আজ মিতুল আত্মহত্যা করবে। হুট করে কারো সাথে ঝগড়া করে মরে যাওয়া নয়। অনেক দিন ধরে চিন্তা ভাবনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। এমনভাবে মারা যেতে হবে যাতে কিছুতেই কেউ টের না পায় যে এটা একটা অস্বাভাবিক মৃত্যু।
ওর পরিকল্পনা খুঁতহীন। মনে মনে ও অবস্থাটা কল্পনা করছে। ওর নিঃশ্বাস পড়ছেনা দেখে ডাক্তার চাচাকে খবর দেয়া হল। ডাক্তার চাচা হতাশ হয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলছেন, এতো অল্পবয়সী মেয়ে হার্ট এ্যাটাকে মারা গেল কিভাবে! মা নিশ্চয়ই কান্না চাপার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ওর এতদিনের সব প্রাণের বন্ধুদের খবর দেয়া হয়েছে। সবাই ভিড় করে আছে ওর চারপাশে। হয়তো ওদের কারো কাছে ওর দুষ্টুমি ধরা পড়ে যাবে। ওর উপর প্রচন্ড অভিমান করবে। বন্ধুদের কারো কি তাকে খবর দেয়ার কথা মনে হবে! সে কি ওকে শেষবারের মতো দেখতে আসবে!
মরে যাচ্ছে বলে খারাপ লাগছেনা মিতুলের। শুধু কেমন যেন অবসাদ লাগছে। সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। চাইলে এখনি মরে যাওয়া যায় ভাবতেই খুশি হয়ে উঠল ও। রাতেরবেলা পানিতে গোলাপ পাঁপড়ি ডুবিয়ে রেখেছিলো। সেই পানি দিয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করলো। মায়ের নীল রঙের শাড়ীটা যত্ন করে পরছে এমন সময় ওর মনে হলো, নীলাম্বরী শাড়ী নিয়ে এতো মাতামাতি কেন? নীল শাড়ীতে কি সব মেয়েকেই খুব রূপসী মনে হয়! মরার আগে তথ্যটা জেনে নিতে পারলে হতো। তারপর আয়োজন করে চোখে কাজল লাগালো মিতুল। নিজেকে আয়নায় দেখে সন্তুষ্ট একটা হাসি ফুটল ওর মুখে।
বিশাল একটা সম্বোধনহীন চিঠি লিখলো তারপর।
সেদিনের কথা মনে আছে? প্রথম যেদিন আমাকে বলেছ যে, হয়তো আমরা একসাথে থাকতে পারবোনা। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছিলো সেদিন। ঝাপসা চোখে হাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো এখনি গাড়ীচাপা পড়বো। পরদিন তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত বুকে পাথর চেপে রাখার মত কষ্ট হচ্ছিলো। তারপর তুমি যখন বুঝিয়ে বললে তখন মনে হলো আসলে জেদ ধরে লাভ নেই। আমি তোমাকে যুদ্ধে পাঠাতে পারিনা। তাই মেনে নিলাম। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে আমি কেন কাঁদছি, এটা স্বপ্নভঙ্গের কান্না কিনা। আমি উত্তর দিইনি। কিন্তু জানো ওটা স্বপ্নভঙ্গের কান্নাই ছিলো। আমাদের একসাথে কত্তো কিছু করার কথা ছিলো। আমি ভাবতাম সারা জীবনেও এতো পরিকল্পনা সফল করা যাবেনা। সেই সব পরিকল্পনা আমি এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিলাম। ঠিক উড়িয়ে দেয়া নয়, কাজটাকে আমার হত্যা মনে হচ্ছিলো। আমি একটা একটা করে আমার স্বপ্নগুলোকে হত্যা করলাম।
একদিনে পারিনি। অনেক সময় লেগেছে। যখনি কোন পরিকল্পনার কথা বলতে চেয়েছি তখনি মনে মনে সে পরিকল্পনাটার গলা টিপে ধরেছি। কারণ আমি চাইনি এটা নিয়ে তোমার মনে কোন দুঃখ থাকুক যে তুমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারোনি। আমার মনে হতো তুমি আমার কথা ভেবে এমনিই অনেক কষ্ট পাচ্ছ। তাই যদ্দিন পারি তোমাকে অনেক খুশি রাখতে চেয়েছিলাম। সারাক্ষণ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করতাম। এক আমি আমাকে বকতো, আমি কেন জোর করে তোমাকে আমার কাছে রেখে দিচ্ছিনা। আরেক আমি তোমার পক্ষে যুক্তি দেখাতো। শেষ পর্যন্ত তোমার পক্ষই জয়ী হতো। আমার সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা হবে এ আর নতুন কি!
তখন আমি কিছু সস্তা ধরনের রসিকতা আবিষ্কার করলাম। তুমি যখন অনেক দূরের হয়ে যাবে তখন আমি কীভাবে তোমাকে দেখবো, অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হয়ে গেলে কি গান গাবো এইসব ফাজলেমী। কি গান ঠিক হয়েছিল জানো? “আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল। কতো সুর, কতো গান মনে পড়ে গেল। বলো ভালো আছো তো?”
কিন্তু আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতে পারছিলাম না। আমাদের স্বপ্নগুলোর জন্য কষ্ট হচ্ছিলো। নিঃশ্বাস নিতে না পারার মতো কষ্ট। আমি কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু একদিন ঈশানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলাম। তখন আমি ওকে কি বলছিলাম জানো? “আমার যদি সবসময় একা থাকতে হয়! যদি একটা মৃত্যুর মতো ঠান্ডা ঘরে আমাকে একলা একলা মরে যেতে হয়!” একা থাকাকে ভীষণ ভয় আমার। এই ভয়টা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। তখনো আমি তোমাকে কিছু বলিনি। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকবো। নিজেকে আমি স্বান্তনা দিচ্ছিলাম এই ভেবে, যদি তোমার বড় কোন অসুখ হতো তাহলে তো আমি তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে যেতাম না। তোমার পাশে থেকে শেষ পর্যন্ত তোমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করতাম। তোমাকে শক্তি যোগানোর চেষ্টা করতাম। এখন নাহয় তাই করবো। আমি তাই করছিলাম। হয়তো সেজন্যই অনেক কিছু আমার নজর এড়িয়ে গেছে। আমি একটা ভ্রান্তিকে আঁকড়ে ধরে চুপচাপ ভালো থাকার ভান করছিলাম।
যেদিন আমি জানতে পারলাম সেদিন তাই দুঃখের চেয়ে অবাক বেশি হয়েছিলাম। মাথার ভেতর গীর্জার ঘন্টার মতো বাজছিল, কেন কেন কেন। তুমি আমাকে কি বলেছ মনে আছে? তুমি বলেছ, “ও আমাকে এতো সুন্দর সব স্বপ্নের কথা শুনিয়েছে যে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, নিরাপদ জীবনের স্বপ্ন।”
বিশ্বাস করো আমার তখন প্রচণ্ড হাসি পেয়েছে। আকাশ ফাটিয়ে হা হা করে হাসতে ইচ্ছে করেছে। তোমার জন্য আমি নিজের স্বপ্নগুলোকে খুন করতে একটুও দ্বিধা করিনি। আর সেই তুমি………
তোমাকে আমি তখনো কিছু বলিনি। তোমাকে আমার কাছে রেখে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। জানি আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। কিন্তু আমার স্বপ্নগুলোর মৃত্যুর গল্পটা আমাকে মেরে ফেলছে। আমি সত্যিই আর পারছিনা।
চিঠি লেখা শেষ হয়েছে। আড়ং থেকে কেনা কতগুলো সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালালো মিতুল। ঘরময় শান্তি ছড়িয়ে পড়লো যেন। হ্যাঁ, এখনই সময়। তার চিঠিটা কীভাবে পৌঁছাবে বুঝে উঠতে পারছেনা। একটা মোম এর উপর চিঠিটা ধরলো সে। আস্তে আস্তে চিঠিটা পুড়ছে আর ঠিক তখনি পৃথিবীর সবাইকে মাফ করে দিল ও। কারো উপর আর কোন রাগ নেই। এবার শুধু শান্তির ঘুম।
একটা একটা করে মোমবাতিগুলো নেভাল ও। মনে হলো, এত্ত এত্ত ভালোবাসা; মা-বাবার, বোনদের, বন্ধুদের, ছোট্ট ভাগ্নে তাতাই এর এগুলোকে স্রেফ লাথি মেরে চলে যেতে পারেনা ও। ওর অধিকার নেই। তাই সব্বাইকে শেষবারের মতো একটা সুযোগ দিলো মিতুল। তাদের বিশেষ জায়গায় সে অপেক্ষা করে আছে। আবারো আয়না দেখে চুল ঠিক করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মিতুল। তাড়াতাড়ি তার কাছে যাওয়া প্রয়োজন ওর। এখনো অনেক অনেক ভালোবাসার কথা বলা বাকি যে!