"লাইক আ নিউ ডিজিজ, শি ইজ স্টিল টু ইয়াং টু ট্রিট ...
লাইক আ নিউ ডিজিজ, শি ইজ স্টিল টু ইয়াং ...
লাইক আ নিউ ডিজিজ, শি ইজ ..."
'বুকের ভেতর কচি লাউ ডগার মতো ফিনফিনিয়ে বাড়তে থাকা নতুন এক রোগ সে - এখনি তার চিকিৎসা করাতে চাই না।'
জীবনের গভীরতম এক আনন্দের মুহূর্ত হল এমন কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা পরিতিচি, যার সঙ্গে খানিকক্ষণ আলাপের পরেই অনুভব হয়, লোকটা আপনাকে পুরোপুরি বুঝতে পারছে। পারস্পারিক বোঝাপড়ার অনেক গভীরে ডুবে আপনারা কানেক্ট করতে পারছেন একে অপরের সঙ্গে। অন্যদিকে জীবনের গহীনতম এক দুঃখ হল এই উপলব্ধি, যে - আপনাকে পুরোপুরি বুঝতে পারা, ভেতর - বাহিরে পড়তে পারা মানুষটির সঙ্গেও আপনার সম্পর্ক টিকবে না আজীবন। দূরত্ব তৈরি হবে। অতিবাহিত হয়ে যাওয়া সময়ের স্রোতের মতোই একসময় সে হারিয়ে যাবে আপনার জীবন থেকে।
আনন্দ - বেদনার এই তত্ত্ব অবশ্য আপনাদের, তথা মনুষ্যকুলের জীবন সংক্রান্ত। আমার জন্য নয়। মানুষের জীবনের জ্বালাপোড়া, উত্থানপতন, প্রাপ্তি-প্রস্থানকে ধারন করবার জন্যই আমার জন্ম। তবে আমি মানুষ নই। আমি মানুষের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। আমি একটি গান। সুখে দুঃখে কখনো আপনারা আমাকে গুনগুন করেন, কখনো বাদ্যযন্ত্রের সাথে ফরমালি গীত হই আমি। মানুষের এক মৌলিক দুঃখের জায়গা হল - তাকে বোঝার মতো, উপলব্ধি করার মতো অপরাপর মানুষের দেখা সে একজীবনে বেশি একটা পায় না। আমি যেহেতু মোটের ওপর বিখ্যাত একটা গান, আমার সে সমস্যা নেই। আমাকে শোনার, বোঝার, উপলব্ধি করার মতো মানুষের অভাব নেই। হবেও না কখনো। পুরনো ওয়াইনের মতো, দিন যত যাবে, আমার দাম বাড়বে। গ্রাহকের চাহিদা বাড়বে। ইউটিউবের যে চ্যানেল থেকে আমাকে আপলোড করা হয়েছে, তার সাবস্ক্রাইবার বাড়বে। আমার লিসনার - ভিউ বাড়বে। সেই ভিডিওর মন্তব্যের ঘরে যিনি আমাকে লিখেছেন, সুর দিয়ে গেয়েছেন, তার প্রতি শ্রোতাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বাড়বে। কীভাবে আমার মধ্যে দিয়ে আমার স্রষ্টা তাদের মনের কথাকেই উপস্থাপন করেছেন, কীভাবে এই গানটা তাদের জীবনের সুখ - দুঃখের সারথি হয়ে আছে দীর্ঘকাল ধরে, তা নিয়ে জমা হবে লম্বা লম্বা প্যারাগ্রাফ। পাঠক, আপনি হয়তো এখনো শোনেননি আমাকে। সেজন্য আপনাকে দোষ দিই না। সমাজে ভালো জিনিসের কদর এমনিতেই কম। আপনি তো আপনি, যাকে নিয়ে এই গল্পের শুরু, যে ছেলেটা আমাকে গত কয়েকদিনে কয়েকশোবার শুনে ফেলেছে টানা, লুপে ফেলে - সে নিজেই তো আমার হদিস পেলো এই তো সেদিন। এক পুরুষ আর এক নারী কণ্ঠ ফিসফিসে করে গেয়ে চলেছে আমাকে আদ্যোপান্ত, অনেকটা প্রশ্নোত্তরের মতো করে। যেমন কিনা আপনাদের কবিগানের আসরে কবির লড়াই, বা ওদের ইকবালের শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া। এই আপনাদের - ওদের সীমানা পেরিয়ে, আমার মধ্যে সাংগীতিক সৌন্দর্যটা তবে কোথায়? আছে নিশ্চয়ই কিছু, নইলে আমাকে ধারন করা ভিডিওতে এরকম লাখো শ্রোতা ভিড় জমায় কেন? কেনই বা এই গল্পের প্রধানপুরুষ এরকম লুপে ছেড়ে আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শোনে?
এতোবার, এতো এতোবার, এত দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে শুনতে থাকার পর, আমি এই মুহূর্তে ঠিক আর সে গানটাও নই; বরং আমি পরিণত হয়েছি এই গান সংক্রান্ত এক অনুরণনে। সাইফের মস্তিষ্কের , সাইফের স্মৃতির, সাইফের চিন্তা প্রক্রিয়ার একটি অংশ এখন আমি। গেঁথে আছি ওর মনে, মননে।
সাইফ আর অরুর প্রথম ফরমাল দেখা হবার একটা কাব্যিক বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করি। শরতের সেই বিকেলে আকাশে সাদা মেঘের উপস্থিতি ছিল দস্তুরমতো - যতটা থাকলে কবিরা কবিতা লিখতে উৎসাহ পায়, গীতিকারেরা আপন মনে গুনগুনিয়ে ওঠে নতুন সুর, চিত্রকরেরা রঙতুলি সাজিয়ে বসে নতুন ছবি আঁকতে। শরতকালের কাশফুলের উপস্থিতি ছিল না পীচ ঢালা রাস্তায়, কিন্তু মোড়ের এপাশে ওপাশে দাঁড়ানো হাওয়াই মিঠাইওয়ালার উঁচু করে ধরে রাখা বাঁশের খুঁটির এখান - ওখান থেকে বেরিয়ে থাকা সাদা - গোলাপি - নীলরঙের হাওয়াই মিঠাইগুলো যেন কাশফুল হয়েই দোলার আর ওড়ার অপেক্ষায় ছিল। বাবলস বিক্রেতার ফুঁ দিয়ে ওড়ানো সোনালী - রুপালি বুদবুদে আবৃত রাস্তাটা হয়ে ছিল স্বপ্নিল। পান্থপথের ব্যস্ত সিগন্যালে নানারকম পণ্যের ফেরিওয়ালার উপস্থিতি গাড়ির চালক ও যাত্রীদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। শরতকাল বলতেই আপনাদের চোখের সামনে যে বিস্তীর্ণ নীল আকাশের নীচে দিগন্তজোড়া খোলা মাঠের দৃশ্য ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে প্রবল বৈপরীত্য সৃষ্টি করে রাস্তা জুড়ে উৎকটভাবে ফুটে ছিল জ্যাম। সাইফকে অবশ্য বেশি ভুগতে হয় নি। রাস্তার এপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, পান্থপথের মোড়ে মাত্র দুবার ট্র্যাফিক সিগন্যালের বদল, গোটা তিনেক ভিক্ষুকের ঘ্যানঘ্যান, একজন হিজড়ার হানা সামলে উঠেই সে অপর প্রান্তে অরুর মুখ আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে দেখে। সিগন্যাল ছাড়া মাত্রই হুহু করে ছুটে চলছে প্রাইভেট কার, পিকআপ, সিএনজি, রিকশা। আর সিগন্যাল থামিয়ে দেয়া মাত্র বাইকের প্রবল হর্নে জীবন জেরবার। এরই মধ্যে ঝড়ের কবলে পড়া ভীত এক মায়া শালিকের মতো অরুর মুখখানি ফুটে ছিল রাস্তার ওপাশে।
এতো শান্ত!
এতো মিষ্টি!
এতো মায়াবী!
সাইফ সেদিন গোটা সন্ধ্যা অরুর থেকে চোখ ফেরাতে পারে নি।
অথবা, সঠিকভাবে বললে, সাইফ সে দিন গোটা সন্ধ্যা অরুর থেকে চোখ ফেরাতে চায় নি।
সেদিন বিকেলে সাইফ তার বছরজুড়ে উৎযাপন করে চলা অন্যান্য ক্যাজুয়াল ডেটগুলোর মতোই গড়পড়তা এক ডেটে বেরিয়েছিল অরু নামের মেয়েটার সঙ্গে। আগে, সাকুল্যে হয়তো একবারই সে তাকে বলেছিল যে তার শাড়িতে শরীর জড়ানো আটপৌরে বাঙালি রমণীর সঙ্গ পছন্দ। তাও ঠিক কতদিন আগে যে এ বিষয়ে কথা হয়েছিল তাদের মাঝে, তা তার মনে নেই। অথচ অরু দাঁড়িয়ে আছে মাঝরাস্তায়, গায়ে চোখ ধাঁধানো জর্জেটের শাড়ি জড়িয়ে। গাঢ় খয়রি জমিনে সোনালী পাড়। মেরুন ব্লাউজ। বুকের ওপর মুক্তার দানার মতো বড় বড় পুঁতির মালা। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার ওপর বসন্তের আদুরে স্পর্শে ফুলে ফুলে ভরে ওঠা এক কৃষ্ণচুড়া গাছ যেন সে। তবে এসবকিছু ছাপিয়ে সাইফের দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল অরুর মুখের ওপর। মায়াশালিকের মতো চাহুনি যে মুখচ্ছবির সম্বল ও শক্তি।
"ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এই মেয়ের একটা স্ক্যান্ডাল আছে না?"
পান্থপথের মোড় থেকে ধানমণ্ডি ২৭, গোটা রিকশা সফর আমতা আমতা করে সাইফের বেমাক্কা তীক্ষ্ণ রসিকতাগুলো প্রতিহত করতে থাকা এ মায়াশালিক যে ২৭ নম্বরের সুদৃশ্য বইয়ের দোকানে পা রাখা মাত্র অমন প্রশ্নবোমা ফাটাবে, এটা সাইফের দূরতম ধারণাতেও ছিল না। সাইফের হাতে তখন সদ্য বইয়ের তাক ভেঙ্গে নামানো পাবলো নেরুদা আর লোরকার ইংরেজিতে অনূদিত কবিতা সংগ্রহ। পরিকল্পনা ছিল, অন্য সব মেয়েদের মতো অরুকেও নেরুদা আর লোরকার কবিতা নিয়ে লেকচার দিয়ে ঘায়েল করবে। বাংলা অনুবাদের চে' কবিতার ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ হাতে থাকলে ভাব নেয়াটা সহজ হয়। সঙ্গের মানুষটি আরও সম্ভ্রমের চোখে দেখে।
সাইফের নেরুদা - লোরকা সংক্রান্ত পরিকল্পনাকে ভেস্তে তুলে অরু ততক্ষণে প্রচ্ছদে আঁটসাঁট পোশাকের স্বর্ণকেশীর বইখানা তুলে দিয়েছে সাইফের হাতে। ঠোঁটের কোনে অর্থপূর্ণ তির্যক হাসি ঝুলিয়ে চোখ নাচিয়ে সে সাইফকে বলেছিল - "মেয়েটাকে তো আপনার চেনার কথা,"
সাইফ ঢোক গিলেছিল সঙ্গে সঙ্গে। পৃথিবীর বহু বিষয়ে ওর জ্ঞান অল্প, কিংবা আধখেঁচড়া। তবে বইয়ের প্রচ্ছদে থাকা এ স্বর্ণকেশীকে সে চেনে না - জ্ঞানত এই দাবী করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বিলক্ষন চেনে স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে। খুবই নামজাদা পর্ণোতারকা। ব্যাচেলর, একাকী একটা রুম নিয়ে বাস করে, এবং বাসায় ফিরে রাতে নেট খুলে বসার অভ্যাস আছে এমন সকল পুরুষেরই এই উন্নত বুক - পাছার স্বর্ণকেশীকে চেনার কথা। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় সে আরও প্রচারের আলোয় আসে। পরে সে এই আত্মজৈবনিক বইটা লেখে, তার এস্কর্ট, স্ট্রিপার, এবং পর্ণো মুভির তারকা জীবন নিয়ে।
কিন্তু, সাইফের মাথায় তখন ঘুরছিল স্রেফ একটি প্রশ্ন। যে মেয়ের চোখ মায়াশালিকের মতো, সে কিভাবে এই রূপোপজীবিনীকে চেনে?
সাইফ কৌতূহলি দৃষ্টিতে অরুর দিকে তাকাতেই অরু সাইফের প্রতি দুষ্টুমি মাখা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বইটা নিয়ে নেয় সাইফের হাত থেকে। তুলে রাখে বইয়ের তাকে। পুনরায় হাঁটা শুরু করে বইয়ের মাঝে। প্রায় ফিসফিস করে আমাকে গুণগুনিয়ে গাইছিল তখন অরু -
"ডোন্ট হোল্ড ইওরসেলফ লাইক দ্যাট, ইনফ্রন্ট অফ মি
আই'ভ কিসড ইওর মাউথ, অ্যান্ড ব্যাক
ইজ দ্যাট অল ইউ নিড?
ডোন্ট ড্র্যাগ মাই ওয়ার্ল্ড অ্যারাউন্ড
ভোলক্যানোস মেল্ট ইউ ডাউন ..."
সেই প্রথম সাইফের কানে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল আমার সুর। সাইফের মস্তিষ্কে অনুরণন সৃষ্টি করেছিল আমার কথা। সে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল আমার ব্যাপারে।
"এটা কোন গান গাইছেন আপনি?" প্রশ্নটা করবার সময় সাইফের ঠোঁট ছিল অরুর কানের খুব কাছাকাছি। অরু অবাক হয়ে সাইফের দিকে তাকাতেই সাইফ মুখভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এরকম একটা সেমি - লাইব্রেরী, সেমি বুকশপে যথাসম্ভব নীরবতা বজায় রেখে কথা বলাটাই দস্তুর। স্বাভাবিক হয়ে অরু মিষ্টি হেসে আবারো আমাকে গুনগুন করে গেয়ে চলে। ততক্ষণে তার হাতে উঠে এসেছে বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক।
"হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ, ইজন'ট রিয়েল
হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ, ইউ ডু নট নিড
হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ, ইজ নট হোয়াট ইউ মিন টু মি
কজ ইউ গিভ মি মাইলস অ্যান্ড মাইলস অফ মাউন্টেন
হোয়াইল আই অ্যাস্ক ফর দা সি ..."
বইটা অরু কেনে। সাইফই গিফট করে অরুকে। অরু কথায় কথায় শেয়ার করে আত্মজৈবনিক ধাঁচের বইপত্রের প্রতি তার আগ্রহের ব্যাপারটা। তারপর, ধানমণ্ডি ২৭ এর সেই বইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে যখন তারা হেঁটে চলা শুরু করেছে মিনা বাজারের পাশের রাস্তা ঘেঁষে, তখনও অরু কণ্ঠে আমি - "হোয়াট আই অ্যাম টু ইউ ..."
এ পর্যায়ে সাইফ অরুকে থামিয়ে প্রশ্ন করে, "গানটা আসলে কি বলতে চাইছে?"
"গানটা বলতে চাইছে যে, যে..." শরত সন্ধ্যার দমকা হাওয়া অরুর শরীরের ওপর হামলে এসে পড়ে। তার মুখের ওপর ঝাপটা দিয়ে এসে পড়ে অবিন্যস্ত কেশগুচ্ছ। সে কেশ গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতেই ওর শাড়ি কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়ে। সাইফের চোখ ঝলসে দেয় অরুর শাড়ির ফাঁকে উন্মোচিত হওয়া ধবধবে সাদা পেট, স্ফীত স্তনের একাংশ। অরু বেপরোয়ার মতো আগে তার চুল সামলায়। তারপর টেনেটুনে শাড়ি ঠিক করে। ততক্ষণে সাইফ নিপাট ভদ্রলোকের মতো তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপাশে, দূরে কোথাও।
"গানটা বলছে যে," নিজেকে সামলে নিয়ে অরু আবারো কথা বলা শুরু করে, "তোমার কল্পনায় আমার যে রূপ তুমি তৈরি করে নিয়েছ, বাস্তবে আমি অমনটা নই; আর যে আমি সত্যিকারের আমি - সে আমাকে পুরোপুরি জানার পর তুমি হয়তো আমাকে এতটা উতলা হয়ে আর চাইবে না; তুমি আমার কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ - আমি এখনো তোমার কাছে অতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারি নি; জীবনের কাছে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল সুউচ্চ পর্বতমালা, আর তুমি এসে হাজির হলে মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকা সোজাসাপটা সমুদ্রসৈকতের মতো।"
"এ গানটায় আপনার জন্য একটা ম্যাসেজ আছে," অরু হাসিমুখে বলে। "সেটা ধরতে পেরেছেন?"
সাইফ ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে চুপচাপ হাঁটতে থাকে। এটা তার সদ্য রপ্ত করা এক টেকনিক। যে প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই, তার জবাবে সে ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে চুপ মেরে থাকে।
ততক্ষণে তারা পায়ে পায়ে একটা কফি হাউজে ঢুকে পড়েছে। দরোজায় দাঁড়ানো বেয়ারার সাদর সম্ভাষণ পার করে ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়, কফি হাউজটায় নানারকম বসার ব্যবস্থা আছে। জানালার পাশে সরু - লম্বা লম্বা টুল পাতা, তার সামনে কাঠের তক্তা টেবিলের মতো করে এঁটে দেয়া দেয়ালের সঙ্গে; আরও আছে ছোট ছোট চৌকোনা টেবিলের সামনে পেতে রাখা রেগুলার চেয়ার; মেঝেতে কার্পেটের ওপর গদি আর নিচু টেবিল পেতে রাখা আছে; আরও আছে রেগুলার সোফা ও টিটেবিল। যার যার পছন্দ মতো আসনে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে গোটা ত্রিশেক লোক। আরেকটু নীরব জায়গা হলে সাইফের জন্য ভালো হতো, কিন্তু অরুর পছন্দ যেহেতু এই কফিশপ, কাজেই সে আর উচ্চবাচ্য করে না। এমনকি, মেঝেতে পেতে রাখা কার্পেট - গদির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতে পারলে তার ভালো লাগতো, কিন্তু শাড়ি নিয়ে যেহেতু অরু নীচে বসতে পারবে না, অগত্যা দুজনে মিলে বসেছিল রেগুলার টেবিল চেয়ারেই। সুন্দরী নারীসঙ্গের জন্য নিজের পছন্দ অপছন্দকে সেক্রিফাইস করতে সাইফের সেদিন খুব একটা গায়ে লাগে নি।
দিনটা ছিল শনিবার। দুজনেরই সাপ্তাহিক ছুটি। সাইফ একটা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক। প্রস্তুতি নিচ্ছে পড়াশোনা করতে বাইরে যাবার জন্য। অরু তখন এক প্রাইভেট ব্যাংকের ইন্টার্ন। দুজনের পরিচয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের আইইএলটিসের কোচিং এ। একই ব্যাচ, একই কোর্স টিচারের অধীনে পড়তে পড়তে, গ্রুপস্টাডি থেকে পেয়ার-স্টাডি, ফুলার রোড থেকে দু'সপ্তাহের মাথায় ধানমণ্ডি ২৭। আলাপের বিষয়বস্তুও এরমাঝে আইইএলটিএসের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর।
ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীতে বসে প্রথম দিনের আলাপে কথায় কথায় অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ হয়েছিল তাদের। সাইফ অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিল, অরুর হালের পপকালচারের প্রতি তীব্র ঝোঁক। মেয়েটা বিস্তর খোঁজখবর রাখে দুনিয়ার কোথায় কি হচ্ছে - এ নিয়ে। হেনরি কেভিলকে হারিয়ে কোন কে - পপ স্টার দুনিয়ার সবচে আবেদনময় পুরুষ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে এ নিয়ে তারা দুজন বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলো (সাইফ মনে মনে খোদাকে অনেকগুলো ধন্যবাদ দিয়েছিল সেদিন। পলিটিকাল কারেক্টনেসের চোদনে এই আধামেয়েলী ধাঁচের কোরিয়ান পপ সিঙ্গার ছেলেগুলোকে নিয়ে মনের আঁশ মিটিয়ে ঝাল ঝাড়া যায় না বেশীরভাগ মেয়েদের সামনে)। জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজের 'বড় লোকের বেটি লো' গানের ড্যান্স স্টেপ চেয়ারে বসেই খানিকটা নেচে দেখিয়েছিল অরু, তার সঙ্গে তাল রাখতে সাইফও গানটা গাইছিল তার বেসুরো ভাঙ্গা গলায়। সবশেষে দু'জনে প্রাণখুলে হেসেছিল অনেক। সেদিন দুজনে আলাদা হবার আগে সাইফ অরুকে জানিয়েছিল যে ওর 'ফ্রেন্ডস' টিভি সিরিজটা মাত্র দেখা শেষ হয়েছে। অরু সঙ্গে সঙ্গেই সাইফকে রেকমেন্ড করে 'আ মিলিয়ন লিটল থিংস' নামে আরেকটি সিরিজ। বলেছিল, এটার প্রেক্ষাপটও একদল বন্ধু, তবে এর থিম এবং প্লট বাস্তবতা সংশ্লিষ্ট, এবং বেশ রুঢ় এবং ডার্ক।
কফিশপে বসে সাইফ একটু অস্বস্তিতে ভোগে। সে একজন সদ্য সেপারেটেড অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর।, এভাবে পাবলিক প্লেসে তাকে এক লাস্যময়ী তরুণীর সাথে কোন স্টুডেন্ট দেখে ফেললে ছবি তুলে ফেসবুক - ইন্সটাগ্রাম সবজায়গায় ছড়িয়ে দেবে। ইউনিভার্সিটিতে জানাজানি হলে এ নিয়ে নানারকম কথাবার্তা হবে। মাস্টারের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। শিক্ষার্থীদের নিজের পুত্রকন্যাবৎ ট্রিট করা লাগবে, চাকরির শুরুতেই ডিপার্টমেন্ট প্রধান সাইফকে ডেকে বলেছিল। এদিকে জয়েন করার পরপরই উঁচুক্লাসের দুটো কোর্স সাইফকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওর চে দু' একবছরের ছোট ছেলেমেয়েগুলি প্রথম প্রথম সাইফ ক্লাসে ঢুকলে তাকে পাত্তাই দিতো না মোটে, আর বসের কথামতো তাদের বাপ হওয়ার প্রচেষ্টা তো দূরের স্বপ্ন। কন্যা হতে না চাইলেও কেউ কেউ অবশ্য সাইফের ঘরণী হবার আগ্রহ দেখিয়েছিল হাবেভাবে, বা ফেসবুকে ম্যাসেঞ্জারে। এসব প্রলোভন লিওনেল মেসির মতো ড্রিবলিং করে কাটিয়ে - এড়িয়ে মোটের ওপর এক ক্লিনস্লেটের শিক্ষক হিসেবেই পেশাদারী জীবন কাটাচ্ছিল সাইফ। অথচ অরু আর সে মুখোমুখি বসে এখন, মধ্যিখানে কেবল একটি ছোট্ট টি - টেবিলের দূরত্ব। যতই স্টুডেন্ট নামক পাপ্পারাজ্জিদের ক্যামেরায় বন্দী হবার ভয় থাকুক, সাইফের ভালো লাগছিল এই আগুন নিয়ে খেলা। আগুন নিয়ে খেলা অবশ্য এ ক্ষেত্রে এক ভুল মেটাফর। শীতের রাতে আগুন পোহানোর জন্য আগুনের কাছে আসার সঙ্গে তুলনা দিলে তার আর অরুর এই মিটিং আরও যথার্থ হয়।
"আপনি কফি খান তো স্যার?"
অরু মিটিমিটি হাসছিল প্রশ্নটা করার সময়। ইচ্ছে করেই প্রতিবার অনাবশ্যক রকমের উচ্চকিত কণ্ঠে স্যার শব্দটি জুড়ে দিচ্ছিল সে, প্রতিটি উচ্চারিত বাক্যের আগে - সাইফকে অস্বস্তিতে ফেলবার জন্য। যেন টিচার - স্টুডেন্ট, বা বস - পার্সোনাল সেক্রেটারি টাইপের একটা অলীক স্ক্যান্ডাল তৈরিতে খুব আগ্রহ তার। সাইফ প্রথম দু'একবার আঁতকে ওঠার পর ওর খেলাটা ধরতে পেরে আর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল না। মুচকি মুচকি হাসছিল কেবল। কফি ওয়ার্ল্ড দারুণ ব্যাস্ত এক কফিশপ, পশ - হোমরাচোমরা লোকজনের উপস্থিতিতে প্রায় সবসময় গমগমে। ওরা দুজন কফিশপটার ভেতরের দিকে একটা ছোট টেবিলে মুখোমুখি রাখা দুটো চেয়ারে বসা। ওপর থেকে একটা মাত্র আলো সরাসরি তাদের টেবিলে এসে পড়ছে। এই আলোতেই সাইফ অরুর কপালে তারার মতো ফুটে থাকা টিপটা লক্ষ্য করে। স্টাইলটা একটু ভিন্ন, অপরিচিত। টিপ কি আসলে একটা না দুটো ? বড় একটা গোল টিপের নীচের দিকে সংযুক্ত অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি টিপ। অরুর প্রসাধনীর প্রতিটা খুঁটিনাটি ডিটেইল সাইফের চোখে আলাদা করে ধরা পড়ছিল, মূলত অরুর মিষ্টিপানা মুখচ্ছবির জন্যে।
"অরুর কি প্রথম থেকেই বাইরে স্যাটল হবার প্ল্যান?" খেজুরে আলাপ চালিয়ে নেয়ার জন্য সাইফ প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করে।
"তাই তো ছিল এতোদিন" অরু কফির মগে সুড়ুত করে চুমুক দিয়ে বলে, "আপনার সঙ্গে দেখা হবার পর অবশ্য উদ্দেশ্য বদলে গেলো। ভাবছি আপনার সঙ্গেই স্যাটল হব।"
বিষম খেয়ে সাইফের মুখের তালু পুড়ছিল খানিকটা, গরম কফিতে।
"আরে দুষ্টুমি না। সত্যি সত্যি বলেন।"
এই প্রশ্নে অরুকে আনমনা লাগে যেন খানিকটা। শনিবারের সন্ধ্যার উসিলায় জনাকীর্ণ ধানমণ্ডি সাতাশের পানে চেয়ে থাকে চুপচাপ। তারপর সাইফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল,
"এসব ক্যারিয়ার বিষয়ক জীবনমুখী আলোচনা করবেন বলে তো আমাকে নিয়ে বের হন নি সাইফ স্যার। আপনার কথা বলুন। চল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সে এসেও আমার বয়েসি একটা মেয়েকে নিয়ে আপনার এসব ছুটির দিনের বিকেলগুলো বরবাদ করা লাগে কেন?"
"দু' একটা ছুটির বিকেল বরবাদ করে যদি জীবনটা নতুন করে আবাদ করা যায়, ক্ষতি কি তাতে?" সাইফের ঠোঁটের কোনে ছিল দুষ্টুমিমাখা হাসি। খেলা জমে উঠছিল আস্তে আস্তে।
তারপর তাদের কথা হয় ঢাকার যানজট নিয়ে, বাংলাদেশের ছেলেপেলেদের বিসিএসমুখীতা নিয়ে, অ্যাভেঞ্জারস এন্ডগেমের সমাপ্তি নিয়ে, গেম অফ থ্রোনসের শেষ সিজনের তৃতীয় এপিসোড নিয়ে, কোন লেখকের লেখা ইদানিং বেশী পড়া হচ্ছে, মুরাকামি এ বছর নোবেল পাবে কি পাবে না -তা নিয়ে, পাবলিক আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কালচারের তফাৎ নিয়ে। এরকম টুকটাক আরও নানা বিষয়ে তাদের কথা হয়। তারপর, একটা পর্যায়ে এসে তাদের আলাপ বয়স্ক, লক্করঝক্কর ছ্যাঁকরা গাড়ির মতো ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায়। আর এগোয় না। দীর্ঘায়িত নীরবতা তাদের মধ্যে অস্বস্তি বৃদ্ধি করে চলে। অরুর মত এক ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ের সাথে অফিসে সেন্স অফ হিউমারের জন্য বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন সাইফের কথাবার্তা এগুচ্ছে না - ব্যাপারটা সাইফের জন্য আরও এককাঠি এমব্যারেসিং হিসেবে প্রতিভাত হয়।
"আজ উঠি তবে," অরু তার স্মার্টফোনটা ব্যাগ থেকে বের করতে করতে বলে।
দু'জন বেরিয়ে আসে কফিশপ থেকে। ধানমণ্ডি ২৭ এর রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ভেজা বাতাসের তোড় ততক্ষণে আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল। বৃষ্টি শুরু হবে হবে - এমন এক পরিবেশ। বড় বড় দু' এক ফোঁটা বৃষ্টি অবিন্যস্তভাবে পড়ছে এর ওর গায়ে মাথায়। সবার মধ্যে একটা ত্রস্ত ভাব। সবাই প্রায় ছুটে চলছে। সাইফের মনে পড়ে সকালের আবহাওয়ার পূর্বাভাস। উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় 'উড়ুক'।
আগামী পরশুদিন ভোরবেলা তা কক্সেসবাজার সমুদ্র উপকূল অতিক্রম করবে। কিন্তু তার প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া এবং বজ্র সহ বৃষ্টিপাত চলবে আজ রাত হতে আগামী তিনদিন।
"যাবেন কীভাবে?" সাইফের এ প্রশ্নের জবাবে অরু অন্যমনস্ক ভঙ্গীতে বলে, "উবারে"।
উবার অ্যাপে কল করার পর ধানমণ্ডি ২৭ থেকে আজিমপুর ছাপরা মসজিদের গলি ভাড়া দেখায় আড়াইশো টাকার মতন। উবার আসতে আসতে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। দুজনের একজনের কাছেও ছাতা ছিল না সে সন্ধ্যায়। সাইফ নিজের ব্যাগ অরুর মাথার ওপর ধরে ওকে এগিয়ে দেয় খানিকটা। নিজে কাকভেজা হয়, অপরদিকে অরুকেও বাঁচাতে পারে না বৃষ্টির ছাঁট থেকে, পুরোপুরি। সাইফকে অরু রাইড অফার করে। সাইফ মুচকি হেসে বলে, রাইড করা তার দরকার, তবে যে রাইড তার প্রয়োজন, তা উবারের রাইড নয়। কথাটার গুঢ় অর্থ ধরবার নিয়তে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে সাইফের দিকে তাকিয়ে থেকে ফের হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে অরু। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে স্পষ্টস্বরে অরু সাইফকে শেষ একটা প্রশ্ন করে,
"আপনি আমার কাছে ঠিক কি চান, সাইফ?"
প্রশ্নটা যেন ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে উড়তে উড়তে আচমকা এসে হানা দেয় সাইফের মনে। বৃষ্টির মাঝে মাঝরাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ে সাইফ। তৎক্ষণাৎ বলবার মতো কিছু খুঁজে পায় না। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সেটা ছিল না মোটেও। তাদের মধ্যের সম্পর্ক তরল থেকে ক্রমাগত ঘন হয়ে জমাট বাঁধছে, তা তারা দুজনেই টের পাচ্ছে। কিন্তু এ সম্পর্কের নাম কি? সে ঠিক কি চায়, অরুর কাছে? বৃষ্টির গতি বাড়ে। রাস্তায় জলের স্রোতের সঙ্গে খড়কুটো, চিপসের প্যাকেট, কাগজের ঠোঙা ইত্যাদি ভেসে যেতে থাকে। উবারের ড্রাইভার মুখ শক্ত করে বলে, "ম্যাডাম, জানালার গ্লাস তুলে দেন। সিট ভিজে যাচ্ছে।"
"গানটা আবার শুনবেন বাসায় গিয়ে," জানালার গ্লাস তুলে দেয়ার আগে এই ছিল সাইফের প্রতি অরুর শেষ কথা।
গাড়িটা যখন দ্রুতগতিতে শঙ্কর বাস স্টপেজের দিকে বাঁক নিচ্ছে, ঠিক তখন সাইফের মনে হল, অরুর প্রশ্নের উত্তরটা তার জানা আছে। সে চাইলে অরুকে বলতে পারে যে সে ঠিক কি চায় তার কাছে। কিন্তু ততক্ষণে সেই গাড়ি চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাস্তা জুড়ে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব, আর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। জনশূন্য পথে মোটর যানের শোঁ শোঁ গমনাগমন।
নিজের ছোট্ট একলা ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে সাইফের রাত এগারোটার মত বাজে। ফিরে এসে সে পোশাক বদলায়। তারপর ফেসবুকে বসে। ম্যাসেঞ্জারের নীলসাদা খামে এসে জমা হওয়া বার্তাগুলো পড়ে। কিছুকিছুর জবাব দেয়। কয়েকটা টেক্সট অপঠিত অবস্থায় রেখে দেয়। কাউকে কাউকে উপযাচক হয়ে টেক্সট পাঠায়। অরু ফোন দেয় একটু পর। কথা হয়। প্রয়োজনীয় - অপ্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে কথা। অবশেষে ফোন কেটে দিয়ে সাইফ বিছানায় শুয়ে পড়ে। সাইফের চোখ সিলিঙে ঝুলে থাকে, সিলিঙে ঝুলে থাকে ঘূর্ণায়মান সিলিংফ্যান, সিলিং এ ঝুলে থাকে জর্জেটের শাড়ির নিচে মেরুন রঙের ব্লাউজ উপচে পরা অরুর স্তনদ্বয়। তার অশান্ত নাভির নীচটাকে শান্ত করার প্রয়োজন হয়। সাইফ সময় নিয়ে মাস্টারবেশন করে। অরু কল্পনায় তার সহযাত্রী হয়। অর্গাজমের সেই চরম মুহূর্ত শেষে মস্তিষ্কের প্রভাস্বর শূন্যতা কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে আসার মিনিট খানেকের মধ্যে সাইফ আবারো তার মস্তিষ্কের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অরুর উপস্থিতি টের পায়। এক অজানা ভীতি তাকে চেপে ধরে।
অরুর সঙ্গে তার এই সম্পর্ক কি তার অন্যান্য ক্যাজুয়াল কফি ডেটের পর্যায়কে অতিক্রম করে যাচ্ছে?
রাত প্রায় শেষ হয় হয়, কিন্তু সাইফের ঘুম আসে না। নগ্ন শরীরে সাইফ বিছানা থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে যায়। সময় নিয়ে তার শরীর ধোয়। তারপর, নগ্ন অবস্থাতেই হেঁটে হেঁটে রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালা খুলে দেয়া মাত্র, যেন সাঁঝবেলার সেই ভেজা বাতাসই প্রবাহিত হয়ে যায় সারা ঘর জুড়ে। তখনও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে ঢাকার আকাশ ভেদ করে। দীর্ঘায়িত এক শেষরাত আজ। মেঘের কারনে ভোরের আলো ফুটে উঠতে পারছে না। সামনের উঁচু উঁচু দালানের কয়েকটি ফ্ল্যাটে এখনো আলো জ্বলছে। কি করছে তারা এখন, এই মুহূর্তে, আলো জ্বালিয়ে? তাদের জীবনের সঙ্গে সাইফের জীবনের তরঙ্গস্রোত কি মেলে কোনভাবে?
ঠিক তখন সাইফের মনে পড়ে অরুর সে অনুরোধ, 'বাসায় গিয়ে গানটা শুনবেন'। সাইফ উঠে গিয়ে পিসিতে ইউটিউব ওপেন করে। আমাকে খুঁজে বের করে। গোটাগোটা অক্ষরে টাইপ করে - ভোলক্যানো - ডেমিয়েন রাইস। ক্লিক করে প্লে বাটনে। সাইফের ফ্ল্যাটে শেষ রাতের নীরব প্রকৃতি বাঙময় হয়ে ওঠে চেলোর বাদনে। আমার কথায়, সুরে।
" ............
দিস ইজ নাথিং নিউ
নো নো! জাস্ট অ্যানাদার চান্স অফ ফাইন্ডিং -
হোয়াট আই রিয়েলি নিড
ইজঃ জাস্ট হোয়াট মেইকস মি ব্লিড,
অ্যান্ড লাইক অ্যা নিউ ডিজিজ,
শি ইজ স্টিল টু ইয়াং টু ট্রিট"
সাইফ ফিসফিসিয়ে ওঠে, লাইক অ্যা নিউ ডিজিজ, শি ইজ স্টিল টু ইয়াং টু ট্রিট! পুরো গানটার (অর্থাৎ আমার) অর্থ - সাইফের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই কাতরতম শেষরাতে। সাইফ বোঝে, গানটা তার হয়েই কথা বলছে। কি চায় সে অরুর কাছে? অরুর কাছে তার চাওয়ার নতুন কিছু নেই, নিজেকে রক্তাক্ত করার স্রেফ আর এক নতুন উপলক্ষ্য ছাড়া। তবুও সে নতুন করে ভালোবাসায় পতিত হতে চায়, রক্তাক্ত করতে চায় নিজের ভেতর বাহির। জীবনে এমন কারো উপস্থিতি চায়, যার অখণ্ড মনোযোগ হবে তার কাম্য, যার উপেক্ষা তাকে রক্তাক্ত - ক্ষতবিক্ষত করবে, যার কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করবে সম্পূর্ণভাবে। এসবই তো চাই তার অরুর কাছে।
এদিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে, লুপে বেজে চলছি আমি, অর্থাৎ, গানটি।
বৃষ্টিস্নাত ভোর রাতে সাইফের শীত শীত লাগে, কিন্তু তার নগ্ন শরীরে কিছু চড়াতে ইচ্ছা করে না। পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে সে বসে থাকে জানালার পাশে। যেন পুবাকাশে সূর্যদয় দেখা তার জন্য খুব জরুরী। সূর্যের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তার সমস্ত জট খুলে যাবে। মাস্টারবেশনের পরেও মেয়েটার চিন্তা তার মাথা থেকে উবে যাচ্ছে না, এর অর্থ কি? ইজ শি হিজ নিউ ডিজিজ? বুকের ভেতর কচি লাউয়ের ডগার মতো ফিনফিনিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন অসুখ অরু? সাইফ টের পায়, তার মস্তিষ্ক পাখির পালকের মতো হালকা, কিন্তু মন পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। সে তখনও জানে না যে ঢাকা শহরে এই তিনদিনের ঝড় বাদলা স্থায়ী হবে পাঁচদিন, এবং এই পাঁচদিনে তার অরুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের কোন উপলক্ষ্য তৈরি হবে না, এবং এরপর যখন তা হবে ততদিনে সাইফের মনে আর বিন্দুমাত্র কনফিউশান থাকবে না তার জীবনে অরুর অবস্থান নিয়ে।
সে পাঁচদিন পরের কাহিনী। এই মুহূর্তে রুম জুড়ে বেজে চলেছি আমি, আর সাইফ মুখ ঝুলিয়ে এখনো বসে আছে। সে উত্তীর্ণ হয়েছে উপলব্ধির এক নতুন স্তরেঃ নিজের অস্তিত্বের ভেদকে খুলে ন্যাংটো করে দেয় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া বিড়ম্বনা বটে, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিড়ম্বনা, আরও নিদারুণ দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে প্রশ্নটি সঠিক মানুষের তরফ থেকে আসা। যে প্রশ্নকর্তা আসলেই বুঝবে উত্তরদাতার উত্তরের গভীরতা, বেদনার গভীরতা, অন্তর্জাত হাহাকারের তীব্রতা। সাইফ উপলব্ধি করেছে - জগতে সবচে কঠিন দুঃখের একটা হল এই যে - আসলেই আপনার দুঃখ বুঝবে, এমন মানুষের কাছ থেকে জিজ্ঞাসিত হওয়া, আপনার দুঃখটা আসলে কি।
আসুন, আমরা সাইফকে তার নতুন অসুখের জন্য শুভেচ্ছা জানাই!
(পুরো উপন্যাস পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে - view this link )
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:২৭