এক.
সকাল থেকে সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আর থামা থামি নাই। একটা লোকও নাই। বৃষ্টি দেখে মানুষ বের হবে না নাকি? তাহলে আর হয়েছে! আজকের দিন টাই মাটি যাবে তাহলে।কাল থেকে এক সেই বাসি তরকারি আর ভাত, ইনকাম ভালো হয় নি।আজকাল পকেটমারেরও ভাত নাই। কি দিনকাল যে এলো! আজকে সকাল থেকে এক বৃষ্টির জন্য বউনি করা হয়নি, রাস্তাঘাটে মানুষ নাই। বাসে উঠে যে পকেট মারবে, তাও সে আশায় গুড়ে বালি! পকেট গড়ের মাঠ, ধুর শালা! সকাল থেকে পকেট না মারতে পারায় পল্টনের মেজাজ খারাপ।
আসছে একজন তাড়াতড়ি এগিয়ে যায় পল্টন, দ্রুত পকেট কেটে খুশিমনে পা বাড়ায় পল্টন।মানিব্যাগের স্বাস্থ্য দেখে ভালোই মনে হচ্ছে, কালেকের দিনটাও চালিয়ে দেওয়া যাবে।
পল্টন জিয়া উদ্যানের ঝোপের পাশে মানিব্যাগটা খুলে দেখে,হাজার দুয়েক টাকা আছে
খুশীই হলো পল্টন,মানিব্যাগে আর কিছু আছে কিনা ভাল করে দেখতে লাগলো। একটা কাগজ পেলো।
চিঠি !!!
পল্টন পড়তে জানেনা,বস্তির ছেলের আবার পড়া! মা কবে যে মারা গেছিলো মনে নেই, খালি মনে আছে বাপ ছিলনা একা মাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো অপারেশনের হাজার পাঁচেক টাকা পল্টন দিতে পারেনি। লেখাপড়া জানা ভদ্দরলোকদের কাছে, সাহায্য চেয়েছিলো,সবাই টোকাই ভেবে ছ্যা ছ্যা করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো,প্রথম সেইদিনই টাকা চুরি করেছিলো।একমহিলার ব্যাগ টান দিয়ে দৌড় মেরেছিল। টাকা নিয়ে গিয়ে দেখে দেরি হয়ে গেছে, হয়তো একটু আগে আসলে মা টাকে বাচানো যেত।
চোখের পানি সযত্নে মুছে চিঠিটা ফেলে দিলো পল্টন।পেটে ক্ষিদের আগুন জ্বলছে।
দুই.
রাশেদের মা সকাল থেকেই বলে যাচ্ছে, বিকেলে মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা। রাশেদ মায়ের কথায় কান না দিয়ে রেডি হতে লাগলো, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মাকে কি করে বোঝায় অবন্তিকার যায়গা কখনোই কাওকে দিতে পারবে না। অবন্তিকা নেই বলেই কি,অন্য কাওকে আসতেই হবে?
ভার্সিটির সবচেয়ে আনস্মার্ট,ক্ষ্যাত ছেলে ছিলো রাশেদ। বন্ধু বান্ধব ছিলোনা সেজন্য কোনকালেই, মেয়েবন্ধু তো আরো দূর। সেই সময় অবন্তিকা এসেছিলো, দমকা হাওয়ার মতো। অবন্তিকার বাড়ির অবস্থা রাশেদের মতো অতোও ভালো ছিলনা। অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে অবন্তিকার বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসতে লাগলো, অসহায় রাশেদের কিচ্ছু করার ছিলনা। বাড়ির শান্ত ছেলেটা সেদিন ও চুপ করেই ছিলো।
পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগে বিয়ে হবে না বাসা থেকে বলেই দেওয়া হয়েছিলো সেখানে অবন্তিকার কথা বলা অসম্ভব ছিলো। অবন্তিকার শেষ চিঠিটা বড় যত্নে মানিব্যাগে তুলে রেখেছে রাশেদ।
রাস্তায় নেমে রিকশা না পেয়ে হাটতে লাগলো।রিকশা একটা কিছু দূর হেটে পাওয়া গেল,কিন্তু নেমে ভাড়া দিতে গিয়েই টের পেলো রাশেদ।
নেই!
মানিব্যাগটাই নেই, পাগলের মত খুঁজলো।মাথার ভেতরটা ফাকা লাগছে রাশেদের, মাথার উপর বর্ষা ঝরা আকাশটাও মনে হচ্ছে স্বার্থপর ব্যঙ্গের হাসি হাসছে, রাস্তার সবাই জানছে আজ কারো মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে, কিন্তু এটা জানেনা রাশেদের শেষ সম্বল অবন্তিকার স্মৃতিটাই হারিয়ে গেছে।
তিন.
বিল্টুর বয়স বারো, স্কুলে যায়না। রাস্তার আর দশ পাচটা টোকাইয়ের মতই জীবন কাটে রাস্তায়। মা করে মানুষের বাসায় বাসায় কাজ ,আর বাবা চায়ের দোকানে!
বল্টু ছাড়াও আরো তিনভাইবোন আছে ওর। ওরাও ওর মতো স্কুলে যায়না। বিল্টু কদিন ধরেই মায়ের কাছে মুরগী দিয়ে ভাত খেতে চাচ্ছে।গরীব মানুষ এত টাকা কোথায় পাবে যে ছেলেকে মুরগী কিনে রান্না করে ভাত খাওয়াবে?
বিল্টু প্রতিদিনের মতো আজকেও কাগজ কুড়তে বের হয়েছে, শোরগোল শুনে অন্যটোকাইদের সাথে সেও দৌড়ানো।
একটা ছেলে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছে, রাস্তা পার হতে গিয়ে। হইহট্টগোলে বিল্টু দেখলো ছেলেটার পকেট থেকে মানিব্যাগ পড়ে গেছে, ফাক দেখে বিল্টু সেটা নিয়ে কেটে পড়লো। যাক এবার খাওয়া তো হবে!!
বস্তির ঘরে গিয়ে বিল্টু পুরোনো হাতের কাছে দাদের মলমের লিফলেট দিয়ে মুড়িয়ে রাখলো। মাকে খুজতে গেলো বিল্টু টাকার কথা বলবে বলে। দেখে মা চুলায় রান্না বসাচ্ছে।
-কি করতেসো?
-আব্বা, নাইয়ে আও, আজকে যেই বাড়িত কাম করি ওনারা দিছে। বেশী রই গেছিলো মুরগী।যা,যা,তাড়াতাড়ি নাইয়ে আয়।
বিল্টু খুশি মনেই নাইতে গেলো, এসে দেখে মায়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
বিল্টু মা রান্না করে রেখে গেছে, দুই বিড়াল উল্টে দিয়েছে।
বিল্টু বললো, মা আমার কাছে টাকা আছে। আজকে মাংস রান্না হবে আমরা সবাই খাবো
পরিশিষ্ট.
এটা বিচ্ছিন্ন মানুষের গল্প,বিচ্ছিন্ন সুখ খোজার গল্প
সেদিন গভীর রাতেও অবন্তিকার স্মৃতি বুকে নিয়ে রাশেদ রাত্রির তারাদের মাঝে অবন্তিকাকে খোজে, দুচোখে আশার আলো নিয়ে।
আজও ঠিক ক্ষমা করতে পারে না রাশেদ, অবন্তিকার আত্মহুতি ওর জন্যই ছিল,হ্যাঁ ওর কাপুরুষতাই দায়ী।
সেদিন পল্টনের আর পেটের ক্ষুধা মেটানো হয় নি, তার আগেই উপরের ডাক চলে এসেছিলো, মৃত্যু আগে হতাশাপূর্ণ জীবন নিয়ে পৃথিবী থেকে গমন করেছে
সেদিন বিল্টুর ও আর খাওয়া হয়নি, ঝাল মুরগীর মাংস। ওর মা সেই লিফলেট দিয়েই রান্না করেছিলো।
আপেক্ষিকভাবে ভাবে মানিব্যগ জনিত ঘটনা কাওকেই ঠিক সুখ দিতে পারে নি।
তবু অসুখীরা অল্প কলার ভেলাতেও সুখ খুঁজে দেখতে জানে,যেখানে টাইটানিক অহংকারে ডুবে যায়।
ভালো থাকুক সুখীরা
ভালো থাকুক অসুখীরা
ভালো থাকুক সুখ খোজার প্রয়াসগুলো
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:৩৭