(১)
হাবিলদার জয়নাল, চাকরী করতেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ে। অধীনে আছে ছোটখাট এক জনযোদ্ধার দল।
এই দলেরকেউ ছাত্র, কেউ মজুর, কেউ বা গ্রামেরকৃষক। সবার পরিচয় জানেন না জয়নাল,
জানার চেষ্টাও করেন না, সময়ও নেই। তার অধীনেই বেশ কিছুদিন আগে একঅপারেশানে মারা যায় এক ছেলে, নাম তালেম।
কিছুদিন পরেই ক্যাম্পে হাজির হয় এক বুড়ি। জিজ্ঞেস করে, " বাবাগো, মোর তালেমরে তোমরা চেনো? ওই যে ছোটখাট পুলাটা। তোমাগো এহানেই শুনি থাকে। তালেমের বাপে খুব রাগী মানুষ, তাই তালেম পলাইয়া আইছে যুদ্ধে।
কোন কাপড় আর ট্যাকা পয়সা নিয়া আইতে পারে নাই। এই অল্প ট্যাকাগুলান আনলাম, তালেমরে দিও। সাথে এই নতুন লুঙ্গিখানও।
আর তোমরা যুদ্ধ করো, অনেক শক্তির দরকার, তাই তোমগো লাইগা এই মুড়িগুলান ভাইজা আনলাম। কী জবাব দেবেন জয়নাল? বুড়ির শেষ বয়সের সান্তনা তালেম। একটি মা কত কষ্ট করে একজন সন্তান জন্ম দেন, কত মমতায় তাকে বড় করেন, খাইয়ে দেন নিজ হাতে, তাকে কীভাবে দেওয়া যায় নিজ সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ? এই বয়সে এই বৃদ্ধা কি পারবে সেই ধকল সইতে?
পারলেন না জয়নাল। কপটতার আশ্রয় নিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টি করে বৃদ্ধার হাত থেকে নিলেন সেই উপহার।
মুখে কিছু না বললেও, অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তুললেন জিনিসটি নেওয়া মানেই বেঁচে আছে, সাথে তার বৃদ্ধার ছেলে। সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে গেলেন তিনি।
কিন্তু নাহ, তালেম ফিরে যায়নি কখনো তার মায়ের কোলে, শুয়ে আছে লাখো শহীদের এই বাংলার কোন এক অজানা প্রান্তরে।
----------------------------------------------------
(২)
ভোলাহাট.! অজানাই বটে! উল্লেখযোগ্য
কোনো স্থান নয়, তাই আমাদের শোনবার কথাও নয়। কিন্তু এই ভোলাহাটের আছে এক অনন্য বিশেষত্ব, যেখানে আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে বাস করতেন এক মহীয়সি বৃদ্ধা। এদেশের সর্ব পশ্চিমের যে চারটি ইউনিয়ন তা নিয়েই গঠিত উপজেলা এই 'ভোলাহাট'। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্গত হলেও ভৌগলিক দিক দিয়ে ভারতের মালদহ জেলারই যেন নিকটে এই উপজেলাটি। আর এই প্রান্তবর্তীত স্থানটি ছিল একাত্তরে সেক্টর-৭ এর অন্তর্গত। এই স্থানে যুদ্ধ তৎপরতা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ায় কমান্ডার লে.
কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান (পরবর্তীতে কর্নেল) নিজে একদিন পরিদর্শনে আসেন ভোলহাটস্থ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। সারা রাত গাড়ী চালিয়ে
প্রত্যুষে ভোলাহাট উপস্থিত হবার পর এই সেক্টরে ঘটে যায় তার জীবনের অন্যতম একটি স্মরণীয় ঘটনা। ভোলাহাট ক্যাম্পে পৌঁছার পরেই তিনি দেখতে পান এক বৃদ্ধা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে এগিয়ে আসছে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের দিকে। জীর্ণ দেহ, রুক্ষ
ত্বক, চোখে পথ চলার ক্লান্তি।
কাছে আসবার পরই কমাণ্ডার নূর-উজ্জামান যোদ্ধাদের নির্দেশ দেন বৃদ্ধাটির ঝুড়ির ভেতর কী আছে তা খোঁজ নিতে। নিজেও এগিয়ে যান বৃদ্ধার কাছে। ঝুঁড়ির ভেতরে উঁকি দিয়েই লাফিয়ে দূরে সরে পড়েন কমাণ্ডার কাজী নূর-উজ্জামান। নির্দেশ দেন এই ঝুঁড়ি যেন
সরিয়ে নিয়ে রাখা হয় বহুদূর।
কারণ সেই ঝুঁড়ি ভর্তি ছিল এন্টি-পার্সোনাল মাইন, যার বিষ্ফোরণে মৃত্যু নেমে আসতে পারতো উপস্থিত সবার।
বুড়িটির কাছ থেকে জানা যায় মুক্তিযোদ্ধারা যে পথ দিয়ে দলদলিয়া নামক একটি ছোট্ট গ্রামের পাশ দিয়ে বোয়ালিয়া যাবার চেষ্টা করতো ঠিক সেই পথেই এক রাতে বুড়ির মনে হলো শত্রুরা কিছু যেন পুঁতে রাখছে।
গ্রামের বয়স্ক এই বৃদ্ধা তার স্বল্প বুদ্ধিতে ভেবেছিল এই জিনিসগুলো লোহা, পেরেক বা কাঁটা জাতীয় কিছু হবে, যা মুক্তিযোদ্ধাদের
পায়ে ফুটলে ব্যাথা হতে পারে। এই কারণেই এই নির্বংশা পৌড়া নিজের টুকড়ি নিয়ে একে একে সব মাইনগুলো তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আনে তা জমা দিতে।
সমরবিদ্যায় বলা হয়ে থাকে, "Bombs
& Explosives can't differentiate friends and foes."
অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে বোমা এবং বারুদ চিনেনা শত্রু-
মিত্র ।
তাই মাইন উত্তোলনকে বিবেচনা করা হয় যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে। কিন্তু নিজের ঝুঁপড়িতে বসেই এই বৃদ্ধা চিনেছিলেন
দেশের শত্রুদের এবং নিজের অজান্তেই বড় একটি ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন দেশের সূর্যসন্তানদের প্রাণ।
চোখ জুড়ে জল নেমে আসে থামাতে পারিনা কখনোই! বুকের কোনে জমে উঠা দীর্ঘশ্বাসে মনে হয়
"কত মাতা দিল হৃদয় উপারী
কত বোন দিল সেবা
সহস্র বীরের রক্তস্রোত
লিখিয়া রাখিল কেবা!"
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৩