মেঘের জল যেন চুয়ে চুয়ে টিনের চাল থেকে পড়ছে, ঠিক যেমন অভিমানে আদির চোখে শ্রাবণের ধারা বয়ে যায়।
আচ্ছা মেঘেরাও কি কাঁদতে জানে, আড়ি দেয়? ওই বিশাল আকাশের সাথে,যে দিনে আলো হাতে এসে, ধুপ করে আধারের কালো চাদরে নিজেকে মুড়ে চারপাশটাই বদলে দেয়।
আজ ওই গানটা কেন জানি শুনতে ইচ্ছে করছে,
“আজি ঝরো ঝরো মুখর ও বাদল দিনে ”.....
ইশ কাল রাত থেকেই গানটা কানে বেজে যাচ্ছে, কেও একজন মুঠো ফোনে স্বপ্ন দেখিয়েছে কাল সারারাত,
টুকরো টুকরো কবিতার অংশ আর গানের লাইনেই স্বপ্নের লাল নীল হলুদ জমিনপেড়ে চাদরটা বুনছিলো আদি।
কেও একজন?
আরিশ কেও একজন? নাকি খুব আপনজন? দুদিনের একটা ছেলেকে এতো আপন ভেবে নেওয়ার দ্বিধাদ্বন্দের পেন্ডুলামের ভাবনায় মগ্নতায় আছ্ন্ন হয়ে গেলো।
খোলা জানলার,দুচোখ ভরা তৃষ্ণা নিয়ে বৃষ্টিলতার ছন্দে এতোই মশগুল ছিলো আদি, কখন যে বৃষ্টিলতার জলে ওর এলোচুলো ভিজে লতানো গাছের মতো হয়ে আছে দেখলোই না।
নানি এসে ডাক দিলো
“জানলার ধারে কি করছিস, বৃষ্টির ছাট আসছে। ভিজে যাবি যে”।
“ভিজেই তো গেছি, আরেকটু ভিজিনা”।
“তোর মা জানলে আমাকে খুব বকবে সোনা”।
“আহ! মাকে কে বলতে যাচ্ছে?আমিও বলবো না তুমিও না। মা তো বাড়ি নেই ,কিছু হবেনা”।
“আচ্ছা, তোর ইচ্ছা যখন এতো পরে জ্বর হলে বলবি না কিছু আমাকে”।
“আচ্ছা বাবা রে ঠিক আছে ঠিক আছে’’।
আচ্ছা আরিশকে একটা ফোন দিলে কেমন হয়? বগুড়ায় কি বৃষ্টি হচ্ছে?
ফোনে, ওকে বৃষ্টির শব্দ শোনালে কেমন হয়?
আচ্ছা, ছেলেটা দেখতে কি ছবির মতোই?
সামনে তো কখনো দেখেনি।যেদিন দেখবে সেদিন কি হবে?
কথা বলতেই বুক দম বন্ধ হয়ে আসে, হৃদপিন্ড জোরে জোরে বাড়ি খায়, গলা শুকিয়ে যায়। খুব আস্তে করে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে আদি, যাতে আরিশ না বুঝতে পারে। ইশ!
ও বুঝতে পারলে কি লজ্জা হবে ওর।
আরিশের সামনে বড় লজ্জা করে যে ওর, বড় লজ্জা করে লজ্জাবতী লতার মতো, গাল রাঙা হয়ে আসে ওর কথায়। চোখ বুজলেই মুখটা মনে ভাসে, যেন পাশেই আছে, আবছা কুয়াশায় ঢাকা। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, কিন্তু ছুলেই দূরে সরে যায়। তাইতো এতো ভয় আদির। কুয়াশা হয়ে, যদি হাজার মেঘের ভীড়ে হারিয়ে যায়, তবে আদি বাঁচবে কি করে? আরিশ তো ওর জীবনেরই একটা অংশ, আদির খুব ইচ্ছে করে দীঘীর কালো জলে পা ডুবিয়ে আরিশের কাধে মাথা রেখে ওর গান শুনতে, ওর চোখে চোখ রেখে অনন্ত কাল পার করে দিতে। ইচ্ছে করে চিৎকার করে ছেলেটাকে বলতে “এই ছেলে তোমায় আমি অসম্ভব ভালোবাসি, তুমি কি অতি সাধারণ মেয়েটার ভালবাসার ভাগ নেবে”?
আমার শ্বাস নেওয়া অক্সিজেনের ভাগটা নেবে তুমি? লজ্জায় আর কিছুই বলা হয় না ওর।
***
নীল সাদা সোশ্যাল মিডিয়াতে আদির সাথে আরিশের পরিচয়। খুদে বার্তার ছোট্ট ছোট্ট কথাই ওদের কাছে টেনে এনেছিলো,এতো দুরত্বের।
লং ডিস্টান্স রিলেশন বলতে যা বোঝায় ওরা সেরকমই একটা সম্পর্কে আছে। কেও কাওকে দেখেনি, ছবিতে যা অবয়বের পরিচয়।
ভালবাসি কেও কাওকে বলেনি, গৎবাধা “থ্রি ম্যাজিকাল ওয়ার্ড” কখনো কেও কাওকে বলেনি। আদি বরাবরই লাজুক ছিলো, তারথেকো অনেক বেশি চঞ্চল।
আর আরিশ? নিজের কাছে যতটা প্রশ্নবোধক, আদির কাছে তারথেকেও অনেক বেশি বিস্ময়চিহৃ ছিলো!
আদির পাগলামী, ছেলেমানুষী সবই আরিশ মেনে নেয়, আদির পুতুল খেলাটাও আরিশ একটুও রাগ করেনা। বরং ওকে যখন আদি বলে ওর পুতুলের বিয়ে দিচ্ছে, তখন আরিশ হেসে ফেলে।
মেয়েটা বাচ্চাই রয়ে গেলো, বাইরের যে কেউ কথা শুনলে ম্যাচীরউড ভাববে ওকে। কিন্তু ওর বাড়ির লোক আর আরিশ জানে আদি কতটা ছেলে মানুষ। যত না আদি ছেলেমানুষ, তারথেকে অনেক বেশী সহজ সরল, অন্যরকম। এইচএসসি দেওয়ার পর অফুরন্ত সময়ের সদ্ব্যবহার করছিলো, তখনই আদি আরিশের জীবনে এসেছিলো, আচমকা ঝড়ের মতো নয়, ধীরে ধীরে গল্পের বইয়ের কোনার প্রিয় বইটার মতো ও একটু একটু করে আরিশের জীবনে জায়গা করে নিয়েছে। মেয়েটা অন্যদের মতো নয়, এখোনো রাতে আকাশের তারা গোনে আদি, পুতুল খেলে। আদি আবার রাধতেও জানে।
প্রথমদিনের কথা এখোনো মনে আছে আরিশের।
কাদছিলো শুনে আদি বললো “বালতি এনে দেবো আপনাকে”?
“কিহহহ?? যান কথাই বলবোনা আপনার সাথে”।
এখোনো এসব কথায় হাসি পায় আরিশের, পাগলীটা কি করছে?
মেঘ মেঘ ভাব জমেছে আকাশটায়। আদি কবিতা খুব ভালবাসে, নীল মেঘ মেঘ অভিমান করে আদি যখন কেঁদে ফেলে মুঠো ফোনের অপর পাশে মনে হয় দুহাত ভর্তি রোদকণা ওর গালে মেখে দেয় আরিশ। সমস্ত মেঘ অভিমান জল হয়ে সরে যাক।
সবসময় নীল চুড়ির বায়না করে আদি, বলে ওকে যখন দেখবে কিনে যেন আরিশ নিজে ওকে পরিয়ে দেয়। কি, অদ্ভুত আবদার!!
এই না দেখা মেয়েটার জন্য আরিশ মরতেও পারবে, ওকে পাওয়ার জন্য জন্ম জন্মান্তর অপেক্ষা করতে পারবে। ওর চোখের মায়ায় আরিশ জড়িয়ে যাবে কখনো এভাবে ভাবতে পারেনি।মায়াবতী এরকম একটা মেয়ের নাম মায়া রাখাই উচিত ছিলো, আরিশ নিজের ততটাও কেয়ার করে না যতটা আদি ওর কেয়ার করে। আরিশই বরং অনেকসময়, পরিস্থিতির জন্য আদিকে সময় দিতে পারে না। কিন্তু আদি এমন অদ্ভুত একটা মেয়ে কখনো অভিযোগ করে না। যদি কখনো আরিশ রেগে যায় কেঁদে ফেলে।
আচ্ছা ওকে দেখলে কি করবে?
হাতটা খুব শক্ত করে ধরে বলবো,আমি জন্মান্তরে বিশ্বাসী নই, তবু তোমায় পেতে যদি সাত হাজারবার জন্ম নিতে হয় আমি তাই নেবো।
তবু তোমাকেই ভালবাসবো।
***
আজ আরিশ এই প্রথম আদিকে ভিডিও কলে দেখলো, মেয়েটা এতো ছটফট করছিলো। আসলে আদি আনন্দে বুঝতে পারছিলো না কি করবে ও। ভীষণ লজ্জা লাগছিলো, আরিশের দিকে তাকাতেই পারছিলো না আদি। সমস্ত লজ্জা যেন তখন দুচোখের পাতায় এসে দুষ্টু প্রজাপতির মত উড়ে এসে বসলো। তাকাতেই পারলো না আদি। আর আরিশ এদিকে আদিকে দেখে দেখতেই থাকলো দেখতেই থাকলো, একজন মানুষ এতো মিষ্টি করে হাসতে পারে?
***
আদির ভীষণ মন খারাপ, আরিশকে খবরটা দেবে কি করে? হঠাৎ করেই ওর ইউ. এস. এর ভিসা হয়ে গেছে। এখন চলে যেতে হবে ওকে ওর মা বাবার সাথে। ওর আমেরিকা যাওয়া মানে আরিশকে ছেড়ে যাওয়া, সেটা কি করে হয়?
ওকে যদি আদি বুঝিয়ে বলে তাহলে কি আর আরিশ একটু ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না?
***
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে আরিশ, আদি ওকে এভাবে ছেড়ে চলে গেলো?
না বলেই কিছু? একবার দরকার ও মনে করলো না কিছু বলার?
আরিশ আদিকে দুইদিন ফোনে পায়নি বলে ওর বান্ধবীকে ফোন দেয়, সেই ওকে বলে আদি দুই দিন আগে সপরিবারে ইউ. এস. এ চলে গেছে।
বুকে ভীষণ কষ্ট জমছে, মেঘ মেঘ অভিমান নিয়ে নয়, কাল বৈশাখীর ঝড়ো ব্যথায় পাজর ভাঙছে।
চোখের জল গলায় দলা পাকিয়ে উঠছে, মাথাটা ভীষণ ফাকা ফাকা লাগছে। চারপাশে শূণ্য শূণ্য হাহাকার তার মাঝে আদির হাসির শব্দ ,দুহাতে কানে হাত চাপা দিয়ে ওর স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে চাইলো।
***
আমেরিকা আসার দুইদিন আগে নিউমার্কেটে ব্যগটা ছিনতাই হয়ে গেল। দিনদুপুরে একটা লোক আদির ব্যগটা ছো মেরে নিয়ে গেলো।আদির চিৎকারেও লাভ হলোনা, এদেশের মানুষগুলো জন্মান্ধ বধির নয় নয় তবে এসব ঘটনায় তারা মানসিক প্রতিবন্ধী বনে যায় সবাই।
আদি পাসপোর্ট ভিসা সবকিছু ওই ব্যগেই ছিলো, গুলশান এম্বেসি থেকে ফিরছিল। ফোনটাও ছিলো ওর মধ্যে।
মা বাবার তো মাথায় হাত, আবার নতুন করে পাসপোর্ট ভিসা করতে ছমাস তো লাগবেই।
আদি মাবাবাকে বললো “সমস্যা নেই, এখানে ঢাকায় আমি হোস্টেলে থাকতে পারবো, তোমরা যাও। আর ভিসা হয়ে গেলে আমিতো আসছিই আমাকে নিয়ে ভেবনা তোমরা”
এদিকে আরিশের ফোনে মাবাবা যাওয়ার পর ফোন করে আদি আরিশকে
নাম্বার বন্ধ!
আশ্চর্য ওতো কখনো নাম্বার বন্ধ রাখে না, তাহলে কি হয়েছে?
অপর্ণা কে ফোন দিতেই বললো, আরিশ কোথায় গেছে কেও জানেনা বগুড়াতে নেই, পাবনাতেও নেই।
কি হয়েছে কোন খবরই নেই।
এবার একদম ভেঙে পড়ে আদি, শেষে ওর ভয়টাই থাকলো ওর একলা আপন মেঘটা এতো মেঘের আড়ালে হারিয়েই গেলো।
কিন্তু কেন? আরিশ কেন এরকম করলো ওর সাথে? কি দোষ ছিলো আদির?
জবাবটা আরিশকেই দিতে হবে, হ্যাঁ আদিকে বলতে হবে।
***
(দুইবছর পর)
টিএসসিতে বসন্ত উদযাপনের সময় যায় আদি, বন্ধুদের সাথে।
দুই বছরে অনেককিছু বদলেছে, আদির কালো চোখে কাজলের সাথে আজকাল অবতল লেন্সেরও ব্যবহার হয়। ওজনের পার্থক্য হয়েছে বৈকি অবশ্য।
তবু দুটো চোখ এখনো আরিশকে খোঁজে, অনেক খুঁজেছে সেই ঘটনার পর পায়নি ওকে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে চান্স পেয়ে দেশেই থেকে গেছে আদি, আজ বন্ধুদের আড্ডায় ওর এক বন্ধুর বেস্ট ফ্রেন্ড নাকি আসবে তারই জন্য অপেক্ষা করছে আদি ওদের সাথে।
চারপাশে হলুদ কমলা শাড়ি পরা মেয়েরা, ছেলেরাও কমলা নীল পাঞ্জাবীতে বসন্তের বরণে মেতেছে।
নীল আকাশের কৃষ্ণচূড়ার গাছটার নিচে ওরা অপেক্ষা করছে।
আকাশটা মেঘ মেঘ জমে আছে।
আদি শান্ত কে জিজ্ঞেস করে
“কিরে বৃষ্টি নামবে নাকি?আজকে এতো মেঘ করেছে”।
“এহ, যাহ তাহলে তো ঘোরাই হবেনা
বৃষ্টি নামলে।প্রীতমটা কখন আসবে!
আরাফ বললো, ওই তো আসছে লাটসাহেব।
লাটসাহেবটাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আদি।
দেখে হার্টফেইল করবে মনে হলো ও। আরিশ ওর সামনে দাড়িয়ে আছে। ওর আরিশ যাকে দুবছর পাগলের মতো খুঁজেছে। সে আজকে ওর সামনে।
আরিশও অবাক হয়েছে ভীষণ, আদি এখানে!
দুজনেই তাকিয়ে থাকে, বিস্ময় নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ, কিছুটা অভিমান নিয়ে।
আরিশ মুখ খোলার আগেই আদি তেড়ে ওঠে, কিন্তু আরিশ ওকে শান্ত করে সব বলে কি হয়েছে। আরিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কেমিস্ট্রির ছাত্র। আদিকে আরিশ প্রশ্ন করে, এভাবে চলে যাবার জন্য।
আদি তখন ছিনতাই থেকে সবকাহিণী বলে আরিশকে।
বন্ধুরাও অবাক হয়ে শোনে ওদের গল্প।
“তোমাকে দুইবছরে কত খুজছি জানো? কত জায়গায়।কেও জানতো না, নাম্বার বদলে ফেলেছিলে তুমি।বাসার ঠিকানা জানতাম না তোমার। কেন হারিয়েছিলে আরিশ? কেন আরিশ?
আরিশের পাঞ্জাবী ধরে প্রশ্ন বাণ ছুড়তে ছুড়তে নিজেই কেঁদে ফেলে আদি।
পরম মমতায় আর্দ্র চোখে আরিশ ওর আদিকে দেখে, দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভালবাসা দিয়ে।
“এই,প্লিজ কেদোনা, কাঁদতেসো কেন তুমি”।
আরিশ নিজে কাদতে কাদতেই আদিকে কাদতে মানা করে, মনে হচ্ছে সব আনন্দ আজকে একসাথে পেয়েছে ও।
আকাশ ভেঙ্গেই বৃষ্টি নামছে, পিচ ঢালা ভেজা পথে দুজনে হাত ধরে চলে যাচ্ছে পেছনের দুবছরকে ফেলে।
অনাকাঙ্ক্ষিত বসন্তের বর্ষায় সব কষ্ট ওদের ধুয়ে গেছে, আবারো ওদের নদীর শেষবাকের মোহনা মতো মিলিয়ে দিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১১:৩৩