somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাকালের মহা নায়িকা..

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



তাঁর গ্রীবা, কটাক্ষ, চোরা চোখ- ছলকে ওঠে প্রেম কিংবা বিরহ, অভিব্যক্তি, আচরণ, আবেদন কিংবা দেহসৌষ্ঠব- আজও অনন্য মহানায়িকা।
সুচিত্রাই কি বাংলা ছবির প্রথম ও শেষ ডিভা? হয়তো। আবার ‘হয়তো’ কেন? নিশ্চিতই। উত্তমকুমারের চেয়েও যাঁর তারকা উপাধি এগিয়ে থাকত, বেড়ে থাকত পারিশ্রমিক, স্টুডিয়ো ফ্লোর তটস্থ থাকত যাঁর মেজাজমর্জি, খেয়ালের ব্যাপারে, প্রযোজকরা সন্ত্রস্ত, তিনি কিন্তু ওই গার্বোর মতোই বলার পর বলে (বাহান্নতম বাংলা ছবি ‘দত্তা’-ও তেইশ সপ্তাহ চলে বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ জুগিয়েছে) চলচ্চিত্র জীবনের শেষ অবধি নিজের জায়গা কায়েম রেখে গেছেন।
কায়েম তো রেখেছিলেনই, কিন্তু আরও বেশি করে যেটা ভাবায় তা হল কী ভাবে? প্রযোজক ধরে ছবিতে নেমে নয়, ছবি প্রযোজনা করেও নয়, প্রচারমাধ্যমকে কাজে লাগিয়েও নয়। সেরা সময়ের দশটা বছরের ছবিগুলোর নাম পর পর সাজিয়ে দিচ্ছি, দেখুন গায়ে কাঁটা দেয় কি না, অবিশ্বাস্য ঠেকে কি না। নিন… ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরি’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘চাওয়াপাওয়া’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘হসপিটাল’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তরফাল্গুনী’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ ও ‘গৃহদাহ’।
১৯৫৭-৬৭ অবধি এ এক অবিরাম যাত্রা যা আকর্ষণীয় সুচিত্রাকে একটু একটু করে অভিনেত্রী ও আবেদনময়ী করে তুলেছে। এর অধিকাংশই তো নায়িকাপ্রধান ছবি নয়, উত্তমকুমারের মতো নায়কের সঙ্গে প্রাধান্য ভাগ করে নিতে হয়েছে (কখনও অশোককুমার, সৌমিত্র, বসন্ত ও বিকাশ), কিন্তু সব ছবিতেই সুচিত্রা আছেন সুচিত্রাতেই। মানে উপস্থিতি, মানে তীব্র আকর্ষণ, স্ক্রিনজোড়া লাবণ্য এবং কখনও কখনও চমকে দেবার মতো অভিনয়। মনে করুন ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তরফাল্গুনী’ বা ‘চন্দ্রনাথ’। যা বাঙালি দর্শককের মনের ব্যথা ও চোখের জলের সঙ্গে মিশে আছে এতকাল।
পর্দায় উপস্থিতিটাও যে অভিনয়ের এক মস্ত অঙ্গ তা সুচিত্রার মতো আর কোনও অভিনেত্রী প্রমাণ করতে পেরেছেন কি না জানি না, শুধু আকর্ষণ দিয়ে এ কাজ সেরে ফেলা যায় বলেও মনে হয় না। গ্রেটা গার্বোর মৃত্যুতে অনন্যা অভিনেত্রী বেটি ডেভিস যেটা বলেছিলেন তা সুচিত্রা সম্পর্কে বললেও বলা যেতে পারে: “হার ইন্সটিংক্ট, হার মাস্টারি ওভার দ্য মেশিন ওয়জ পিওর উইচক্র্যাফট।” ওঁর প্রবৃত্তি মেশিনের ওপর ওঁর কতৃত্ব ছিল বিশুদ্ধ ডাকিনীবিদ্যা।
সুচিত্রা আকর্ষণসর্বস্ব ও অভিনয়ে শিথিল এমন একটা প্রচার তাঁর সমকালীন ও ঈষৎ পরবর্তী কালের অভিনেত্রীরা জারি রেখেছিলেন। সেটা কতখানি ঈর্ষাপ্রসূত আর কতটা ন্যায্য বিচার তা সুচিত্রার ছবিগুলো চালিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম দিককার ছবিতে তিনি বেজায় আড়ষ্ট, কিন্তু তার কারণ ঠাওরানো খুব কঠিন কাজ নয়। পাবনার মেয়ে বিয়ে হয়ে কলকাতায় এসেছেন, আকাঙ্ক্ষা যদি কিছু থেকে থাকে তো সেটা গানের রেকর্ড করার। গানের গলাটা ছিল মিষ্টি এবং ঝোঁক ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি। কিন্তু বিধি অন্য রকমটি ভেবেছিলেন।


সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে সৌমিত্রের সাথে



(দুই)


স্বামী দিবানাথের সঙ্গে একান্ত সুচিত্রা

স্বামী দিবানাথ সেনের উচ্চাভিলাষই (হয়তো রূপসী বৌয়ের মধ্যে আগামী নক্ষত্র দেখেছিলেন!) কারণ হল, রমা সেনের সিনেমায় নামার। ওজরআপত্তি কম করেননি রমা, কিন্তু তত দিনে ওঁর হয়ে অ্যাক্টিঙের অ্যাডভান্সও নেওয়া হয়ে গেছে উদ্যোগী স্বামীর। ফলে একদিন রাশভারী শ্বশুর আদিনাথ সেনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল রমাকে পারমিশন জোগাড়ের জন্য। ফলে যাকে বলে একজন রিলাকট্যান্ট অ্যাকট্রেস, সে রকম এক অনিচ্ছুক শিল্পী হিসেবে ওর টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় প্রবেশ।


(কন্যা মুনমুনের সঙ্গে)

দ্বিতীয় ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ সাফল্যের মাপজোক হয় না, কিন্তু সে সাফল্যের কিছুই প্রায় বর্তায় না সুচিত্রায়। কিন্তু চতুর্থ ছবি ‘ভগবান শ্রীচৈতন্য’-য় রূপের সঙ্গে এক মরমিয়া উপস্থিতি জুড়তে শুরু করে দিয়েছেন সুচিত্রা। হয়তো ওইখানেই আমরা প্রথম আভাস পাই পরবর্তী কালের ‘চন্দ্রনাথ’ ও ‘কমললতা’র সুচিত্রার। প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ থেকে শেষ ছবি পর্যন্ত সুচিত্রা যে ক্রমান্বয়ে সিনেমার রোল ধরে ধরে নিজেকে শুধরেেছেন ও গড়েছেন, তা চোখে না পড়ে যায় না। তাতে কতটা কী পেরেছেন, না পেরেছেন তা নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে।
তবে মনের মতো ছবি ধরে ধরে যে তিনি এগোতে পেরেছেন, সেটা সম্ভব হয়েছিল তিনি নিজের পছন্দের এবং নিজের শর্তে কাজ করতে পেরেছিলেন বলেই। কত ছবির কাজ যে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছলেন, তা নিয়েও একটা গল্প তৈরি হয়ে যায়। অজস্র কাজের অফার এলেও সে সব স্ক্রিনিং করার জন্য কোনও সেক্রেটারি রাখেননি। তরুণকুমারকে বলেছিলেন যে প্রতিদিন সেক্রেটারির সঙ্গে এক-দেড় ঘণ্টা পরামর্শ চালানো বড় সমস্যা। তবে আসল কারণ হয়তো এই যে তিনি কাহিনি ও কাজ নিজেই সরাসরি বুঝে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
ছবির কাহিনি, প্রযোজক ইত্যাদি বাছাইয়ের ধরনে সুচিত্রা একটা একক ঘরানা তৈরি করেছিলেন বাংলায়। খুবই মেজাজি, হয়তো বদমেজাজিও কিন্তু কোনও মতেই খামখেয়ালি নন। ‘আঁধি’র শু্যটিঙের সময় মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ওঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “সব সময় মাথা উঁচু করে কাজ করবে।”
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজের অফারও ফিরিয়েছেন সুচিত্রা। সত্যজিৎ তাঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ ছবির জন্য টানা ডেট চেয়েছিলেন নায়িকার। কিন্তু তা করতে হলে আরও ক’জন প্রযোজকের থেকে ডেট ফেরত নিতে হত। সুচিত্রা সেটা করতে চাননি। ফলে ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর হয়নি। এই আক্ষেপ আজ অনেকেরই। আবার সেই সঙ্গে আরেক আক্ষেপও প্রায়ই শোনা যায়: ‘হায়, নায়ক-নায়িকার এই আভিজাত্য আর কি কখনও ফিরবে না?”


বাড়িতে আপন মুহূর্ত

অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে ফিতে কেটে লম্ফ জ্বেলে খবরে ওঠার দিকে কোনও দিনই ছিলেন না সুচিত্রা। স্টুডিয়ো ফ্লোর ও তার বাইরের জীবনের মধ্যে স্পষ্ট একটা দূরত্ব রক্ষা করতেন। এই বাইরের জীবনটার আবার অনেকখানি জুড়ে থাকত তাঁর পারিবারিক জীবন। যে-জীবনের কোনও প্রচারও তিনি চাইতেন না। এক আত্মীয় আলোকচিত্রী ধীরেন দেব ছাড়া তাঁর খোলা মেজাজের ছবিও খুব বেশি কারও নেই। জীবনের একেবারে শেষ দিকে তিনি যে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, সিনেমা ও সমাজ থেকে, তার প্রস্তুতি-পর্ব কিন্তু খুব কম দিনের নয়।
আজকের সিনেমা জগৎ মানেই তো শিল্পীদের সাক্ষাৎকার, সাক্ষাৎকার আর সাক্ষাৎকার। বলতে গেলে নেই কথার সাক্ষাৎকার। পঁচিশ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তাঁর, তারও পাঁচ বছর পর অবধি (অর্থাৎ অন্তরালবর্তিনী হওয়ার আগে) ক’টা সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় সুচিত্রার?
বলা মুশকিল। তাঁর কথা হিসেবে যা মাঝে মধ্যে ছেপে বেরোত, তা ক্ষমাঘেন্না করে ছেড়ে দিতেন। বলতেন, তাঁদেরও তো কিছু করে খেতে হবে।
তাতে ফল হয়েছে এই, সুচিত্রা নিয়ে বৃত্তান্তের শেষ নেই। হয়তো এই কারণেই গল্পে গল্পে পাওয়া রহস্যে রহস্যে ওঁকে নিয়ে মানুষের কল্পনার উড়ানও স্তর-পরম্পরায় ঊর্ধ্বগামী। ফলে তুলনাটা ফের এসে যায় গার্বোর সঙ্গে। যাঁর মৃত্যুতে ‘ডেলি নিউজ’ পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল, “হারস্ ওয়জ্ আ মিথ মেড বাই মেশিন, বাট ম্যানস্ ইমেজিনেশন টুক ইট ফ্রম দেয়ার টু ডিজিং হাইটস্।” মেশিন তৈরি করেছিল তাঁর কিংবদন্তি। কিন্তু মানুষের কল্পনাই সেটিকে উর্ধ্ব থেকে উর্ধ্বলোকে বয়ে নিয়ে গেছে।


(মুনমুনের স্বামী ভরতদেব বর্মণ, মুনমুন ও তাঁদের দুই মেয়ে রাইমা সেন, রিয়া সেন)


বাঙালি জানে, উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয়ের জন্যই মূলত সুচিত্রা সেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় পৌঁছান। উত্তম-সুচিত্রা জুটি আজও বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে বিবেচিত।

বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত এই জুটিকে অবিস্মরণীয় করে রাখার মতো তেমন কোনো উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ে নি। মানুষের ভালোবাসাই এখনও পর্যন্ত এই জুটির একমাত্র সম্বল। বছর খানেক আগে চিরকালের জুটিকে নিয়ে কিছু করার তাগিদ দিয়ে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে একটি রচনা ছাপা হয়।


২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটি মুক্তি পায়।
ছবিটির জনপ্রিয়তা আজও অমলিন। সেই ছবিতেই প্রথম উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন জুটির অভিনয় দেখা যায়, যদিও এক বতসর পরে অগ্রদূতের ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় ওই জুটির চূড়ান্ত সাফল্য। কিন্তু বঙ্গীয় বইপাড়ায় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের ন্যায় এই হীরক জয়ন্তীও উপেক্ষিত থাকিয়া গেল। সমাজবিজ্ঞান কিংবা মিডিয়া স্টাডিজের দিক হইতে বাঙালি সমাজে এই জুটির অবস্থানটি গভীর ভাবে অদ্যাপি কেহ বিচার করেন নাই।
অত গম্ভীর কাজের কথা না হয় ছাড়িয়া দিলাম, হাত বাড়াইলেই যে রহিয়াছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সংগ্রাহকেরা। তাঁহাদের কেহ কেহ তিল তিল করিয়া সযত্নে সংগ্রহ করিয়াছেন উত্তমকুমার-অভিনীত সকল চলচ্চিত্রের পুস্তিকা ও বিবিধ স্মারক। সেই সংগ্রহকে কাজে লাগাইয়া সহজেই প্রকাশিত হইতে পারে দৃষ্টিনন্দন কফিটেবল গ্রন্থ। কেবল হাতের কাছের খবরগুলি রাখা দরকার, আর দরকার নড়িয়া বসা।’’
বৈবাহিক জীবন সুখের হলেও উত্তম-সুচিত্রা জুটির সম্পর্ক নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। সুচিত্রার অন্যসব কর্মের মতোই এই বিষয়েও রয়েছে অপার রহস্য। এরইমধ্যে অবশ্য কালজয়ী জুটি উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন-এর সম্পর্ক এবং জুটিপ্রথা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। লেখিকা মৈত্রেয়ী বি চৌধুরীর লেখা এই বইটির নাম ‘উত্তম কুমার অ্যান্ড সুচিত্রা সেন : বেঙ্গলি সিনেমাস ফার্স্ট কাপল’।
। উত্তম-সুচিত্রা সম্পর্কে বইটির লেখিকা মৈত্রেয়ী বলেন, ‘উত্তম ও সুচিত্রার মধ্যে একে অপরের প্রতি চমৎকার শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সুচিত্রাকে সহশিল্পী ও ব্যক্তি হিসেবে অনেক সমীহ করতেন উত্তম। তিনি বলতেন, ‘সুচিত্রাকে আমি ভালোবাসি। তবে এই ভালোবাসা ভিন্নরকম।’
এক সাক্ষাৎকারে সুপ্রিয়া দেবী বলেছিলেন
এই রকম নায়িকা? রমাদিকে একেবারে ‘ককেট’ বানিয়ে দিয়েছে। সাদা বাংলায় ‘ছেনাল’। চন্দ্রনাথ সেন নাম দিয়ে ওর স্বামী দিবানাথ সেনকে জোকার। কেবল তাই নয়, প্রচণ্ড ডিগনিফায়েড সুচিত্রা সেন। তিনি ‘শাওনদেবী’ অর্থাৎ কাননদেবীর মুখে সাবিত্রীর প্রশংসায়, আর উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর অভিনয়ের কথায় হিংসায় জ্বলে উঠছে। ঠেস দিয়ে কথা বলছে। এমনকী ডিরেক্টরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে প্ল্যান কষে উত্তম-সুচিত্রা জুটির নতুন ছবির বিশ্রী পাবলিসিটি স্টান্ট দিচ্ছে। তাতে সমান তালে তাল দিচ্ছে মহানায়ক। কোন উন্মাদের মস্তিষ্কপ্রসূত এ সব! ভাবতেও লজ্জা করে। ভাগ্যিস, দু’জনের কেউই আজ এ জিনিস দেখার জন্য বেঁচে নেই!


(নিজের সময়)

১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসরগ্রহণ করলেন। সফল ক্যারিয়ারকে বিদায় জানিয়ে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের অাড়ালে চলে যান। এমনকি লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যান সুচিত্রা সেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতেও রাজি হননি তিনি। অথচ তাই বলে কিন্তু সুচিত্রা হারিয়ে জাননি।

বালিগঞ্জের বাড়িটিতে একা থাকতেন সুচিত্রা। মেয়ে নাতনীরা নিজেদের মতো করে আলাদা। বিভিন্ন সময় পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায় বছর কয়েক আগেও ঘরে বসে টিভিতে নিজের ছবিগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। তবে গত কয়েক বছর রামকৃষ্ণ মিশনের হেডকোয়ার্টার বেলুর মঠে গিয়ে অনেক সময় পূজা অর্চনা করে সময় কাটাতেন।
২০০৯ সালে বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্ব সংক্রান্ত বিবিধ সমস্যায় সহায়তা পেতে লিখিতভাবে ফরম পূরণ করে কলকাতা পুলিশের একটি প্রকল্পে নাম লিখিয়েছেন সুচিত্রা। ‘প্রণাম’ নামে এ প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবে এই প্রকল্প থেকে কখনো কোনো সহায়তা নিয়েছেন বলে জানা যায়নি।
কলকাতার স্বনামধন্য সাহিত্যিক কণা বসু মিশ্র এক স্মৃতিকথায় একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। কলকাতা দূরদর্শনে ‘সাত পাকে বাঁধা’য় সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ফোন করেছিলেন কণা। ততদিনে সুচিত্রা চলচ্চিত্র থেকে বহু দূরে। কণা ফোনে তাকে বললেন সাতপাকে বাঁধায় আপনার অভিনয় দেখে আমি আপ্লুত..অসাধারণ। সুচিত্রা সেন কণাকে থামিয়ে বললেন ‘ওটা অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন, আমি নই।


(তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান)

অভিনয় ক্যারিয়ারে একবার সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা বলেছিলেন’ আমাকে শুধু স্ক্রীনেই দেখা যাবে, কারণ আমি একজন অভিনেত্রী। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের ইন্ডিয়ান কালচারস এন্ড সিনেমার অধ্যাপক ব্যখ্যা করেছেন কেন সুচিত্রার মতো তারকা আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বলেন, এখানে দুটি কারণ থাকতে পারে। একটা হচ্ছে, যারা খুবই সুন্দর। নিজেদেরকে তারা বয়স্ক দেখতে অপছন্দ করেন। সম্ভবত তাদের এই পরিবর্তনকে তারা আমাদের চেয়েও কঠিনভাবে নেন। আর দ্বিতীয় কারণ এমন হতে পারে যে, তারা হয়তো নিজেদের যে সৌন্দর্য মিডিয়া বা মানুষের কাছে ছড়িয়েছেন সেটি থেকে আলাদা থাকতে চায়। পুরনো নিজেকে শেষ করে ফেলে পুরনোতেই। সুচিত্রার ক্ষেত্রে হয়তো এমনই কিছু একটা হয়েছে। তার মায়াবী লক্ষ্মী টেরা চোখ, মায়া ভরা মুখ, লজ্জাবতী হাসি সময়ের আবর্তে আজ হয়তো হারিয়ে গেছে। বয়স হয়েছে অনেক। কিন্তু দর্শক তাকে যেভাবে চিনতো ঠিক সেভাবেই মনের মনি কোঠায় লালন করুক এই চিন্তা থেকে সুচিত্রা বোধ হয় কারো সামনে আর আসেন না।

রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন আসলে শুধু একটা নাম নয়! তিনি বাঙালি হৃদয়ে একটা মিথ। যার চোখ আর কণ্ঠস্বর আজো লাখো তরুনের হৃদয়ে ঝড় তুলে।

আজ মহানায়িকার চলে যাওয়ার তিন বছর হলো। সুচিত্রা থাকবেন সহস্র বছর ধরে কালের প্রবাহে, হৃদয়ে।


সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৬
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×