somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গণতান্ত্রিক, বাকস্বাধীনতার প্রবক্তা ,বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এক কিংবদন্তী সাংবাদিক যিনি।

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মার্কিনীরা ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনা’ বলেছিলো আর যখন চূড়ান্ত পরিণতি দেখলো ৯ ডিসেম্বর তারা বললো, এই সমস্যায় বিশ্ববাসীর করার কিছু আছে। যার বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখলেন শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন। আক্ষেপ করে লিখেছিলেন 'এতদিনে শিরোনামে', এতদিনে মার্কিন দেশের টনক নড়ল? এই নয় মাসে এ দেশের মানুষ শিকার হয়েছে হত্যাযজ্ঞের। সে রাতেই সিরাজুদ্দিন হোসেনকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিলো ভয়ংকর নরপিশাচ আল বদর, আল শামসেরা।.


(সেই ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়)
.

চামেলী বাগে একটি নিরিবিলি বাড়ির বড় ছেলেটি পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে। তখন সারা দেশটিতে পাকিস্তানীরা বাঙালী নিধন করছে। ঢাকা অবরুদ্ধ। ঢাকা থেকে এই ছেলেটিকে ১৯৭১ সালের ১১ অক্টোবর তাঁর বাবা একটি চিঠিতে লিখেছেন,
.
স্নেহের শামীম,
কারো কোনো বিপদে এখন আরেক পয়সার সাহায্যও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য।
সারা জীবন পরিশ্রম করে আজ বলতে গেলে একেবারে নূতন করে সংসার যাত্রা শুরু করতে হচ্ছে। কোনো অপঘাতে যদি মৃত্যু হয়, জানি না কোন আকূল পাথারে সকলকে ভাসিয়ে রেখে যাব। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সংসার জীবনে এমনি করে পিছনে যেতে হবে। এ বয়সে নূতন করে দুঃখ কষ্টের মধ্যে যাওয়ার মত মনের বল আর আবশেষ নেই।
যা, হোক, তোমাকে আশীর্বাদ করি, জীবনে সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে সামনে এগিয়ে যাও।...
--ইতি
আব্বা।।।



খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান সিরাজুদ্দিন হোসেন। তিনি কোলকাতায় বি.এ পড়ার সময় থেকেই দৈনিক আজাদ পত্রিকা সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে ঢাকায় ফিরে এসে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। কিছুকাল অস্থায়ী সম্পাদক হিসেবেও দ্বায়িত্ব পালন করেন। একটি অনুবাদ সংস্থায়ও চাকরি করেছেন।
.
পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই তার মোহভঙ্গ ঘটে। তিনি Dayes Decisive নামে একটি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, পাকিস্তান অর্জনে বাংলাদেশের মুসলমানদের অবদান পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশসমূহের মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশী। অথচ পাকিস্তান অর্জনের পর বাংলাদেশের অধিবাসীরা জীবনের প্রতিক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে, যে প্রস্তাবে আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা ছিল পূর্বশর্ত, সেই লাহোর প্রস্তাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান অর্জনের পর পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছে, স্বায়ত্বশাসন দাবীর অজুহাতে এ. কে. ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতন পাকিস্তান সংগ্রামের অগ্রনায়কদের বিশ্বাসঘাতক, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও বিচ্ছিন্নতয়াবাদী রূপে আখ্যায়িত ও নির্যাতিত করেছে।
.


যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সৃষ্টির জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালীদের মানুষই মনে করেনি। এমনকি বাঙালী মুসলমানদের পূর্ণ মুসলমানও মনে করতে পারেনি। তারা মনে করেছিল, দীর্ঘদিন হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে থেকে তারা হিন্দুত্ব অর্জন করেছে। সুতরাং পাকিস্তানপন্থীরা হিন্দুদেরকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আর মুসলমানদের পাকিস্তানী মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের জীবন থেকে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে। দেশটির উপর চাপিয়ে দেয় দীর্ঘ সামরিক শাসন। গণতন্ত্র দেশটি থেকে চিরকালের জন্য বিতাড়িত হয়। বাকস্বাধীনতা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। মানবিক মূল্যবোধ রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে মুছে ফেলা হয়। নাগরিকের কোনো অধিকারই ছিল না।

.

সিরাজুদ্দিন হোসেন এই পাকিস্তানতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। তার পরিচালনায় মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক বাঙালীদের অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে ওঠেন। যে কজন মানুষ শেখ মুজিবকে বাঙ্গালীর অবিসংবাদী নেতা হিসেবে গড়ে উঠতে নেপথ্যে থেকে কাজ করেছিলেন সিরাজুদ্দিন হোসেন তাঁদের অন্যতম।
.
মানিক মিয়ার মৃত্যুর পরে সিরাজুদ্দিন হোসেন 'মঞ্চে-নেপথ্যে ' নামে একটি কলাম লিখতে শুরু করেন ১৯৬৯ সালের ৮ তারিখে, 'অনামী' ছদ্মনামে। কলামটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী বাঙালিদের আন্দোলন-সংগ্রামের কথা লেখা হত---পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর মৃত্যুঘণ্টা শোনানো হত। এটা ইত্তেফাককে বাঙালিদের মুখপত্র করে তোলে।
.



(ইত্তেফাকের আরেক বিখ্যাত শিরোনামের স্রষ্টা).


মঞ্চে নেপথ্যে কলামে তিনি পাকিস্তানের প্রকৃত ছবি তুলে ধরে লিখেছিলেন, দেশ ও দশের জন্যই রাজনীতি; আর সত্যিকারের রাজনীতিকের ধর্ম দেশ ও দশের সেবা। আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ জনের বাস গ্রামাঞ্চলে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাস বা নগর জীবনের পরশ হইতে তাহারা বহুদূরে। জীবনের যেটুকু প্রাথমিক প্রয়োজন সেই অন্ন ও বস্ত্রের চিন্তা আজও তাহারা কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। (পকিস্তানের সেনাশাসক আইয়ুব খানের) ডিকেটি শাসনের অভিশাপ গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সর্বস্বান্ত করিয়াছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতা; বন্যা-প্রতিরোধের মহা-মহা পরিকল্পনার প্রগলভ প্রচারের ঢক্কা-নিনাদ সত্ত্বেও প্রকৃতি তাহাদের চোখের ঘুমও কাড়িয়া নিয়াছে।
.
বছর বছর বন্যা ও সাইক্লোনে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিঃস্ব-নিঃসম্বল হইয়াছে। ডিকেটি আমলের টাউট ও ক্ষমতাধরদের উচ্ছিষ্টভোগী কোনো এক শ্রেণীর ‘আজব মানুষ’ আর বল্গাহীন ক্ষমতার দাপট দেখাইলেও সি.ও (ডেভ) ও তহশীলদারদের অত্যাচারে গ্রামীণ হাংলার দরিদ্র কৃষকের ছনের ঘর আজ বিচালীর ঘরে পর্যবসিত, দুই টাকার খাজনা ছ’টাকা—আট টাকায় উন্নীত; কৃষিঋণ ও দাদনের ধকল পোহাইতে নাভিশ্বাস অবস্থা।
এই লেখা পাকিস্তানের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। তিনি টার্গেট হয়েছিলেন পাকিস্তানপন্থার।
.
এই সময় সিরাজুদ্দিন হোসেন দুসপ্তাহের ছুটি নিয়ে তাঁর নিজ বাড়ি মাগুরা যান। এই সুযোগটি কাজে লাগান পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের দালাল ইত্তেফাকের সাংবাদিক খোন্দকার আব্দুল হামিদ। তিনি ইত্তেফাকের মালিক মানিক মিয়ার আত্মীয়। তিনি মইনুল হোসেনকে বলেন—সিরাজুদ্দিন হোসেনের অনুপস্থিতিতে কলামটি লিখতে চান। 'অনামী' নামে তা লিখে মইনুল হোসেনকে দেখান। মইনুল ইত্তেফাকে প্রকাশের জন্য তা অনুমোদন করেন।
.
এই দুসপ্তাহে খোন্দকার আব্দুল হামিদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের আদর্শের পরিপন্থী পাকিস্তানপন্থীদের আদলে মঞ্চে-নেপথ্যে কলামটি লেখেন। এই ভাবে অন্যের নামে লেখা সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী।
.
সিরাজুদ্দিন হোসেন ঢাকায় ফিরে ক্ষুব্ধ হন। কয়েকদিন ইত্তেফাক অফিসে যান নি। পরে মানিক মিয়ার স্ত্রী তাকে বলে কয়ে আবার অফিসে ফিরিয়ে আনেন। তবে সিরাজুদ্দিন হোসেন আর মঞ্চে-নেপথ্যে কলামটি লেখেন নি। ওটা পুরোপুরি হাইজ্যাক করে নেন খোন্দকার আব্দুল হামিদ। 'অনামী’ নামের বদলে 'স্পষ্টভাষী' ছদ্মনামে পাকিস্তানী দালালী মার্কা লেখা চালিয়ে যান।
.
১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের মূলে সিরাজুদ্দিন হোসেনের অবদান অবিস্মরণীয়। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রচারগুণে ৬ দফা কর্মসূচী জনসাধারণ তাদের বাঁচা-মরার দাবী হিসেবে গ্রহণ করে।
.


. ( ইত্তেফাকের যত বিখ্যাত শিরোনামের জন্ম তাঁর হাতে)

.১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ইত্তেফাক অফিসটি পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী। এ সময় ইত্তেফাকে কর্মরত খোন্দকার আব্দুল হামিদ পাক-হানাদার বাহিনীর বিঃশ্বস্ত দালাল হিসাবে কাজ করে যেতে থাকেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে আল বদর আল শামসের অন্যতম নীতি নির্ধারক হন—বাঙালী হত্যার অন্যতম খুনী রাও ফরমান আলীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
.


(সন্তান ও স্ত্রীর সঙ্গে)
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিরাজুদ্দিন হোসেন দেশের অভ্যন্তরে থেকে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে সে সময়ে প্রকাশিত উর্দুভাষী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এনে সে অঞ্চলের ধর্মঘট বা অসন্তোষজনিত কর্মকাণ্ডের সংবাদ বিশেষ কৌশলে প্রকাশ করতেন দৈনিক ইত্তেফাকে যাতে খবরগুলো সকলের চোখে পড়ে। পূর্ববঙ্গের একটি মানচিত্রের ছবি ছেপে এই অঞ্চলের সাধারণ সংবাদ্গুলো সেই মানচিত্রের নীচে পরিবেশন করতেন। বোঝাতেন—এই পূর্বভুখণ্ডে কোনো স্বাভাবিক অবস্থা নেই। মানচিত্রের এই অঞ্চলটিতে আলাদা একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হতে যাচ্ছে, যার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কো্নো মিল নেই। সংবাদও আলাদা।
.
১৯৭১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামে সিরাজুদ্দিন হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে তিনি পাকিস্তানে থেকে কৌশলে খবরের শিরোণাম পালটে দিয়ে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ণের খবর সবাইকে বলে দিচ্ছেন। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানীদের ধরা খাওয়ার ইঙ্গীতটি বলে দিচ্ছেন। সংগ্রাম সিরাজুদ্দিনে হোসেনকে আক্রমণ করে লেখে যে, হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে যায় এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হয়, এমন সব খবরের শিরণামা নির্ধারণে সহযোগীটির (সিরাজুদ্দিন হোসেনের) পজেটিভ ভূমিকার অভাব কেন?
.

সে সময়ে জামায়াতে ইসলামীর পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম সিরাজুদ্দিন হোসেনকে পাকিস্তানের শত্রু চিহ্নিত করে তাকে মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে। তারা দাবী করে পাকিস্তানকে বাঁচাতে সিরাজুদ্দিন হোসেনের মত শত্রুদের মেরে ফেলাই উত্তম।
.
ইত্তেফাকে কর্মরত সাংবাদিক আবু তালিবকে প্রথমে খন্দকার আব্দুল হামিদের ইঙ্গিতে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সিরাজুদ্দিন হোসেনকে আবু তালিবের অপহরণ বিষয়ে হামিদ ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁকে বাসায় থাকতে উৎসাহিত করেন।
.


( ছেলের সঙ্গে)

সেদিন ১০ ডিসেম্বর শেষ রাত—সাড়ে তিনটার দিকে ডাকার চামেলী বাগের এই বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় কড়া নড়ে উঠল। একটু জোরেই শব্দ হয়েছে। দরজা খুলে দিয়েছে এ বাড়ির একটি ছেলে।
.
যারা এসেছিল তারা সবাই জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্ট আল বদর-আল শামসের সদস্য। সিরাজুদ্দিন হোসেন লেপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। গায়ে শুধু মাত্র একটি গেঞ্জি। পরণে লুঙ্গি। তার সন্তানদের সামনে স্ত্রীর সামনে সেই আল বদররা তাকে জামা এবং কোনো ধরনের শীতবস্ত্র পরার সুযোগ দেয়নি। তার ব্যাবহৃত গামছাটি দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে। তার ছোটো ছেলে তৌহিদ বলে উঠেছে, আব্বা কোথায় যাচ্ছে?
ওরা জবাব দিয়েছে, তোমার আব্বা বিদেশে যাচ্ছে।
আব্বা ফিরে আসছে না দেখে তৌহিদ শেষের দিকে বলা শুরু করে, আমার আব্বা কি বুড়ো হয়ে গেলে ফিরবেন?
তিনি আর ফেরেননি।
.
তাঁকে আর খুজে পাওয়া যায় নি। সে সময় তার অসহায় স্ত্রী নূরুন্নেছা ইত্তেফাকের সাংবাদিক খোন্দকার আব্দুল হামিদকে অনুরোধ করেন—-সিরাজুদ্দিনকে ছাড়িয়ে আনার জন্য। হামিদ সিরাজুদ্দিনের স্ত্রীর দেওয়া জামা কাপড়ও তাকে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যান। সিরাজুদ্দিন হোসেন আর ফিরে আসেন নি। খেন্দকার আব্দুল হামিদের ইঙ্গিতে তাকে মেরে ফেলা হয়। তার লাশটিও খুঁজে পাওয়া যায় নি। সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের নামের আগে শহীদ শব্দটি যুক্ত হয়।
.

দেশ স্বাধীনের পরে চারজনের বিরুদ্ধে সিরাজুদ্দিন হোসেন হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে এক নম্বর অভিযুক্ত আসামী হলেন খোন্দকার আব্দুল হামিদ। ধরা পড়ে অন্যতম অপহরণকারী ইসরাইল। পেশায় কসাই ইসরাইল জামাতের কর্মী ছিল। পুলিশ খোন্দকার আব্দুল হামিদকে জিজ্ঞাসাবাদও করে।
.


কিন্তু মইনুল হোসেন শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের স্ত্রীকে বলেন যে, তিনি যদি খোন্দকার আব্দুল হামিদের নাম অভিযুক্তের তালিকা থেকে তুলে না নেন, তাহলে ইত্তেফাক তাকে কোনো অর্থনৈতিক সুবিধাদি দেবে না। আটটি সন্তান নিয়ে কপর্দকশূন্য শহীদ জায়া নূরুন্নেছা বেগম মইনুল হোসেনের কথা মেনে নেন। এই ভাবে একাত্তরের দালাল খুনী খোন্দকার আব্দুল হামিদ বিচার থেকে রেহাই পেয়ে যান। আর জামাতের ঘাতক ইসরাইলের সাত বৎসর কারাদণ্ড হয়। জিয়াউর রহমান তাকে মুক্তি দেন।


(এই সেই ব্যারিস্টার মইনুল)

মইনুল হোসেনকে নিয়ে খোন্দকার আব্দুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর খুনি খোন্দকার মোশতাকের দলে ভিড়ে যান। এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তত্ত্বটি প্রসব করেন। জিয়া তত্ত্বটি গ্রহণ করে পুরস্কারস্বরুপ পাকিস্তানীদের দালাল ঘাতক খোন্দকার আব্দুল হামিদকে তার মন্ত্রী বানান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় তিনি প্রথমে যুব উন্নয়ন মন্ত্রী, পরে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বাস্খ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রম, জনশক্তি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন
.


।(নিখিল পাকিস্তান সাংবাদিক ঐক্যের বক্তৃতায় সিরাজুদ্দিন হোসেন)



১৯৭৬ সালে তিনি জিয়াউর রহমানের উপস্থিতিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বিষয়ে একটি সেমিনারে খোন্দকার আব্দুল হামিদ সেমিনারে বলেন, বাঙালি জাতীয়তা বললে মাল্টি-স্টেট ন্যাশনালিজম-এর কথা এসে পড়ে। কারণ, বাংলাদেশে বাইরেও কয়েক কোটি বাঙালি আছেন। আমরা কি সেসব বাঙালিকে বাংলাদেশের জাতির শামিল করতে পারি? জটিল আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রশ্নে ঝুঁকি না নিয়ে (প্যানবেঙ্গলিজম বা সুপ্রা-ন্যাশনালিজমের ) কথা আমরা কি ভাবতেও পারি? পারি না। আর তাই আমাদের জাতীয়তাকে ‘বাঙালি জাতীয়তা’ বলে অভিহিত করতে পারি না। করলে টেকনিক্যালি ভুল হবে, পলিটিক্যালি তা বিপজ্জনক হতে পারে।…
.
মূলতঃ খোন্দকার আব্দুল হামিদ দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা থেকেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ভাবনাটি আমদানী করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক বিভেদকে আবার সামনে টেনে নিয়ে আসেন। অথচ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই দ্বিজাতিতত্ত্ব, সাম্প্রদায়িকতা হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খোন্দকার আব্দুল হামিদের কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো গুরুত্ব পায়নি। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান- দর্শনই প্রধান বলে মনে করেছেন।
.
জিয়াউর রহমান খোন্দকার আব্দুল হামিদের এই তত্ত্বটি গ্রহণ করেন। এই তত্ত্বটিকে অবলম্বন করে তার উনিশ দফা প্রণয়ন করেন এবং বিএনপি গড়েন। একাত্তরের যুদ্ধপারাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন এবং বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানান। বিএনপি তাই মুসলিমলীগের নতুন বোতলমাত্র—আর জামাতীদের পোষক। এগুলোও ঐ খোন্দকার আব্দুল হামিদ প্রণীত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ থেকেই এসেছে।
.
অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বাকস্বাধীনতার প্রবক্তা ,বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অমিত শক্তিশালী সেনাপতি হিসেবে তাঁকে তারা হত্যা করে।
.
বারে বারে গাই “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশ্বেষে প্রান যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।।”
.
আজ ১০ ডিসেম্বর। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বাকস্বাধীনতার প্রবক্তা ,বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবদন্তী সাংবাদিক শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের প্রয়ান দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো তাঁর প্রতি।❤️
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×