১৯৫১ সালে এক চিকিৎসক তাঁর তত্ত্বাবধানে সদ্য ভূমিষ্ঠ এক শিশু সম্পর্কে শিশুটির মাকে বলেছিলেন, এখন ১৯৫১ সাল। ২০ বছর পরে ৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, সেদিনের সেই শিশু ৭১ সালে তারুণ্যে টগবগ করছে।
ছেলেটি নিজের প্রখর বুদ্ধিমত্তার জন্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের মধ্যে অন্যতম 'ইলিয়ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি'তে পড়ার সুযোগ পান। সেই সময়ে তৃতীয় বিশ্বের একটা ছেলে নিজের যোগ্যতায় সেখানে চান্স পাওয়ার মুল্য অনুভব করতে পারেন? এবং কতটা সাহস , কতোটা দেশপ্রেম থাকলে এই বয়সের একজন ছেলে এই সুযোগ পায়ে ঠেলে দেয় , তা কি কখনো উপলব্ধি করতে পারেন? নিজের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ ফেলে দেশের টানে যখন একজন আধুনিক ছেলে যুদ্ধে নাম লেখায় , তখন তার মধ্যেকার অনুভূতি সম্পর্কে কি একটু হলেও আন্দাজ করতে পারেন?
৭১ সালের আগস্ট মাসে তাঁর আমেরিকা যাওয়ার কথা এবং ক্লাস শুরুর সময় ছিল সেপ্টেম্বর। অবসর সময়টুকু কাজে লাগাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ অনুমতি নিয়ে অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস করতে লাগলেন তিনি। মার্চের প্রথম দিন থেকেই দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করলে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই উত্তাল সময়গুলোর প্রত্যৰদর্শী স্বাধীনতা-প্রেমিক ছেলেটি। পরবর্তীতে যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর মা জাহানারা ইমামের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু মা তাঁর প্রাণপ্রিয় এই সন্তানকে কিছুতেই যুদ্ধে পাঠাতে রাজি হলেন না। এমন মেধাবী ছেলেকে কিভাবে তিনি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন? এই নিয়ে তাদের মাঝে অনেক যুক্তি-তর্ক হয়। একদিকে মা কিছুতেই রাজি নন; অন্যদিকে রুমি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তা হলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?’
মা বললেন যা তোকে দেশের জন্য কোরবান করে দিলাম!
মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে রুমি
বাবা মায়ের অনুমতি- আশীর্বাদ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ১৪ জুন সেই ছেলেটি প্রশিক্ষনের জন্য যায় ভারতের মেলাঘরে। প্রায় দেড় মাস পর প্রশিক্ষন শেষে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে অন্যান্য গেরিলা যোদ্ধার সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করে মেজর খালেদ মোশাররফ এর অধীনে ও মেজর হায়দার এর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে ঢাকা শহরের একদল মুক্তিপাগল তরুণদের নিয়ে গঠিত ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেয়। যা হাতের তালুর মতোই চিনতো ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি। ২৫শে আগস্ট ধানমণ্ডির ১৮ এবং ৫ নম্বর সড়কে দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন চালায় তাঁরা। গেরিলা আক্রমণের মূল বিষয় হলো হিট অ্যান্ড রান। ছেলেটির সহযোদ্ধা বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক) বলেন,
আমরা প্ল্যান করলাম একটা সিরিয়াস টাইপের অ্যাকশনের। সিদ্ধান্ত হলো ২০ নম্বর রোডে (ধানমন্ডি) চায়নিজ এম্বাসি এবং ১৮ নম্বর রোডে জাস্টিস আবদুল জব্বার খানের বাসার সামনে অপারেশন করার। সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ প্রহরায় থাকত।‘কাজী (কাজী কামালউদ্দিন, বীর বিক্রম), বদি (বদিউল আলম বীর বিক্রম), জুয়েল, রুমি , স্বপন ( (কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম) ও আমাকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হলো। ‘এবার আমাদের টার্গেট ছিল “অ্যাটাক অন দ্য মুভ”। বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। আগেই রেকি করা হয়েছিল। কিন্তু এর জন্য গাড়ি প্রয়োজন।গাড়ি হাইজ্যাকের ভার পড়ল আমার ও বদির ওপর।
গাড়িটি ছিল মাহফুজ আনামের বড় ভাই মাহবুব ভাইয়ের। সাদা রংয়ের গাড়ি। সামনে ছোট্ট ছেলে ড্যাস বোর্ড ধরে দাঁড়িয়ে। মাহবুব ভাই খুবই ফর্সা। দেখে প্রথমে মনে করেছি, কোনো বিহারি হবেন। আমরা তিনটার দিকে বের হয়েছি। বদি হাত উঁচিয়ে গাড়িটি থামাল। ওর হাতে বন্দুক। বদি ঠাণ্ডা মাথায় বলছেন, আপনি কি অবাঙালি? তিনি বলছেন, আমি বাঙালি। বদি বলছেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আপনার গাড়িটি দরকার। আপনি নামুন, না হলে আপনার ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। আমরা অপারেশনে যাব। আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আপনি থানায় খবর দেবেন যে, আপনার গাড়ি ছিনতাই হয়েছে। এর আগে খবর দিলে পরিণাম খারাপ হবে। আমরা তখন জানতাম না যে, তিনি মাহফুজ আনামের বড় ভাই। মাহফুজ আনাম আমাদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। মাহবুব সাহেব সম্মতি দিলেন। তাদেরকে রিক্সায় উঠিয়ে দিলাম। কিছুদূর আসার পর ড্যাস বোর্ড খুলে দেখি লাইসেন্সে মাহবুব আনাম লেখা। ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি পাকিস্তানের কর্মকর্তা। তখন আমরা বুঝতে পারলাম। তবে আর কিছুই করার ছিল না। এরপর জিয়া, চুল্লু ভাই, মুক্তার আরেকটি গাড়ি নিয়ে এলো। কারণ পরপর দুটি অপারেশন করার কথা। ধানমন্ডি অপারেশন করে গভর্নর হাউজ এবং পিলখানায় অপারেশন করার কথা।
মাজদা রাইটহ্যান্ড গাড়ি। ঠিক হলো আমি স্টিয়ারিং হুইলটা ধরব। আমার অস্ত্র যাবে বদির কাছে। এ অপারেশনে শেষ পর্যন্ত জুয়েলকে নেওয়া হয়নি তাঁর হাতের জখমের কারণে। আমরা গাড়ি নিয়ে ২০ নম্বর সড়কে গিয়ে আশ্চর্য হলাম। দেখি, নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সেনা-পুলিশ নেই। গাড়ি টার্ন করে ১৮ নম্বরে ঢুকে পশ্চিম দিকে এগোতে থাকলাম। দেখি, ব্রিগেডিয়ারের বাসার সামনে আট জোয়ান বসে আড্ডা দিচ্ছে।
‘ইট ওয়াজ হার্ডলি টু-থ্রি সেকেন্ড। একটা ব্রাশ মানে দুই থেকে তিন সেকেন্ড, ১০ রাউন্ড গুলি বেরিয়ে যাওয়া। দুই লেবেলে গেল। কাজীরটা বুক বরাবর, আর বদিরটা পেট বরাবর। আমি খুব আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। আটজনই পড়ে গেল। সহজেই কাজ শেষ হওয়ায় আমরা আনন্দিত ,তারপর ধীরে গাড়ি চালাচ্ছি। স্বপন পিছন থেকে আমার জামার কলার ধরে বলছে এই হারামজাদা আমি ফায়ার করব না? তাহলে গাড়িতে তুলেছিস কেন? বললাম ঠিক আছে, চল। ফের ২০ নং রোডে গেলাম। ৫ মিনিট অপেক্ষা করলাম। কোনো চাইনিজ নেই। স্বপনকে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। তোমার কপালে নেই। চল। গভর্নর হাউজে আরেকটি গাড়ির সঙ্গে মিলতে হবে।
৭ নং রোড দিয়ে যখন নিউমার্কেট রোডে এলাম তখন দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড বসে গেছে। চার-পাঁচটি গাড়ি ইতোমধ্যেই থামিয়ে চেক করছে। আমি স্বপনকে বললাম, তুমি কি চালাতে চাও। স্বপন বলল, হ্যাঁ। আমি স্বপনকে বললাম, দেখ সামনে একজন এলএমজি নিয়ে শুয়ে আছে। ওটাকে নিতে হবে। শেষ করতে না পারলে দুঃখ আছে। বদি বলছে, এ পাশে আরেকটা আছে। আমি বললাম, শেষ করা তোমাদের দায়িত্ব। তবে নিশ্চিত শেষ করতে হবে। ওরা থাম থাম বলছে। গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। একজন গালি দিয়ে গাড়ির সামনে আসল। আমি লাইট বন্ধ করে ডান পাশের ইন্ডিকেটার দিয়ে থামানোর ভান করলাম। এরমধ্যেই স্বপন, বদি, কামাল ফায়ার শুরু করে দিয়েছে। গুলির গরম খোসা এসে আমার পিঠে পড়ছে।
ওরা বুঝতেই পারেনি যে, গাড়ি থেকে এভাবে গুলি হতে পারে। বুঝে ওঠার আগেই আমাদের অ্যাকশন হয়ে গেছে। আমি বলেছি, বামদিকে ইন্ডিকেটার দেখিয়ে ডান দিকে যাব। গ্রিনরোডে আসার বাঁক নিয়ে আমি নিউ মার্কেটের দিকে গেলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরির দেয়ালের কাছে আসতেই রুমি বলছে, জিপ আসতেছে। রুমি আর বিলম্ব করেনি। সঙ্গেই সঙ্গেই পিছনের গ্লাস ভেঙ্গে জিপটিকে লক্ষ্য করেই গুলি। আমি লুকিং গ্লাসে দেখলাম, জিপটি সজোরে গিয়ে একটি খাম্বার সঙ্গে ধাক্কা খেল। সম্ভবত চালকের গায়ে গুলি লেগেছিল।
রুমিকে বললাম, খালাম্মাকে বল তোর বাসার উল্টো দিকে আসতে। কারণ এই আর্মসগুলো রাখতে হবে। আমরা এলিফ্যান্ট রোড থেকে সরু রাস্তা দিয়ে রুমিদের বাড়ির সামনের গলিতে চলে এলাম। দেখি খালাম্মা তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অস্ত্রগুলো তার গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। তিনি বাসায় নিয়ে গেলেন। কাজী কামাল, বদিকেও নামিয়ে দিলাম। রাত আটটা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমি আর স্বপন গাড়ি নিয়ে ভূতের গলিতে ঢুকলাম। ভূতের গলিতে একটি বাড়ির সামনে গাড়িটি রেখে আমরা চুপচাপ হেঁটে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের বাড়িতে চলে এলাম। রুমিকে রেখে বদি এবং কামালও একই জায়গায় চলে এসেছে। সেখান থেকে আমরা ধানমন্ডি চলে গেলাম। এটিই ছিল রুমির শেষ অপারেশন।
(বাবা শরিফ ইমামের সঙ্গে রুমি)
মুক্তিযুদ্ধের ২৯ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়ে। তাঁকে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে বাবা এবং ছোট ভাই, বন্ধু হাফিজ, চাচাতো ভাই মাসুম সহ তাঁদের বাসা থেকে পাকিস্তান আর্মি ধয়ে নিয়ে যায়। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তাকে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের ভয়ংকর নির্যাতন চালায় তারা। সেই ছেলেটি বাকিদের স্বীকার করতে নিষেধ করে, এবং সম্পূর্ণ দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়।
অনিবার্য পরিণতি অনুধাবন করে ধরা না পড়া অন্য সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষার জন্য সহ্য করে যায়, ভয়ংকর পৈশাচিক নির্যাতন। চরম অত্যাচার সহ্য করেও সে প্রকাশ করেনি কারো নাম। দুই দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়া হয় পরিবারের বাকি সদস্যদের। ফিরে আসার সময় বাবা তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলে পাকিস্তানী কর্নেলের জবাব, সে যাবে একদিন পর, তাঁর জবানবন্দী নেয়া শেষ হয়নি। ফিরে এসেছিলো বটে। বাঙলার প্রতিটি রক্তে ভেজা প্রান্তরে, কোটি মুক্তিপ্রান মানুষের হৃদয়ে।
সেই ছেলেটির আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বাংলার রাজপুত্র শাফি ইমাম রুমি। আপনি থাকবেন বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে, প্রাণে। বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো মুক্তিযুদ্ধের এই দুর্ধর্ষ যোদ্ধার প্রতি।
রুমি যখন ইউওটিসির (এখনকার বিএনসিসি) পোশাকে।
(মা বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে রুমি)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:০৯