ছেলেটি ছিলো অদ্ভুত ধরনের। অন্য সবার চেয়ে আলাদা, এবং প্রচণ্ড ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন। যাঁর রক্তে ছিলো ক্রিকেট। ৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি কেমিক্যাল কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন ছেলেটি। প্রচন্ড একরোখাও। যে কথা একবার বলেছে হাজার অনুরোধেও গলবে না সে।
যে কাজ সবে শুরুর আগে দশবার ভাবতো। সে কাজ করেই ছাড়তে ছেলেটি। ক্রিকেট ছিলো তাঁর ধ্যান জ্ঞান। তবে পাগলামিটা শুধু কল্পনাতে ছিলো না। ওপেনিং পজিশন তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকতো সবসময়। ব্যাটিংয়ে যখন নামতো বিপক্ষ দলের হাঁটু কাঁপতো। যাঁর শর্টের অভিধান দেখে যে কেউ চমকে যেতে বাধ্য। চোখ ধাঁধানো শর্টের বাহার দেখতে মানুষ ইনিংসের শেষ নাগাদ জায়গা থেকে নড়ার মতো অবস্থা থাকতো না! বিশেষ করে স্লগ সুইপটার সবচেয়ে সৌন্দর্য বিলাতে শুধু এই ছেলেটা পারতো। শুরু থেকে শেষ অব্দি মানুষের ভিড় পড়ে যেতো খেলা দেখতে।
তাঁর উপর চোখ পড়েছিলো আজাদ বয়েজের সংগঠক আরেক কিংবদন্তি মুশতাকের। মেছুয়া বাঙ্গালীদের পাকিস্তান জাতীয় দলে ঢোকা ছিলো অসম্ভবের মতো।
স্বাধীন বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার সুপ্ত আশা লালন করতো ছেলেটি। যেদিন আর থাকবেনা শুয়োরদের আভিজাত্য। যেদিন হবেনা শোষন আর বঞ্চনার শিকার। যেদিন স্বাধীন পতাকা মাথায় নিয়ে নামবে সবুজ মাঠে। কাঁপিয়ে বেড়াবে মাঠ, মাথায় থাকবে স্বাধীন দেশের পতাকা। জল হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে জয় বাংলার হর্ষধ্বনি।
৬৯ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজে পাকিস্তান দলের ওপেনিং সমস্যাটা প্রকট আকার ধারন করে। প্রাথমিক দলে সুযোগ পায় ছেলেটি। তখন দেশে চলছে গন অভ্যুত্থানের হাওয়া।
ছেলেটি চায়নি মাতৃভূমির সাথে প্রতারণা করতে। মাতৃভূমির মানুষ দাবি আদায়ে রাস্তায় সংগ্রাম করছে, অথচ সেকি না থাকবে খেলার মাঠে! ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে প্রস্তাব।
সফল হয় অভ্যুত্থান। ছেলেটির দৃঢ় প্রত্যয়ের জয় হয়। অথচ ছেলেটি জানেনা এর শেষ কোথায়!
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় পঁচিশে মার্চ রাত থেকে।
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ জেলা ক্রীড়া ভবনের সামনে সদাহাস্যজ্বল মুশতাক ভাইয়ের দু হাত উপরে তলা ডেডবডিটা পড়ে ত্থাকতে দেখার পর ছেলেটার স্বপ্নটা একটা ধাক্কা খেল। নিষ্প্রাণ ঝাঁজরা দেহটা পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। হাতদুটো উপরে ধরা। আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মুশতাক ভাইয়ের আপন শত্রুও এই অপবাদ দিতে পারবে না যে, তিনি কাউরে কোনোদিন একটা গালি দিয়েছেন। ক্রিকেট ছিল তার ধ্যান, একমাত্র সাধনা। বিনা অপরাধে এইভাবে মরতে হবে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও হয়তো এটা তার কল্পনাতেও ছিল না।
জুয়েলের এখন সময় দেশকে কিছু দেয়ার। ৩১ মে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে তিনি সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘয়ে চলে যায়।
এর কয়েকদিন আগে মাকে একটি বাঁধাই করা ছবি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমি যখন থাকবো না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।
কর্নেল খালেদ মোশাররফ নির্দেশে ১৭ জন তরুনের একটি দলকে মেলাঘরে গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে মেজর এটিএম হায়দার ঢাকায় পাঠান। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলো ছেলেটি। পরবর্তীতে যা জন্ম নেয় ক্র্যাক প্লাটুন নামক একদল কিংবদন্তীর গেরিলা দল। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের রেকি করতে গিয়ে রামপুরা বিলে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে গিয়েছিলো ছেলেটির।
পচনের হাত থেকে হাত বাঁচাতে ডাক্তার সিদ্ধান্ত জানায় আঙ্গুলগুলা কেটে ফেলতে হবে। হঠাৎ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় আবেদন, "দেশ স্বাধীন হইলে ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে নামুম, আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার।
২৯ শে আগস্ট মগবাজারে ধরা পড়ে ছেলেটি। ধরে নিয়ে শুরু হয় তাঁর উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার। ভাঙ্গা তিনটি আঙ্গুলে প্লাস দিয়ে নখ টেনে তুলে সুই ঢোকানো হয়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বারেবারে চিৎকার করে উঠেছে ছেলেটি, জ্ঞান হারিয়েছে নিষ্ঠুর নির্যাতনে। চোয়াল ফেটে রক্ত ঝরেছে, নাকের চামড়া ফেটে গেলেও একবারের জন্যও সে বলেনি সহযোদ্ধাদের নাম।
কাহা সে ট্রেনিং লেকে আতা তুম লোগনে, কিধার সে আর্মস আতা বারেবারে ধেয়ে আসছিলো পাক ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন। না কিছুতেই বলবে না ছেলেটি। সে যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। হাজারো অত্যাচার টলাতে পারেনি তাঁকে। হেরে যাওয়াটা রক্তে ছিলোনা ছেলেটির। লড়াই করে বুক চিতিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো মাতৃভূমির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসায়।
টর্চার সেলে ভাঙ্গা আঙ্গুলের উপর চলতো হাতুড়ির বাড়ি সঙ্গে প্রশ্ন “কা রুট কিধার হ্যায়, হাতিয়ার কাহা সে আ রাহা,"
না মাতৃভূমির সাথে সে যে কথা দিয়েছে। জীবন গেলেও বলবে না সহযোদ্ধাদের নাম। স্বাধীন দেশে ওপেনার হয়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন, স্বাধীন মাতৃভূমিতে শ্বাস নেয়ার স্বপ্নের মাঝে কি অদ্ভুত ব্যাবধান। দেশটাকে কতোটুকু ভালোবাসা যায় শিখিয়েছিলো ছেলেটি। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করেছে মুখ বুজে।
২৯ শে আগস্টে যারা নিখোঁজ হন শহীদ, বদি, জুয়েল, আজাদ, আলতাফ মাহমুদ, রুমি সহ অনেকে
সে ছেলেটি আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসেনি দেশের ওপেনিং জুটির বিপক্ষ দলের ত্রাস হয়ে। ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিলো এক মাতৃভূমির জন্য লড়াই করে। ছেলেটির মাতৃভূমির প্রতি হৃদয় জোড়া ভালোবাসা প্রেম কখনো হারায় না। ছেলেটি আজ থেকে ৪৫ বছর আগে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো আমাদের জন্য। কেবল স্বাধীন দেশে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার জন্য।
বাংলার দুরন্ত কিংবদন্তী এই ছেলেটির আজ জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। আপনি চিরদিন থাকবেন আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে, স্পন্দনে।
শহীদ জুয়েলের জার্সি উন্মোচন করেছিলেন মাশরাফি, সাকিব ও মুশফিক
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৪৬