শাহাদুজ্জামান
ক্যাটাগরি - কথাসাহিত্য
বর্তমান সময়ে সক্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে আমার তৃতীয় ফেভারিট লেখক শাহাদুজ্জামান সাহেবের জন্মদিনে, ২০২১ সালে, সংবিৎ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তৈমুর আলম, ফিরোজ আহমেদ ও শিবু কুমার শীলের সঙ্গে আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ হয় শাহাদুজ্জামান সাহেবের লেখাপত্রের ব্যাপারে কিছু ক্রিটিক্যাল মতামত রাখার। পুরো লেখাটিই পরবর্তীতে ট্রান্সক্রাইব করে বই আকারে প্রকাশের প্রস্তুতি নেয়া হয়। আমি আমার আলোচনার অংশ, যা প্রায় ৫ হাজার শব্দের, তা থেকে কাটছাট করে কিছু অংশ এই পোস্টটিতে তুলে ধরছি। লেখাটি ছাড়া ছাড়া লাগতে পারে। কিন্তু তবুও লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখা কেন আমাদের পড়া উচিৎ, এবং এই বইমেলায় ওনার বই কেনা উচিৎ, তার ব্যাপারে কিছু ধারনা আমাদের তৈরি হবে এই পয়েন্টগুলোর মাধ্যমে।
প্রত্যেক লেখকের লেখাপত্রের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচিতির মুহূর্ত, একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রেমিকার সাথে প্রথম চোখে চোখ মেলানোর মতোই, তার স্মৃতি দীর্ঘদিন আমাদের মানসপটে অঙ্কিত থাকে। যতদূর মনে পড়ে, শাহাদুজ্জামান প্রথম আলোতে চিরকুট নামে যে কলামটা লিখতেন (যেটা পরে আবার বই আকারে এসেছে), সেই কলামের মাধ্যমেই ওনার লেখাপত্রের সাথে মোটামুটি একরকম অসচেতনভাবে আমার পরিচয়। এরকম না যে তিনি খুব করে লিখছেন, তখনি অনেক বিখ্যাত, অথবা তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি বলেই খুঁজে খুঁজে তার লেখা পড়ি। সে সময়টায়। ২০০৭ - ০৮ এর দিকে পত্রিকা খুলতামই হুমায়ুন আহমেদের কলাম পড়ার জন্য। সেই সুবাদে শাহাদুজ্জামানেরও লেখা পড়া। সাতশ-আটশ ওয়ার্ড এর ভিতরে টুকরো প্রবন্ধগুলো লিখতেন তিনি, খুবই বিচিত্র বিষয়ে অল্প সময়ে অনেক কিছু জানতে পারতাম তার কলাম পড়ে। এই ছিল ওনার লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
তারপর ঢাকা ভার্সিটিতে ইংরেজী বিভাগে যখন ভর্তি হলাম তখন সে ডিপার্টমেন্টাল যেকোর্সগুলো ছিল সেগুলো এত বেশী প্রাধান্য ছিল খুব বেশী সুযোগ হয়নাই যে বাংলাদেশি কন্টেম্পরারি লিটারেচারের উপর পড়াশোনা করার। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র যখন, তখন টের পেলাম যে আমার নিজের লেখালেখির প্রতি ঝোঁক আছে এবং আমি যদি আমার ইমিডিয়েট আগের জেনারেশন - যারা এখনো লিখছেন, অর্থাৎ যাদের ট্রেডিশনে আমরা তাদের ব্যাপারে, তাদের লেখালেখির ব্যাপারে কোনো আইডিয়াই না থাকে তাহলে আমি আসলে বিপদে পড়বো। তখনই সবার আগে আদ্যোপান্ত পড়লাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সব লেখা। মাস্টার্সের বছর কাটালাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সব উপন্যাস এবং গল্প, এবং নির্বাচিত কিছু প্রবন্ধ পড়ে। তারপরে পড়লাম শহীদুল জহিরের লেখা সব গল্প এবং উপন্যাস। তারপরে এসে আমি হাতে তুলে নিলাম শাহাদুজ্জামান সাহেবের ক্রাচের কর্নেল, এবং কয়েকটি বিহ্বল গল্প।আমি বই দুটা কিনেছিলাম, মনে পড়ে, ২০১৫ সালের বইমেলায়। ২০১৬ সালে প্রথম যখন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার চাকরি নেই, আমার সে কর্মস্থল ছিল ফার্মগেটে, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে। আমার বাসা ছিল জসীমউদ্দীন রোড। জসীমউদ্দীন রোড থেকে মতিঝিল, ফার্মগেটে যাওয়ার পথে বাসে বসে আমি শাহাদুজ্জামের ক্রাচের কর্নেল এই বইটা পড়ে শেষ করি। এবং একই সাথে পড়তাম আমার মনে আছে যে শহীদুল জহিরের নির্বাচিত গল্পসমগ্র। এবং পিটার ব্যারির বিগিনিং থিওরি বইটা। আমার মাস্টার্স হচ্ছে অ্যাপ্লাইড লিঙ্গুইস্টিক্স অ্যান্ড ইএলটিতে, তো ভাষাতত্ত্বে তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলেও সাহিত্যতত্ত্ব পাঠে যে ঘাটতি ছিল, সেগুলা কাভার আপ করার চেষ্টা করছিলাম সে সময়ে। তো এই তিনটা বই পাঠের ইতিহাস তো গেলো একসাথে।
তারপরের বছর, ২০১৭ সালে শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবু পাব্লিশ হলো। পাব্লিশের বছরই হচ্ছে এটা কিনলাম এবং কিনে পড়লাম। এই বইটার কথা আলাদাভাবে মনে থাকার একটা কারন আছে। আমি সাধারণত বই কাউকে ধার দেইনা, এবং এই না দেয়াটা একটা লম্বা সময় ধরে। প্রায় পাচ দশ বছর ধরে বই কাউকে ধার দেইনি আগের বাজে এক্সপেরিয়েন্সের কারণে। তো এই বইটা অনেক চেয়ে চিন্তে ধার নিলো একজন, আমার কাছে , সেই ২০১৭ সালেই। আমি তাকে বইটা ধার দিলাম, বিগত দশ বছরের মধ্যে এই একবারই আমার বই ধার দেয়া, এবং ইন্টারেস্টিংলি এই বইটাও আমি আর ফেরত পাই নাই। এছাড়াও, এটাই সাম্প্রতিক সময়ের একমাত্র বই যেটা আমি আরেকজনকে কিনে গিফট করেছিলাম। বই গিফট করা মূলত একটাই, এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম বইটা পড়ে যেটা হচ্ছে আমি আমার জুনিয়র এক ব্লগারকে, যার সঙ্গে একসময় একই ব্লগে লিখতাম, তাকে গিফট করেছিলাম, বলেছিলাম পড়তে আরকি।
ওনার আধো ঘুম ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে এই বইটা পড়লাম ২০২১ সালের জানুয়ারি বা ফ্রেবুয়ারি মাসে, শীতের মাঝে। মানে এই বছর। এই বইটা পড়ার কথা মনে আছে এই কারনে যে, তখন করোনা লকডাউনে আমি অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি, বিকেল চারটার দিকে আমার ডিপার্টমেন্টে ক্লাস নেয়া শেষ হলে মনে হলো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আর অল্পই বাকি আছে, এরমধ্যে পড়ে শেষ করা যায়, আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে এমন একটা বই খুঁজছিলাম। তো, তুলে নিলাম হাতে এই বইটা। এরমধ্যে আবার এক ফ্রেন্ড ফোন দিয়ে জানালো যে সে চাকরীর প্রমোশন পেয়েছে, এবং সে আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে ট্রিট দিতে চায় মাগরীবের নামাজের পর খিলগাও মুক্তা বিরিয়ানীতে। তো এই রকম প্রেসার মাথায় দ্রুতই ছোট এই বইটা পড়ে শেষ করা। আমার কাছে পঠন পাঠনের অভিজ্ঞতা, পুরা বইটা পারসিভ করা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু না। পঠনের অভিজ্ঞতা বলতে একটা বই পড়ার সময় আমার স্ট্যাটাস কি, মানসিক অবস্থা কি, সে সময় আমার রিলেশনশিপের স্ট্যাটাস কি - ইত্যাদি। কারন আমাদের পঠনকালীন মানসিক - পারিপার্শ্বিক অবস্থাও, আমার বিবেচনায় আমাদের একেকটা বই একেকভাবে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে।
শাহাদুজ্জামান গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রথম কারন, তার বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার জগত।
যেকোন শিল্পচর্চার শুরুতে, বেড়ে ওঠার কালে একজন শিল্পীর যে একটি বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার জগত থাকে থাকা লাগে, শাহাদুজ্জামানের সে বিচিত্রমুখীতা ছিল শুরু থেকেই। তিনি প্রথাগতভাবে ডাক্তারি কখনো করতে না চাইলেও, পড়াশোনার শেষাশেষিতে এসে তার ঝোঁক জন্মে বিদেশি জাহাজে ডাক্তার হিসেবে কাজ করবার। এতে করে তাঁর ঘুরে ঘুরে পৃথিবী, এবং নানান সমাজব্যবস্থা সুযোগ হবে। ফাইনালি সেটা হয়নি, কিন্তু তিনি পরে ব্র্যাকের সাথে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে চিকিৎসা নিয়ে কাজ করেন। একটি লম্বা সময়ই বলতে গেলে তিনি গ্রামে কাটান। তারপর তিনি বিদেশে চলে যান পড়াশোনার সূত্রে, এবং একই সঙ্গে চলতে থাকে তার সাহিত্যচর্চা। তার এই বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপটে পরিচিত সমাজের নানা স্তরের মানুষ ও তাদের জীবন উঠে এসেছে তার লেখাপত্রে।
দ্বিতীয় কারন, যেকোনো লেখা লিখবার আগে শাহাদুজ্জামান সাহেবের নেয়া প্রস্তুতি পর্ব। এটা এমন একটা চর্চা, যা সমসাময়িক বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে প্রায় বিরল। বাংলাদেশের অনলাইনে ইদানিং যে কথাসাহিত্যগুলো প্রডিউসড হচ্ছে, তাদের অধিকাংশের লেখার মধ্যেই আমি একটু খেটেখুটে, পড়াশোনা করে একটা লেখা তৈরি করবার লক্ষণ দেখি না। গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের প্রধানতম সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের মতো করে স্পেশাল, কিন্তু হুমায়ুন পরবর্তী যুগে হুমায়ূন আহমেদ যেই প্যাটার্নে সাহিত্য চর্চা করেছেন তারপরে তরুণ অনেক লেখকের মাঝেই আমি সেই একই জিনিস রিপ্রডিউস করার চেষ্টা লক্ষ্য করেছি। একজন শাহাদুজ্জামান আমাদেরকে মনে করিয়ে দেন উপন্যাস লেখার আগে তার বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজন।ফর এক্সাম্পল, তিনি একজন কমলালেবু যখন লিখছেন, তখন কলকাতায় গিয়েছেন। ভূমেন্দ্র গুহ, যিনি জীবনানন্দের সবচে গুরুত্বপূর্ণ গবেষকদের একজন, তার সাথে ইন্টারভিউ সেশন এরেঞ্জ করার চেস্টা করেছেন। কিন্তু মারা যাওয়ার ফলে আর হয়নি। কিন্তু যে জায়গায় জীবনানন্দের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, যে রুমে জীবনানন্দ দাশ হসপিটালে তার জীবনের শেষ সময়টুকু কাটিয়েছেন - সে সমস্ত জায়গায় ঘুরে দেখেছেন। ফিল্ডওয়ার্ক করার যে টেন্ডেন্সিটা…… আমার মনে হয় উনার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে সংশ্লেষ হওয়ার কারণে হয়েছিল। ইলিয়াস ছিলেন খোয়াবনামা লিখছিলেন তখন উত্তরবঙ্গে শাহাদুজ্জামান চাকরি করছেন। তো ইলিয়াস মাঝেমধ্যে কাছে এসে শাদুজ্জামানের সাথে একসাথে ঘুরে দেখছেন জায়গাগুলা। এটা একটা ভূমিকা রেখেছে আমার মনে হয় শাহাদুজ্জামানের সাহেবের এই টেন্ডেন্সি তৈরিতে, মানে গবেষকের টেন্ডেন্সি । এবং তার শিক্ষক - গবেষকের প্রফেশনও হয়তো এ ক্ষেত্রে তাকে হেল্প করেছে মানে এই গবেষকের টেন্ডেন্সি নিয়ে ফার্স্টে একটি প্রিপারেশন নেয়া উপন্যাস লেখার জন্য।
তৃতীয় আরেকটি ইতিবাচক দিক, শাহাদুজ্জামান সাহেবের লেখার - বায়োগ্রাফিক্যাল কাজের কুইন্টেসেনশিয়াল এক্সাম্পল মনে হয় তার উপন্যাসগুলোকে।
চতুর্থত, শাহাদুজ্জামান সাহেব নিজেকে বরাবর হরাইজন্টাল রাইটার দাবি করেছেন এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। কিছু রাইটার আছে যারা ভার্টিক্যাল, যারা নিজেদের একটা পরিচয়ের উপরই ফোকাস করে। ইদার দে আর শর্ট ফিকশন স্পেশালিষ্টস, অর দে আর নভেলিস্ট, ওর পোয়েট। অথবা হয়তো তারা non-fiction লিখে। শাহাদুজ্জামান সাহেব নিজেকে হরাইজন্টাল রাইটার দাবির মাধ্যমে বোঝাতে চান যে কথাসাহিত্যের যতগুলো মাধ্যম আছে, তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি সমানভাবে বিচরণ করেছেন। কবিতায় শুধু তার লেখার আগ্রহ কম ছিল এটা তিনি বলেছেন স্পেসিফিক্যালি, কথায় বা আলাপচারিতায়।
একদম শেষে এসে লেখক শাহাদুজ্জামানের সাহেবের যে ক্যারেক্টারস্টিক্সটা আমার খুব সিগনিফিকেন্ট লাগে, সেটা হচ্ছে তার সাইলেন্ট রিডারদের ওপর ভরসা করার ব্যাপারটা। সাইলেন্ট রিডার হচ্ছে যে এমন একটা ব্যাপারযে, প্রথম হয়তো একজন বা অল্পকিছু পাঠক একজন লেখককে আবিষ্কার করলেন, তারপর তারা সেই লেখকের বই তাদের কাছের অন্যান্য পাঠকদের সাজেস্ট করলেন, এভাবে, লেখকের সঙ্গে সরাসরি কোন সংশ্লেষ ছাড়াই, কেবল তার লেখার গুনে তাকে ঘিরে জমা হওয়া একদল পাঠক। এরাই সাইলেন্ট রিডার। শাহাদুজ্জামান সাহেবের সবসময় ভরসা ছিল এই সাইলেন্ট রিডারদের ওপরে।
লেখক শাহাদুজ্জামানকে চেনার ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তিনি তার লেখা শুরুর করার প্রথম দশ বছর কোন বই বের করেননি। তিনি পত্রপত্রিকায় ক্রমাগত লিখেছেন। দশ বছর পরে তিনি প্রথম বই লেখেন, মানে পাবলিশ করেন। এবং তিনি কখনও তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করেন নাই বা তিনি কখনো সিনিয়র রাইটার কে বলেননি যায়া আমাকে একটি ভূমিকা লিখে দেন। তিনি কখনো কাউকে অনুরোধ করেন নি যে আমার উপরে একটি সমালোচনা গ্রন্থ লেখেন। তিনি কোনো সাহিত্যের দলাদলির ভিতর ছিলেন না। তিনি অন্যায় ভাবে কখনো কাউকে নেতিবাচক মন্তব্য করেননি, কোনো কিছুর আশায় কখনো কারো ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্যও করেননি। তো এই ক্লিন ইমেজের আলোয় আমরা লেখক শাহাদুজ্জামানকে চিনতে বা বুঝতে পারি।
শাহাদুজ্জামান সাহেবের যে বইপত্র আপনার সংগ্রহে না থাকলে এই বইমেলায় কিনতে পারেন -
১। শাহাদুজ্জামানের গল্পসমগ্র ১ - মাওলা ব্রাদার্স
২। ক্রাচের কর্নেল - মাওলা ব্রাদার্স
৩। একজন কমলালেবু - প্রথমা প্রকাশন
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১:২৪