বহু দিন কোন বই পড়া হয় না । ইদানিং ধৈর্য ও অনেক কমে গিয়েছে । প্রায়ই সময় কোন বই পড়তে শুরু করি , তারপর প্রায়ই সেটা থেকে যায় অসমাপ্ত । পাতার পর পাতা উল্টে তো আরও পড়া হয় না ।
ফ্রেন্ডের বাসায় যেয়ে একটা নতুন বই দেখলাম। মৈত্রেয় জাতক , বানী বসুর । পড়া শুরু করলাম , ওর কথা মনোযোগ দিচ্ছিনা , দেখে রেগে গিয়ে বই টা নিয়ে গেল । বই টা তাই অর্ধ সমাপ্ত । বইটা ছিল সিদ্ধার্থের উপর কিংবা ওই সময়কার ।
সিদ্ধার্থের উপর কোন বই পড়ি নি , ইন্টারেস্টিং লাগলো । বাসায় এসে সার্চ দিয়ে নামালাম , তথাগত , দ্বৈপায়নের । অনেক ভাল্লাগছে । অর্ধেক পড়ে শেষ থেকে পড়া শুরু করলাম , জানতে ইচ্ছে করছিল কেন , কি অবস্থায় উনি যশোধারাকে রেখে গৃহ ত্যাগ করলেন ?
সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধ সম্পর্কে যা জানি , কোন এক জোসনা রাতে , উনি গৃহ ত্যাগ করেছিলেন ......
“ গৌতমবুদ্ধ , একটি দর্শন, একটি ধর্ম একটি ভাবধারার প্রচারক এই অপ্রতিম মানব পুত্রটি ।
জন্ম সূত্রে রাজপুত্র তিনি , কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে নেমে এসেছিলেন পথে , সিদ্ধার্থ অথবা গৌতম থেকে পরিণত হয়েছিলেন তথাগত বুদ্ধে ।
কিন্তু এই যে রূপান্তর , সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হয়ে ওঠার এই যে দুস্তর প্রক্রিয়া –এর উৎস কোথায়?
প্রচলিত গল্প কথা আমাদের জানায় , জরা, ব্যাধি আর মৃত্যুকে স্ব-চক্ষে দেখার পর জীবনের অর্থ ভাবিত করে সিদ্ধার্থ কে , তারপর এক সন্ন্যাসিকে দেখে পথ খুঁজে পান । রাজপথের হাতছানি , স্ত্রী –পুত্রে ঘেরা সংসারের শান্তিছায়া । বৈভব মণ্ডিত জীবনের নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে সত্যের সন্ধানে যাত্রা করেন তিনি ।
উপন্যাসের প্রথম খণ্ডটি সিদ্ধার্থের প্রথম জীবন থেকে গৃহত্যাগ পর্যন্ত ।
তার জীবনের বাঁক মোড় পেরোনোর পথেই এসেছিলেন স্ত্রী যশোধারা পুত্র রাহুল ।
একজন রাজপুত্র , ঘরে তাঁর সুন্দরী স্ত্রী , আকাংখিত সন্তান –কোথাও কোন ফাঁক নেই । অথচ , ইতিহাস জানাচ্ছে , তবুও ঘর ছারলেন সিদ্ধার্থ, পা রাখলেন পথে ।
সত্য মুখী দীর্ঘ যাত্রার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ যে ছিলই ,তা অস্বীকার করার উপায় নেই ।কিন্তু আরও কিছুও কি ছিল ?
দ্বৈপায়ন সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হয়ে ওঠার পথরেখা টি তিনি খোঁজার চেষ্টা করেছেন যুক্তির আলোয় ।”
কপিল বস্তুর রাজপুত্র হলেও জন্মেছিলেন লুম্বিনি গ্রামে ।তার জন্ম মৃত্যুর সময়কাল অজ্ঞাত ।তবে কপিল বস্তু নগর প্রতিষ্ঠার যে গল্প দ্বৈপায়ন লিখেছেন তা চমকপ্রদ ।
অয্যোধ্যার রাজা সুজাত । রাজা মশাই জেন্তিকে ভালোবাসেন । জেন্তি কোন রাজমহিষী না । সাধারন রক্ষিতা । জেন্তির উপর খুশি হয়ে সুজাত জানতে চাইলেন জেন্তি কি চায় ? রাজা মশাই তাই দিতে রাজী ।
মহা সর্বনাশ করলো জেন্তি ।চাইল সে একটাই জিনিষ ,তার পুত্রকে যুবরাজ করতে হবে।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন রাজা , কিন্তু মুখের কথা ফিরিয়েও নিতে পারলেন না ।
তাই অয্যোধ্যার নৃপতির পাঁচ পুত্র বহিষ্কৃত হল রাজ্য থেকে । তারাই পরে কপিল বস্তু প্রতিষ্ঠা করেন ।
পরবর্তীতে সুজাত অবস্য আবারও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ।
চমৎকার করে কুমার সিদ্ধার্থ কে চিত্রায়ন করেছেন দ্বৈপায়ন ।তার বাল্য কালের অনেক চিন্তা ভাবনা , আনন্দ বেদনা ভাবে তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন আরও অনেক অজানা কথা। যা আমরা সচরাচর জানি
না।।
সিদ্ধার্থ অন্যান্য কুমার দের মত নন । নির্লিপ্ত । ভাবিয়ে যান সবাইকে ।বিমাতা প্রজাবতী ভাবেন ।
ভাবেন রাজা শুদ্ধোদন । পুত্রের করকোষ্ঠী তে সন্ন্যাস চিহ্ন আছে । কেউ বলেছে পুত্র সংসারী হবে না ।গৃহত্যাগ করবে । কেউ বলেছে নিশ্চয়ই সংসারী হবে , পুত্রলাভও করবে !
পরশ তার ভৃত্য , বন্ধুর মত । কুমার সিদ্ধার্থকে পরশ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না । ঠিক কি কারনে কুমার এমন নির্মোহ !
প্রচণ্ড শীত কপিল বস্তুতে । অধিকাংশ মানুষেরই শীত বস্ত্র নেই ।
এ খুবই সাধারণ ব্যাপার কুমার - আশ্বস্ত করেন পরশ , মানতে পারেন না সিদ্ধার্থ, মানতে পারেন না কর্মফল হিসেবে দেয়া তার দুঃখ কষ্টের ব্যাখ্যা ।তার মনে হয়েছে পরশ খুব হৃদয়হীন ।
বিচিত্র আচরনের প্রেক্ষিতে পরশের জিজ্ঞাসা -- কুমার তুমি এমন কেন ?রাজপুরীতে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করলাম । দেখেছি কিছু কম নয় ।তুমি এমন স্বতন্ত্র হলে কেন ?
উত্তর দেন না সিদ্ধার্থ । হাসেন ।
তার ধাত্রী , কপিলা বলে , তুমি মানুষ না মরাল বুঝি না গো , মন তোমার ডানা মেলেই আছে ।
বিজ্ঞ অমত্য মাধব রত্ন কুমারকে পরম যত্নে ধৈর্য ধরে শিক্ষা , উপদেশ দিয়েছেন দিনের পর দিন ।
-কুমার তুমি নিষ্ঠাবান, আগ্রহী, কিন্তু বৈষয়িক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী নও । তুমি অন্য প্রকৃতির । কুমার আমি বিস্মিত হই, বুঝতে পারিনা তুমি এমন কেন ? বলেছেন অমত্য ।
প্রবীণের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে । ধরা পড়ে লজ্জিত হয়েছে ।
কুমার কে তিনি বলেছেন-- কুমার জীবন কিন্তু ভোগের জন্য ।
কুমার উত্তর দিয়েছেন ,জীবন ত্যাগের জন্য ও ।
বিস্মিত হন মাধব ।
-অবশ্যই ।তবে জীবনে যিনি ভোগ কি বস্তু জানলেন না , আমার মনে হয় ত্যাগের উপলব্ধি করা তার পক্ষে সম্ভব নয় ।
মহারাজ সর্বদা চিন্তিত । মনে সবসময় শঙ্কা । শাক্য বংশের কোন রীতিই সে অনুসরণ করে না । যৌবনের কোন উন্মদনা তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়না । চিন্তিত শুদ্ধদন জানেন সিদ্ধার্থের বিবাহের অসম্মতি । কোন কিছুই টানে না তাকে ।অবশেষে তিনি জানতে চেয়েছেন পুত্রের অভিমত ।
___আমি বিবাহে সম্মত , কিন্তু আমি যে কন্যা কে পত্নী রূপে গ্রহন করতে চাই , তার মধ্যে কিছু গুণ যেন থাকে ।
__অবশ্যই । পুত্রের মত সমর্থন করেছেন তিনি ।
কিন্তু কপিলবস্তুর নগরের গৃহে গৃহে ঘুরে এমন মেয়ের দেখা সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না । বিস্মিত হন শুদ্ধোদন । আশ্চর্য ! নগর কি কন্যা শূন্য হয়ে গেল নাকি !
শিল্পজ্ঞ দণ্ডপাণির কন্যা যশোধারা । সুন্দরী ও গুণবতী কন্যা , অবশেষে এক পুরোহিত খবর নিয়ে আসেন।
কিন্তু নগরের অনেক শাক্য দের আশা কুমার তাদের কন্যাকে পত্নী রূপে গ্রহণ করুক । তাই অমত্যদের পরামর্শে সকল কেই আমন্ত্রণ জানানো হোল , কুমার শাক্য কন্যা দের উপহার প্রদান করবেন ।
রীতিমত যশোধারার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন কুমার ।
কিন্তু মজার আর অভাবনীয় ব্যাপার হল দণ্ড পাণি কিন্তু খুশি হতে পারেননি ।রাজ্যে কুমারকে নিয়ে অনেক জন শ্রুতি ।তিনি সাধারন জীবন যাপন করেন , শিষ্যত্ব নিয়েছেন সন্ন্যাসির, কোন অপরিচিতা নারীর মুখ দর্শন পর্যন্ত করেননা ।চিন্তিত দণ্ড পাণি তাই রাজাজ্ঞা উপেক্ষা করে বসলেন !!
কুমার সিদ্ধার্থ কে কন্যা সম্প্রদান করবেন না দণ্ডপাণি ।
ভয়ানক রেগে গিয়েছেন রাজা শুদ্ধোদন । রাজার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেছে সামান্য এক প্রজা ।
কিন্তু মহারাজা জন শ্রুতি ব্যাপারটা জানেন , এটাও জানেন কুমার রীতিমত যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী , শিল্পজ্ঞ । অতঃপর শাক্যদের আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সব জন শ্রুতি ভঞ্জন করলেন কুমার সিদ্ধার্থ !!
অবশেষে দণ্ড পাণি কন্যা সম্প্রদানে সম্মত হলেন ।
বইয়ের শেষ দিকে এসে কিন্তু পাওয়া যায় , আবার সেই সিদ্ধার্থ কে । প্রসাদ বন্দী থেকে , অস্থির ,অতৃপ্ত সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করতে পারছেন তিনি সংসারের নন , সংসার তার নয় , সম্ভবত বিশ্ব সংসারটাই তার ।
সারথি ছন্দক এর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন মহারাজার বিনা অনুমতিতে কুমারকে নিয়ে নগর পরিদর্শনে যাবার নিষেধাজ্ঞা । তবুও ছন্দকের দৃঢ় উত্তর –কুমার আমি মহারাজার ভৃত্য । রাজাজ্ঞা পালন করাই আমার কর্তব্য । তবু আপনি যদি আজ্ঞা করেন , আপনার আজ্ঞা পালন করার জন্য আমি প্রস্তুত ।
“মধ্য রাত্রি অতিক্রান্ত । সন্ধ্যায় আকাশ নির্মেঘ । পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ (আষাঢ় পূর্ণিমা ) ।
সুপ্ত নগরী ।জনহীন পথ ।অশ্ব পৃষ্ঠে কুমার সিদ্ধার্থ । পদব্রজে সারথি ছন্দক ।
মহারাজা শুদ্ধোদন পুত্র কুমার সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগ করে চলছে । রাজ্য ঐশ্বর্য ভোগ সুখ কাম্য অনিত্য অস্থির ।তৃষ্ণার অন্ত নাই ।
ব্যথিত ছন্দকের জিজ্ঞাসা – আপনি কেন গৃহত্যাগ করবেন ?সুন্দরী ভার্যা , সন্তান,সুখ ঐশ্বর্য । আপনি সব পরিত্যাগ করে যাবেন না , আপনি আরও কিছুকাল ভোগ করুন ,সুখ অনুভব করুন ।
-ছন্দক, এ সকল কাম্য অপরিমিত ও অনন্তকল্প অনেক প্রকারে উপভোগ করেছি ।রুপ , রস গন্ধ স্পর্শ শব্দ সমস্তই অনুভব করেছি ।আমার তৃপ্তি হয়নি । ছন্দক তৃষ্ণার অন্ত নাই ।
-আপনি আর কোন দিনই ফিরবেন না কুমার ?
সিদ্ধার্থের মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে উঠলো । বলল , ফিরবো ছন্দক । ফিরে আসব বলেই তো আমার এই যাওয়া । ফিরতে হবেই । তবে কতদিন পর ফিরে আসা সম্ভব হবে আমি জানি না । শুধু জানি আমাকে ফিরতেই হবে।”
তথাগত প্রথম খণ্ড এই পর্যন্ত । দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে তার সিদ্ধার্থ হয়ে ওঠার গল্প । তৃতীয় খণ্ডে বুদ্ধত্ব লাভের পরের অধ্যায় । যদিও এই দুই খণ্ড নেটে খুঁজে পাইনি ।
যদিও বই টা পুরোপুরি শেষ হয়নি, অনেক ভাল লাগছে বইটা পড়ে । অসাধারণ একটা বই বিশেষ করে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে চমৎকার লেখা । পুরানো দিনের ঐতিহাসিক উপন্যাস এমনিতেও অনেক ভাল লাগে, অনেকটা শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস গুলোর মতো ।
লেখাটা লিখেছিলাম বেশ কয়েকটা বইয়ের ব্যাপারে , কিন্তু এখন শুধু সিদ্ধার্থের অংশটা ইলাবোরেট করে লিখলাম , লিখতে আমার ভালো লেগেছে , সিদ্ধার্থের উপর আমি মুগ্ধ ।
যদিও আমার আগ্রহ ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে সিদ্ধার্থের উপর , তার প্রচারিত ধর্মের উপর নয় ।
কিছু বিতর্ক যোগ্য প্রশ্ন ও আছে । গল্প গাঁথা আমাদের জানায় , সুজাতা নামক এক নারী তপস্যারত সিদ্ধার্থর জন্য পায়েস নিয়ে এসেছিলেন , সেই পায়েস খেয়ে শক্তি ফিরে পেয়েছিলেন তিনি । গল্প গাঁথার আড়ালে কোন গভীর তম সত্যি আছে কিনা তা খুঁজেছেন ঐতিহাসিকরা ।
পড়তে পারেন হেরমান হেসের সিদ্ধার্থের উপর লেখা এই পোস্টটা ও । রাবেয়া রব্বানি আপুর পোস্ট টা পড়েই লেখা টা এভাবে লিখলাম ।
মুভিও করা হয়েছে , হেরমান হেসের সিদ্ধার্থের উপর , ব্লগে একটা রিভিউ আছে , কনরাড রকসের সিদ্ধার্থ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:০৪