২৭ মার্চ লালখান বাজার এলাকার পানি-বিদ্যুৎ সরবারাহ বন্ধ করে দেয় পাকি প্রশাসন। সেদিন রাতে পাকি সেনারা লালখান বাজারের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে
সকালে লালখান বাজারে গুজব ছড়ায় ওয়াসার মোড়ে কল থেকে পানি দেয়া হচ্ছে। এর পরই লালখান বাজারের বাসিন্দারা জড়ো হতে থাকে ওয়াসার মোড়ের দিকে, কিছু বুঝে উঠার আগেই শুরু হয় পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে লুটিয়ে পড়ে শত শত মানুষ। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ, অলিগলি। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই শহীদ হন কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু এরই মাঝে গড়ে উঠে প্রতিরোধ। কিছুক্ষণ পর প্রতিরোধে টিকতে না পেরে লালখান বাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় দামপাড়া পুলিশ লাইনের পিছন দিয়ে লালখান বাজার পাহাড় পেরিয়ে বাইরে চলে যান, বাকি বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যরা। সেদিন বিকেলে পাকিস্তানী হানাদারেরা এদেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় দখল করে দামপাড়া পুলিশ লাইন।
২৯ শে মার্চ দুপুরে ওয়াসার মোড়ে পাকিস্তানী হানাদারেরা আচমকা গুলি চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ১২ জন বাঙ্গালীকে। চারপাশে আতংক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। লোকজন ভয়ে অনেকে পালাতে থাকে, থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে চারপাশে। এরই মাঝে পানির তীব্র সংকটে অনেকে ধর্না দেয় পার্শ্ববর্তী এলাকায়। পানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ তখন।
পরদিন ৩০ মার্চ সকালে লালখান বাজার এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে ওয়াসার মোড়ের কল হতে পানি দেয়া হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে যাবার পর লালখান বাজার এলাকার অনেকেই পানি আনতে ওয়াসার মোড়ে জড়ো হতে থাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ শুরু হয় পাকি বাহিনীর গুলি বৃষ্টি। লুটিয়ে পড়ে শত মানুষ। পানি আনতে গিয়ে শহীদ হলেন কয়েকশত মানুষ।
সেদিন দুপুর হতে পাকিরা পরিকল্পনামাফিক বাঙালী নিধন করা শুরু করে। বাঙালী দেখা মাত্রই গুলি করতে থাকে পাকি বাহিনী।
সন্ধ্যা হতে শুরু হয় মৃত্যু তান্ডব। স্থানীয় বাঙালী বেজন্মা দালাল আর স্থানীয় বিহারীদের সহায়তায় পাকিরা অনেক বাঙালীকে ধরে নিয়ে যায়। এঁদের অনেকের লাশ পাওয়া যায় বাটালী হিলের ঝোপে-নালায়। অনেকের আর কোন হদিস মেলেনি।
৩০ মার্চ আর পরবর্তী কয়েকদিনে চট্টগ্রামের লালখান বাজারে পাক বাহিনী, তাদের দোসর আর বিহারীরা মিলে হত্যা করে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালী। একাত্তরের পরবর্তী নয় মাস লালখান বাজার এলাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। যেখানে স্থাপিত হয় টর্চার সেল। ডালিম হোস্টেলের মতোই এখানে ধরে আনা হত, সাধারণ মানুষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের। নির্মম নির্যাতনের পর লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো বুড়িগঙ্গায় এবং বর্তমান ফয়েজ লেকের পানিতে, পুঁতে রাখা হতো ফয়েজ লেকের পাহাড়ে।
স্বাধীনতা পরবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেকগুলো বধ্যভুমি পাওয়া যায়, স্বাভাবিক ভাবেই ধারনা করা যায় লালখান বাজারের আশে-পাশের বধ্যভুমি গুলোতে লালখান বাজার থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়, লালখান বাজার ও এর আশেপাশের এলাকার বধ্যভুমি গুলো হচ্ছেঃ
১. লালখান বাজার গাছের নীচ বধ্যভূমি: লালখান বাজার।
২. হাইওয়ে প্লাজা ভবন বধ্যভূমি: ইষ্পাহানী মোড়, লালখান বাজার
৩. বাটালী পাহাড়ের রেলওয়ে বাংলো বধ্যভূমি: লালখান বাজার
৪. লালখান বাজার পাহাড় বধ্যভূমি: লালখান বাজার
৫. সার্সন রোডে পাহাড়ের উপরে বাংলো বধ্যভূমি: জয়পাহাড়
৬. সিআরবি নির্যাতন কেন্দ্র বধ্যভূমি: রেলওয়ে এলাকা, লালখান বাজার
৭. হোটেল দেওয়ান বধ্যভূমি: দেওয়ান হাট মোড়, লালখান বাজার
৮. চট্টগ্রাম ষ্টেডিয়ামের পার্শ্বের সেনাক্যাম্প বধ্যভূমি
৯. সার্কিট হাউজ বধ্যভূমি: চট্টগ্রাম।
১০. গুডস্ হিল বধ্যভূমি: রহমতগঞ্জ, চট্টগ্রাম।
১০. মহামায়া ডালিম ভবন বধ্যভূমি: টিএন্ডটি ভবনের সামনে, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।
১১. ঝাউতলা বিহারী কলোনী বধ্যভূমি: ঝাউতলা রেলওয়ে কলোনী, দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১২. নেভাল অফিস বধ্যভূমি: টাইগারপাস, দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১৩. পুলিশ মাঠ বধ্যভূমি: দামপাড়া, দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১৪. চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন এর পুরাতন গেইট গণ কবর বধ্যভূমি: দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১৫. পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প বধ্যভূমি: দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১৬. ঈদগাঁ রেডিও ষ্টোর আর্মি ক্যাম্প বধ্যভূমি: দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১৭. রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বধ্যভূমি: আম বাগান, দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১৮. সিভিল গোডাউন বধ্যভূমি: দেওয়ানহাট, দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
১৯. হযরত গরীব উল্লাহ শাহ মাজারের পিছন বধ্যভূমি: দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
২০. আমবাগান স্কুলের সামনে বধ্যভূমি: দক্ষিণ পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
২১. পূর্ব পাহাড়তলী বধ্যভূমি: পূর্ব পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
২২. পূর্ব নাসিরাবাদ বধ্যভূমি: পূর্ব নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম।
২৩. চক্ষু হাসপাতালের সামনে বধ্যভূমি: পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
২৪. এ্যাপোলো ফার্মেসির পিছন বধ্যভূমি: মেডিকেল কলেজের সামনে, মুরাদপুর, চট্টগ্রাম।
২৫. প্রবর্তক সংঘের পাহাড় বধ্যভূমি: মুরাদপুর, চট্টগ্রাম।
গণহত্যার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ আজ আমরা অনেকেই ভুলে গেছি ইতিহাসের নির্মমতম গণহত্যাকে। কেবল পানি আনতে এদেশীয় বেজন্মা দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী হানাদারদের বাঙ্গালী নিধনকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:৪৯