ক্যাডেট নং – ১৬৪, বদিউল আলম বদি। ৭ম ব্যাচ, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ।
প্রচণ্ড মেধাবী এই শিক্ষার্থীর গল্পের বই পড়া প্রচন্ড নেশা। এই নেশা অবশ্য পরীক্ষায় তার ভাল ফল অর্জনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার নম্বরসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগের মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স। ১৯৭১ সালের মার্চে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন আমাদের বদি। শুধু কি পড়াশোনা! পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগের অনুসারী ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর সক্রিয় সদস্য।
স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র হাতে পান, কিন্তু যোগ দেননি। শুরুতে মা রওশন আরা খানম কিছুটা আপত্তি।
বাবা আবদুল বারী সাহেব মা রওশন আরাকে বললেন, ‘তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে। মা আর আপত্তি করেননি। মেধাবী ছাত্র বদি অল্পদিনের মধ্যে হয়ে ওঠেন পাকিস্তান বাহিনীর আতঙ্ক। পাকি’দের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম ওঠে বদির। তাঁদের ঢাকার বাসাটি গোলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়িও।
মুক্তিসংগ্রাম শুরুর সাথে সাথেই দেশ মায়ের প্রয়োজনে রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলে তিনি ২৮ মার্চ তার নিজ এলাকা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে চলে যান। উদ্দেশ্য ছিলো- সেখানকার ডাকাতদের সংগঠিত করে তাদের অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। ওই সময়ে গফরগাঁও থানা (যা শহীদ বদিউল আলমের নিজের বাড়ির এলাকা) ‘ডাকাতদের এলাকা’ বলে সাধারণ মানুষের মুখে কুখ্যাত ছিলো।
গফরগাঁওয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন ছাত্র মাসুদ ওমর, শহীদুল্লাহ খান বাদল ও আসফাকুস সামাদ (১ম বাংলাদেশ ওয়্যারকোর্সের অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেছিলেন এবং রংপুর জেলার জয়মনিরহাট স্থানে সম্মূখ সমরে ২২ নভেম্বর ১৯৭১ তিনি শাহাদাত বরণ করেন)। শহীদ বদিউল আলম ছাড়া বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের কথা ভাবতেন।
মধ্য এপ্রিলে বদিউল আলম কিশোরগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়ি তারাইল থানার জাওয়ার গ্রামে দু’তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এ সময়েও অদম্য বদিউল ও বন্ধু হেলাল থেমে থাকেননি। সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে তারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন এবং রাজাকারদের নিরস্ত্র করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল তারাইল থানা অপারেশন ও অস্ত্র লুট করা। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র শক্তি বাড়ে এবং তারা মানসিকভাবেও ভীষণ অনুপ্রাণিত হন।
এর পরে তারা দুজনে ঢাকার উদ্দেশ্যে বদিউলের নানার বাড়ি পাকুন্দিয়ায় গেলে হেলালকে বদিউলের মা বলেন, ‘তোরা অসংঘবদ্ধ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে যা করছিস এতে একদিন যেখানে সেখানে ঠিকানাবিহীনভাবে তোদের মৃতদেহ পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তোরা যা, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা কর। এভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে আমার ছেলে যদি মারাও যায়, মা হিসেবে আমি গর্ববোধ করবো।’ এর পরে হেলাল ও বদিউল গফরগাঁও হয়ে ঢাকায় চলে আসেন।
গফরগাঁও পৌঁছার পর তারা শুনতে পান, ২য় ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে কিশোরগঞ্জ গিয়ে অবস্থান করছে। এ খবর শুনে তারাও কিশোরগঞ্জে চলে যান। সেখানে ২য় ইস্ট-বেঙ্গলের কাছ থেকে চারজনের জন্য চারটি পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল, ৪০ রাউন্ড গুলি ও ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে পহেলা এপ্রিলেই তারা ঢাকার আর কে মিশন রোডে আসফাকুস সামাদের বাসায় এসে উঠেন। পরে অস্ত্রগুলো তোষকে মুড়ে তাদের ছাত্রবন্ধু তওহিদ সামাদের (চালক) গাড়িতে করে ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডে আরেক বন্ধু ওয়াসেফ-এর বাসায় নিয়ে যান এবং সবার অগোচরে ওই বাসার পেছনে মাটির নিচে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখেন।
ঢাকা তখন পাক হানাদার বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় পাকবাহিনীর জোর টহল, নিরাপত্তা চৌকি ও অতিতৎপর গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে টিকাটুলি থেকে এরকম বড় আকারের এতোগুলো অস্ত্র ধানমন্ডিতে স্থানান্তর সত্যিই ভীষণ দুঃসাহসের কাজ ছিলো।
ঢাকায় এসে হেলাল তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তিনি বদিউল আলমকেও ভারতে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বদি কোনোভাবেই ভারতে যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিলেন না। কেননা, তাতে তার সে সময়কার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
ধানমন্ডির ৭ নম্বর সড়কের পার্কে ২৭ জুলাই বদিউল ও কামরুল হক (স্বপন)-এর সাথে হেলালের দেখা হয়। তখনও বদিউল জানায়, সে কোনোভাবেই ভারতে যেতে রাজি নয়। সে ঢাকায় থেকেই যুদ্ধ করবে। এরপর হেলাল তার মা ও বোনদের নিয়ে মেঘালয়ের তুরা নামক স্থানে চলে যান। সেখানে মা ও অন্যদের রেখে হেলাল যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য যান। প্রশিক্ষণ শেষ করে যুদ্ধে যাবার সময় হেলাল মায়ের কাছে গিয়ে দেখেন, এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চিন্তায় তার মায়ের সব চুল সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বাধা না দিয়ে বরং উৎসাহই দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হেলালের মা।
বদিউল আলমের মা’ও নিশ্চয়ই ছেলের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আর কোনোদিন বদিউল আলম মায়ের কাছে ফিরতে পারেননি। ছেলে জীবিত না মৃত সে খবরটিও তাঁর জানা হয়নি। জীবনের শেষদিন অবধি ছেলে বদির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। মায়ের আদেশ মেনে বদিউল আলম ‘ক্র্যাকপ্লাটুনে’র সদস্য হিসেবে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের এলাকায় একের পর এক দুর্ধর্ষ ও দুঃসাহসিক সফল অপারেশন পরিচালনা করছিলেন।
বদিউল আলম ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধষ অপারেশনে অংশ নেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো : ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাক বাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১১ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও তাদের দুর্ধর্ষতা ও দুঃসাহসিকতার উদাহরণ। এসব অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের প্রামাণিক ও সঠিক বার্তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
রুমি, বদি এবং আশফাকুস সামাদদের এই গ্র“পটি ’৭১-এ ঢাকায় বেশ কতগুলো সাহসী অভিযান চালিয়েছিল।রুমী যেমন মা ডাকত জাহানারা ইমামকে; বাদল, বদি, সামাদ-আজাদ-শাহাদাত চৌধুরীরাও জাহানারা ইমাম’কে তাই ডাকতেন।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, শহীদ বদিউল আলম করতেন এনএসএফ- ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন, আইয়ুব খান-মোনেম খানদের গুন্ডা ছাত্র সংগঠন। বাদলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সালেক, তার এক বন্ধু স্বপন। তারা কোনো এক জায়গায় ফিজিক্যাল ট্রেনিং নিত। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পর যখন কারফিউ প্রত্যাহার করা হল, তখন বদি এলো ইংরেজি দৈনিক ‘নিউএজ’ এর প্রকাশক শহীদুল খান বাদলের কাছে সঙ্গে সালেক এবং স্বপন। বদিকে দেখে বাদল স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা আতংকিত বোধ করে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় দীক্ষিত এনএসএফের সদস্য বদি; আর বাদলরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। বদির পাশে বাদলের বন্ধু মালেককে দেখে কিছুটা আশ্বস্তও বোধ করে বাদল। কিন্তু বাদলকে উদ্দেশ করে বদি বলে, listen you, commies (commies মানে communists) সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বল তোমরা, কিন্তু কোথায় বিপ্লব? Let's go and fight. বদির এমন আহ্বানের জন্য অপ্রস্তুত বাদল, স্তম্ভিত হয়। চোখে মুখে বাদলের অবিশ্বাস।
বাদলের দ্বিধাদ্বন্দ্ব বুঝতে পারে বদি। পকেট থেকে ব্লেড বের করে বদি, তার এবং বাদলের কব্জিতে একটু আঁচড় দেয়। দুজনের কব্জি থেকে একটু রক্ত বের হয়। দুই কব্জির রক্ত মিলিয়ে বদি এবার বাদলকে বলে, From today, we are blood brothers. Let’s go and fight. একাত্তরের এই দুই যোদ্ধার একজন, বদি শহীদ হয়; আর শহীদুল হক খান বাদল আজও বেঁচে আছেন। বাদল নিজেও অসাধারণ মেধাবী একজন ছাত্র- এসএসসি এবং এইচএসসিতে ঢাকা বোর্ডের প্রথম স্থান অধিকারী এবং যুদ্ধশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট!
হাবিবুল আলমের ( বীরপ্রতীক ) নিজ ভাষায় ধানমণ্ডি অপারেশনের বর্ণনা করেছেন:
*******************************************************************************
( “‘আমরা প্ল্যান করলাম একটা সিরিয়াস টাইপের অ্যাকশনের। সিদ্ধান্ত হলো ২০ নম্বর রোডে (ধানমন্ডি) চায়নিজ এম্বাসি এবং ১৮ নম্বর রোডে জাস্টিস আবদুল জব্বার খানের বাসার সামনে অপারেশন করার। সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ প্রহরায় থাকত।‘কাজী (কাজী কামালউদ্দিন, বীর বিক্রম), বদি (বদিউল আলম বীর বিক্রম), জুয়েল (শহীদ আবদুল হালিম জুয়েল বীর বিক্রম), রুমি (শহীদ শাফী ইমাম রুমী বীর বিক্রম), স্বপন (কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম) ও আমাকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হলো। ‘এবার আমাদের টার্গেট ছিল “অ্যাটাক অন দ্য মুভ”। বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। আগেই রেকি করা হয়েছিল। কিন্তু এর জন্য গাড়ি প্রয়োজন।গাড়ি হাইজ্যাকের ভার পড়ল আমার ও বদির ওপর।
গাড়িটি ছিল মাহফুজ আনামের বড় ভাই মাহবুব ভাইয়ের। সাদা রংয়ের গাড়ি। সামনে ছোট্ট ছেলে ড্যাস বোর্ড ধরে দাঁড়িয়ে। মাহবুব ভাই খুবই ফর্সা। দেখে প্রথমে মনে করেছি, কোনো বিহারি হবেন। আমরা তিনটার দিকে বের হয়েছি। বদি হাত উঁচিয়ে গাড়িটি থামাল। ওর হাতে বন্দুক। বদি ঠাণ্ডা মাথায় বলছেন, আপনি কি অবাঙালি? তিনি বলছেন, আমি বাঙালি। বদি বলছেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আপনার গাড়িটি দরকার। আপনি নামুন, না হলে আপনার ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। আমরা অপারেশনে যাব। আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আপনি থানায় খবর দেবেন যে, আপনার গাড়ি ছিনতাই হয়েছে। এর আগে খবর দিলে পরিণাম খারাপ হবে। আমরা তখন জানতাম না যে, তিনি মাহফুজ আনামের বড় ভাই। মাহফুজ আনাম আমাদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। মাহবুব সাহেব সম্মতি দিলেন। তাদেরকে রিক্সায় উঠিয়ে দিলাম। কিছুদূর আসার পর ড্যাস বোর্ড খুলে দেখি লাইসেন্সে মাহবুব আনাম লেখা। ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি পাকিস্তানের কর্মকর্তা। তখন আমরা বুঝতে পারলাম। তবে আর কিছুই করার ছিল না। এরপর জিয়া, চুল্লু ভাই, মুক্তার আরেকটি গাড়ি নিয়ে এলো। কারণ পরপর দুটি অপারেশন করার কথা। ধানমন্ডি অপারেশন করে গভর্নর হাউজ এবং পিলখানায় অপারেশন করার কথা।
মাজদা রাইটহ্যান্ড গাড়ি। ঠিক হলো আমি স্টিয়ারিং হুইলটা ধরব। আমার অস্ত্র যাবে বদির কাছে। এ অপারেশনে শেষ পর্যন্ত জুয়েলকে নেওয়া হয়নি তাঁর হাতের জখমের কারণে। আমরা গাড়ি নিয়ে ২০ নম্বর সড়কে গিয়ে আশ্চর্য হলাম। দেখি, নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সেনা-পুলিশ নেই। গাড়ি টার্ন করে ১৮ নম্বরে ঢুকে পশ্চিম দিকে এগোতে থাকলাম। দেখি, ব্রিগেডিয়ারের বাসার সামনে আট জোয়ান বসে আড্ডা দিচ্ছে।
‘ইট ওয়াজ হার্ডলি টু-থ্রি সেকেন্ড। একটা ব্রাশ মানে দুই থেকে তিন সেকেন্ড, ১০ রাউন্ড গুলি বেরিয়ে যাওয়া। দুই লেবেলে গেল। কাজীরটা বুক বরাবর, আর বদিরটা পেট বরাবর। আমি খুব আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। আটজনই পড়ে গেল। সহজেই কাজ শেষ হওয়ায় আমরা আনন্দিত ,তারপর ধীরে গাড়ি চালাচ্ছি। স্বপন পিছন থেকে আমার জামার কলার ধরে বলছে এই হারামজাদা আমি ফায়ার করব না? তাহলে গাড়িতে তুলেছিস কেন? বললাম ঠিক আছে, চল। ফের ২০ নং রোডে গেলাম। ৫ মিনিট অপেক্ষা করলাম। কোনো চাইনিজ নেই। স্বপনকে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। তোমার কপালে নেই। চল। গভর্নর হাউজে আরেকটি গাড়ির সঙ্গে মিলতে হবে।
৭ নং রোড দিয়ে যখন নিউমার্কেট রোডে এলাম তখন দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড বসে গেছে। চার-পাঁচটি গাড়ি ইতোমধ্যেই থামিয়ে চেক করছে। আমি স্বপনকে বললাম, তুমি কি চালাতে চাও। স্বপন বলল, হ্যাঁ। আমি স্বপনকে বললাম, দেখ সামনে একজন এলএমজি নিয়ে শুয়ে আছে। ওটাকে নিতে হবে। শেষ করতে না পারলে দুঃখ আছে। বদি বলছে, এ পাশে আরেকটা আছে। আমি বললাম, শেষ করা তোমাদের দায়িত্ব। তবে নিশ্চিত শেষ করতে হবে। ওরা থাম থাম বলছে। গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। একজন গালি দিয়ে গাড়ির সামনে আসল। আমি লাইট বন্ধ করে ডান পাশের ইন্ডিকেটার দিয়ে থামানোর ভান করলাম। এরমধ্যেই স্বপন, বদি, কামাল ফায়ার শুরু করে দিয়েছে। গুলির গরম খোসা এসে আমার পিঠে পড়ছে।
ওরা বুঝতেই পারেনি যে, গাড়ি থেকে এভাবে গুলি হতে পারে। বুঝে ওঠার আগেই আমাদের অ্যাকশন হয়ে গেছে। আমি বলেছি, বামদিকে ইন্ডিকেটার দেখিয়ে ডান দিকে যাব। গ্রিনরোডে আসার বাঁক নিয়ে আমি নিউ মার্কেটের দিকে গেলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরির দেয়ালের কাছে আসতেই রুমি বলছে, জিপ আসতেছে। রুমি আর বিলম্ব করেনি। সঙ্গেই সঙ্গেই পিছনের গ্লাস ভেঙ্গে জিপটিকে লক্ষ্য করেই গুলি। আমি লুকিং গ্লাসে দেখলাম, জিপটি সজোরে গিয়ে একটি খাম্বার সঙ্গে ধাক্কা খেল। সম্ভবত চালকের গায়ে গুলি লেগেছিল।
রুমিকে বললাম, খালাম্মাকে বল তোর বাসার উল্টো দিকে আসতে। কারণ এই আর্মসগুলো রাখতে হবে। আমরা এলিফ্যান্ট রোড থেকে সরু রাস্তা দিয়ে রুমিদের বাড়ির সামনের গলিতে চলে এলাম। দেখি খালাম্মা তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অস্ত্রগুলো তার গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। তিনি বাসায় নিয়ে গেলেন। কাজী কামাল, বদিকেও নামিয়ে দিলাম। রাত আটটা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমি আর স্বপন গাড়ি নিয়ে ভূতের গলিতে ঢুকলাম। ভূতের গলিতে একটি বাড়ির সামনে গাড়িটি রেখে আমরা চুপচাপ হেঁটে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের বাড়িতে চলে এলাম। রুমিকে রেখে বদি এবং কামালও একই জায়গায় চলে এসেছে। সেখান থেকে আমরা ধানমন্ডি চলে গেলাম। এটিই ছিল রুমির শেষ অপারেশন। রুমিরা ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে ধরা পড়ে যায়।“ )—হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক
ঢাকায় তাঁরা এ অপারেশন করেন ২৫ আগস্ট।
২৯ আগস্ট ধানমন্ডিতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিন সাহেবের বাসায় তাঁর ছেলে ফরিদ (এনএসএফ কর্মী এবং এই ফরিদ’ই পাকি আর্মিদের কাছে বদিউল আলমের অবস্থানের কথা পাচার করেছিল), জাফর আহমেদ ও পারভেজ হাসানদের সাথে যথারীতি তাশ খেলছিলেন বদিউল। এখানে বন্ধুদের সাথে প্রায়শই তিনি তাশ খেলার আড্ডায় বসতেন। খেলার একপর্যায়ে জালালউদ্দিন সাহেবের ছেলে ফরিদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আর্মি নিয়ে প্রবেশ করে। পাক-বাহিনীর একটি দল করেই বাড়ি ঘেরাও করে। বদিউল জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। পাক-হায়েনারা সেখান থেকে শুধু বদিউলকেই ধরে নিয়ে যায়। এরপরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২৯ আগস্ট দুপুরের দিকে ওই বাসা থেকেই বদিকে ধরে নিয়ে যায় সেনারা। এরপর দুই দিনের মধ্যে একে একে ধরা পড়েন শহীদ আজাদ, শহীদ শাফী ইমাম রুমী, আবুল বারক আলভী (শিল্পী), শহীদ আলতাফ মাহমুদ (সুরকার), শহীদ জুয়েল (ক্রিকেটার), শহীদ হাফিজ, চুন্নু, বেলায়েত, জহির উদ্দিন জালালসহ অনেকেই। রুমীর বাবা শরীফুল আলম ইমাম ও ভাই জামীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাঁরা ছাড়া পান। কিন্তু আর ফেরেননি বদি, রুমী, জুয়েল, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকেই। তাঁদের লাশও ফেরত পাওয়া যায়নি। কোন তারিখে কাকে হত্যা করা হয় সেই তারিখও নির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব হয়নি।
বদিউল আলমের সহযোদ্ধা মনু বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাশাপাশি সেলে। ঘটনাচক্রে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। মনু জানান, সেনাদের নির্যাতনে বদির একটি হাতের জয়েন্ট খুলে যায় এবং হাড় ভেঙে ঝুলে গিয়েছিল। মনুরও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। বন্দি শিবি ভয়ংকর মার খেয়েও ঠাণ্ডা গলায় শহীদ বদিউল আলম বলেছিলেন, “আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। You Can Go to Hell” ।
নিজের মাতৃভূমির জন্য স্বেচ্ছায় প্রাণ বিলিয়ে দিতে পারে শুধু বদিউল আলম বদি নামক কিংবদন্তীরা তাইতো বদি থাকেন এই বাংলার হৃদয়ে, নিঃশ্বাসে,স্পন্দনে।
তথ্য কৃতজ্ঞতা - রাশেদ রনি, সায়েদ হাসান টিপু, গেরিলা ১৯৭১, হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:৪৮