সড়কের পাশে ঝাপিয়ে ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া আর নয়নতারা। শহরে এখন বসন্তকাল, বোঝার উপায় স্রেফ অতোটুকুই। ক্লান্তিকর এক দিনের শেষে, বাড়ি ফেরার পথে শ্রান্ত নাগরিকদের চোখের প্রশান্তিও ঐ গাছদুটোই। নামেই বসন্ত। সড়কে সার বেঁধে দাঁড়ানো সারি সারি রিকশা, ভ্যান, পিকআপ, কার, মাইক্রো - ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে অজগরের মতো বয়ে চলেছে লু হাওয়া। বসন্তেও এমন গরম! কেউ দোষে বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধির মচ্ছবকে; কেউ কেউ এও বলেঃ যে রাজাধিরাজের আগমন ঘটবে বলে আজ এই দিনের প্রান্তভাগে তাদের ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে, তারই ক্ষমতার গরমে চারদিক এতোটা উত্তপ্ত।
তারা দাঁড়িয়ে আছে, কারন তারা গণতান্ত্রিক দেশের একনিষ্ঠ প্রজা। রাষ্ট্রের প্রতি, রাষ্ট্রনায়কের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। দেশে চর্চিত হচ্ছে লোকতন্ত্র, কিন্তু মহারাজ আসনে সমাসীন আজ প্রায় ত্রিশ বছর। গণতন্ত্র চর্চার নামে। গণতন্ত্র রক্ষার নামে। প্রজারা অকুণ্ঠ নীরবতা উপহার দিয়ে দিয়ে রাজাকে সমর্থন, ভালোবাসা, আনুগত্য প্রকাশ করে চলেছে। নয়া কোন প্রকল্প উদ্বোধনে মহারাজ যাবেন, বা প্রকল্প উদ্বোধন করে ফিরবেন হয়তো। সারবাঁধা অফিসফেরতা মানুষ, স্কুল - কলেজ - ইউনিভার্সিটি ফেরতা শিক্ষার্থী, কারো কোন রা নেই। মানুষের ভেতরেও তো একটা জানোয়ারের বাস। তবে এদের সবার ভেতরের জানোয়ারই সম্ভবত চমরী গাই। কোন উত্তেজনা নেই, উদ্দীপনা নেই, প্রতিবাদ করার ইচ্ছে নেই, চুপচাপ জাবর কাটা ছাড়া। সামনে পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সুদৃশ্য সাজপোশাক পরা পেয়াদা বরকন্দাজের দল। তারা সড়কের আইন বজায় রাখছে। তাদের আগল গলে একখানা মাছিও সড়কে উড়তে পারছে না।
এমনসময়, একদম সামনের সারিতে খালি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বজলু, হাই তুলতে তুলতে তার রিকশার বেলে একটা টোকা দেয়। বেল বেজে ওঠে, ক্রিং ক্রিং।
সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা বরকন্দাজদের একজন চোখ সরু করে তাকায় বজলুর দিকে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে কলার চেপে ধরে বজলুর। হিসহিস করে কি কি যেন বলে ওকে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে না পেরেই বজলু আরও দু'বার তার রিকশার বেলে টোকা দিয়ে ফেলে, ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং।
আইন রক্ষাকারী বরকন্দাজ বজলুর এ অভব্য আচরণকে বরদাশত করতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ বরাবর ঘুষি হাঁকায়। বজলু উবু হয়ে বসে পড়ে। ওভাবেই বসে থাকে এক অস্বস্তিকর রকমের দীর্ঘসময়।
ঠিক এমন সময় দক্ষিণ দিক থেকে সকলের শরীর - মন জুড়িয়ে যাওয়া এক দমকা হিমেল বাতাস ছুটে আসে। সে বাতাসের আলতো তোড়ে টুপটুপ করে ঝরে পড়ে নয়নতারা ও কৃষ্ণচূড়া গাছের সমস্ত ফুল। পুরো রাস্তা ছেয়ে যায় আগুনরঙা ফুলের পাপড়িতে।
তারপর সকল রিকশাচালক একযোগে বেলের ওপর হাত রাখে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
তারপর সব গাড়িচালক একযোগে স্টিয়ারিং এর ওপর হাত রাখে পিঁপ পিঁপ পিঁপ।
তারপর সব কাভার্ড ভ্যানচালক একযোগে হর্ন বাজাতে থাকে প্যাঁ পোঁ প্যাঁ।
বজলু উঠে দাঁড়ায়। তার আক্রান্ত চোখ গেরিলা বসন্তের বুনো রঙে রাঙ্গা। আকাশে উড়তে থাকা চিল জানে, এই রঙে সড়ক রঞ্জিত হবার আগে রাজার পতন হয় না। হয় নি কোনদিন।
(সাম্প্রতিক দেশকালের সাহিত্যপাতায় একদম সদ্য ছাপা হওয়া ক্ষুদে গল্পটি)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:২৯