেছি দ্বিপ্রহরে বেশি খাইলেও আমি সকালে এবং রাত্রে কিছু খাইনাই। তাই আমার বেশি খাওয়া নিয়া জল্পনা কল্পনা না করিলেও চলিবে।