বইমেলা ২০২৪ এ আমার দুটো নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে / হচ্ছে। আমার ৫ম গল্পগ্রন্থ, নির্বাচিত দেবদূত প্রকাশিত হয়েছে অনুবাদ প্রকাশনের ব্যানারে। বইটির পরিবেশক কাগজ প্রকাশন (স্টল ৪৫৩ - ৪৫৪)। আমার ৩য় অনুবাদ গ্রন্থ, এলিফ শাফাকের ফরটি রুলস অফ লাভ (আমার বঙ্গানুবাদে - দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন) প্রকাশিত হচ্ছে ঐতিহ্য প্রকাশন (প্যাভিলিয়ন ২৫) থেকে। এরা যথাক্রমে আমার ৯ম ও ১০ম প্রকাশিত গ্রন্থ।
নির্বাচিত দেবদূতের ফ্ল্যাপে বইটির পরিচিতি -
গ্রন্থে বক্ষ্যমাণ গল্পগুলির প্রধান চরিত্রগুলির অভিজ্ঞতার জগত ভিন্ন, বেদনার রঙ ভিন্ন, উৎযাপনের উপলক্ষ্য ভিন্ন। তবুও কীভাবে যেন তাদের জীবন বাঁধা পড়ে আছে একই তানে। সিনেমা বানানোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা তরুণ সহকারী পরিচালকের বেদনা যদি মুদ্রার এক পীঠ হয়, তো মুদ্রার আরেক পীঠে ঝড়ের রাতে একাকী নিজের বিশাল ফ্ল্যাটে বসে রাতের ঢাকার দিকে অপলক চোখে চেয়ে থাকা ছেলেটি। যে মেয়েটি সুনামগঞ্জে গিয়ে তার বাবার শিরিষ গাছের ডালে ঝুলে পড়ার কারন উদ্ঘাটন করতে চায়, সেই বাবার ছায়া কি নিজ বাড়ির ছাদের রেলিঙে হেঁটে বেড়ানো লোকটির মাঝেও দেখা যায় না? জীবন সঙ্গীকে হারানো, বা প্রয়োজনের চেয়েও বেশী পেয়ে যাওয়া, সবশেষে পরমে মিলিয়ে যাওয়ার আকাঙ্খা - জীবন তার সমস্ত রঙে রূপে এসে ধরা দেয় এ গল্পগুলিতে। সাতটি গল্পকে একত্রে রিফু করে নানাবিধ পুরুষালী সুখ - দুঃখ, প্রাপ্তি ও বঞ্চনার ফিরিস্তি, যাপিত জীবনে যার তেমন কোন নান্দনিক সৌন্দর্য নেই। আপনার - আমার পরিচিত ব্যাটামানুষের উৎযাপিত না হওয়া গল্পগুলিই এই বইয়ের গল্পগুলির মাধ্যমে উৎযাপন করে নেয়া যাক।
এলিফ শাফাকের দা ফরটি রুলস অফ লাভের অনুবাদকের ভূমিকা -
এলিফ শাফাকের দা ফরটি রুলস অফ লাভের বঙ্গানুবাদ ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
১।
জন্মসূত্রে তুর্কি ও বর্তমানে তুর্কি - ব্রিটিশ প্রবাসী ঔপন্যাসিক এলিফ শাফাকের ভক্ত মাত্রই জানেন, জনপ্রিয় যেকোনো উপন্যাসের মতো, এলিফ শাফাকের দা ফরটি রুলস অফ লাভ প্রকাশের পরপরই অনূদিত হয়ে গেছে আমাদের মাতৃভাষায়। তবুও কেন আরও একবার এই বই অনুবাদের প্রয়াস হাতে নেয়া? এই প্রশ্নের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কিছু চিন্তা, এবং অনুবাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়া অনুবাদক হিসেবে জরুরী মনে করছি।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি এবং তার আধ্যাত্মিক বন্ধু ও পথ প্রদর্শক শামসুদ্দিন তাব্রিজের সম্পর্ককে উপজীব্য করে রচিত, বর্তমান তুরস্কের সবচে জনপ্রিয় নারী লেখকের এই উপন্যাসটি অনুবাদের কাজে আমি হাত দিই মূলত মাওলানা রুমির প্রতি আমার গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসার সূত্রে। বিংশ শতকের শুরুতে, অ্যামেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ জর্জিয়ার সাহিত্যের অধ্যাপক কোলম্যান বার্কসের ইংরেজিতে করা রুমির কবিতার অনুবাদ, আলোচনা রুমিকে পাশ্চাত্যে বহুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। বিশ্বব্যাপী কোন একটি আদর্শ, মতবাদ, শিল্পকর্ম - ইত্যাদিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতার কোন বিকল্প নেই। রুমিকে গ্লোবাল ফেনোমেনায় পরিণত করবার ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিক জগতের শূন্যতা ভরাটের এক সচেতন প্রয়াস ছিল। কিন্তু আমি সৌভাগ্যবান এই কারনে যে, রুমির জীবন ও কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় কোলম্যান বার্কসের ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে নয়, বরং পুরনো ঢাকায় আমার জন্মানো ও বেড়ে ওঠার সময়কালে, শৈশবে ও কৈশোরে সূফীদের মুখে রুমির গল্প ও কবিতা শুনে এবং মসনবি শরীফের বঙ্গানুবাদ (মাআরেফে মসনবি - আরেফবিল্লাহ হাকিম মুহাম্মদ আখতার সাহেব প্রণীত) পাঠ করে। আমার চোখের সামনে মসজিদের মিম্বরে বসে খোদার প্রেমে কাতর সূফীসন্তদের আমি দেখেছি রুমি বা রুমির মতো খোদা প্রেমিক কবিদের বয়েত পড়ে তুরীয়ানন্দে মগ্ন হয়ে যেতে। স্মৃতিতে এখনো সে সব বয়াতের দু'-এক ছত্র জাগরুক, যেমন - "কারদো সাব জাঞ্জিরে আহলে বারতারাম / গায়রে আহ জাঞ্জিরে জুলফে দিলবারাম" (সরল বঙ্গানুবাদেঃ পার্থিব প্রেমের যত শিকলেই আমাকে বাঁধার চেষ্টা করো না কেন, আমি এক ঝটকায় তোমার সব শেকল ছিঁড়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবো, স্রেফ আমার খোদার মহব্বতের শেকল ছাড়া। সেই শেকল তো আমি খুশী খুশী গলায় ঝুলিয়ে বসে থাকতে আগ্রহী।), অথবা "মান তু সুদাম তু মান সুদি / মান তান সুদাম তু ঝাঁ সুদি" (সরল বঙ্গানুবাদেঃ আমি তোমাতে পরিণত হয়েছি - তুমি আমাতে পরিণত হয়েছ / আমি যদি শরীর হই, তবে তুমি সেই শরীরের রূহ)। অথবা, ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনার পর, কোলম্যান বার্কসের ইংরেজি অনুবাদে যখন রুমি পড়ি, একদিকে কৃতজ্ঞ হয়েছি এই কারনে যে, রুমির অনেকানেক কবিতা - ফার্সি ভাষায় আমার জ্ঞান না থাকায় যাদের হয়তো কখনো পড়া হতো না, সেগুলো পড়া হয়ে গেলো ইংরেজিতে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে হয়েছে, উর্দু - ফার্সি - আরবি কবিতার ইংরেজি অনুবাদে মূল কবিতার সৌন্দর্য যেন অপঘাতে মারা যায়। রুমির কবিতার সারবত্তা ইংরেজিতে ধরা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি।
এলিফ শাফাক, এই কাজটি আমার বিবেচনায় কোলম্যান বার্কসের চে' উত্তম রূপে সম্পাদন করেছেন মূলত দুটি কারনে। এক, তিনি বার্কসের মতো নন ফিকশান লেখার চেষ্টা করেন নি, বা রুমির কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের দুঃসাহস দেখান নি। তিনি উপন্যাসের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন কনটেক্সটে রুমি এবং শামসকে উপস্থাপন করে ইতিহাসভিত্তিক এক সফল সৃজনশীল শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন। এবং, দুই, তুর্কিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়ায় রুমি - শামসের ব্যাপারে তার বোঝাপড়া এতোটাই গভীর, যা অর্জন অন্য মানুষের জন্য খুবই দুরূহ। এই উপন্যাসটি শাফাকের লেখা মূল ইংরেজি ভারশনে আমার হাতে এসে যখন পৌঁছায়, আমি তখন ব্যক্তিগত জীবনে এক সঙ্গিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। শাফাকের এই বইয়ে উপস্থিত শামস ও রুমির মিথস্ক্রিয়া তখন আমার কষ্টে বনস্পতি ঔষধের মতো কাজ করে। তখনি সিদ্ধান্ত নিই, আজ হোক বা কাল - এই বই আমি অনুবাদ করবোই। কাজেই, ঠিক আর্থিক লাভ, বা অনুবাদকের পেশাদারিত্বের চিন্তা থেকে নয়, শামস ও রুমির প্রতি গভীর ভালোবাসার সূত্রে ধরেই, বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে এই জনপ্রিয় উপন্যাসের সঙ্গে পুনরায় পরিচিত করবার প্রয়াস হাতে নিয়েছি। অনুবাদ করেছি এই বই।
২।
একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটা পাঠকের মনে এই অনুবাদ গ্রন্থ হাতে নেয়ার পরপরই মনে আসবে, তা হল - মূল বই থেকে অনুবাদ কলেবরে বর্ধিত হয়ে গেলো কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া মুশকিল। তাই নিজের ব্যাখ্যাটি দিচ্ছি সংক্ষেপে।
শামস বা রুমি যদি বাংলাভাষায় কথা বলতেন - তবে যেভাবে বলতেন, তার অনুরূপ একটা ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা ছিল আমার এই বঙ্গানুবাদে। যে সমস্ত সূফী টার্মস শাফাক মূল বইয়ে ইংরেজিতে ব্যবহার করেছেন, আমি সেগুলো প্রকৃত সূফী পরিভাষায় অনূদিত করে, পরে তার বাংলা অর্থটি ফুটনোটে না বসিয়ে পাশে কমা দিয়ে একই বাক্যে সংযুক্ত করে দিয়েছি। উদাহরনত, "ফলোয়িং দা ফুটস্টেপস" - এই বাক্যাংশ বা ফ্রেইজের "ফুটস্টেপস" শব্দটি যদি বিবেচনা করি, তবে তার সরল বঙ্গানুবাদ হবে - পদাঙ্ক। কিন্তু সূফী পরিভাষায় ফুটস্টেপসের অনুবাদ হবে "নকশে কদম"। কাজেই, আমার বঙ্গানুবাদ হয়তো এরকম হয়েছে - "... তার নকশে কদম অনুযায়ী, তথা পদাঙ্ক অনুসরণ করে ..."। অর্থাৎ, পাঠককে মূল সূফী পরিভাষার সঙ্গে সচেতনভাবে পরিচিত করিয়ে দেয়ার একটি প্রয়াস আমার ছিল, যা উপন্যাসকে কলেবরে বৃদ্ধি করেছে। এই সূত্রেই উপন্যাসে উদ্ধৃত হয়েছে - লকব, মাকামাত, মাকসাদ, মাজনুন, কাইফিয়াত, খুলুসিয়ত, শক্কে ছদর, নজর আন্দাজি - এরকম আরও অজস্র সূফী পরিভাষা, যার বঙ্গানুবাদও একই সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে একই বাক্যে - পাশাপাশি।
দ্বিতীয়ত, ইংরেজিতে হয়তো রুক্ষ - শুষ্কভাবে একটি বিশেষ্য ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু বঙ্গানুবাদে সেই বিশেষ্যের পিছে সম্পূরক বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে প্রসঙ্গক্রমে, পাত্র বিবেচনায়। উদাহরণত, একটা নির্দিষ্ট দৃশ্যে শামস হয়তো ভারাক্রান্ত মনে একটি বাক্য শুরু করছেন, এলিফ শাফাকের রচনায় - "ডিয়ার গড..." এই দুই শব্দে। বঙ্গানুবাদ করার ক্ষেত্রে , শামসের মুড বিবেচনায় আমি হয়তো তার তর্জমা করেছি - "আমার মাহবুব, আমার খোদা ..." এভাবে। প্রাসঙ্গিক বিশেষণের সংযুক্তিও অনুবাদটি কলেবরে বৃদ্ধির আরেক কারন।
তৃতীয় আরেক কারন হল, ইংরেজি ভাষা - খোদ নিজে। ইংরেজি একটা ঔপনিবেশিক ভাষা হবার কারনে এর শাব্দিক এবং ব্যাকরণগত ব্যাপ্তি অনেক বেশি; একই সঙ্গে মনের জটিল অথবা দীর্ঘায়িত ভাবকে সীমাবদ্ধ করে একশব্দে, বা দুইশব্দের একটা শব্দবন্ধে নিয়ে আসার একটা সক্ষমতাও আছে এই ভাষার। লেখক যা বোঝাতে চেয়েছেন তা যথাযথভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আমার ইংরেজিতে একটি শব্দের বদলে বাংলায় দু'য়েকশব্দ বেশি ব্যবহার করা লেগেছে। তবে এ কাজটিও করা হয়েছে চূড়ান্ত সততা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে।
এ উপন্যসের আরেকটি সৌন্দর্য হল, উপন্যাসের ভেতর যে উপন্যাস, "সুইট ব্লাসফেমি" - যেটা কিনা শামস আর রুমির সম্পর্কের গল্প বলে আমাদের, তার প্রতিটি অধ্যায় আরবি হরফ "বা", অথবা ইংরেজি "বি" শব্দটি দিয়ে শুরু হয়। আমিও এই বঙ্গানুবাদে অনুরূপ অধ্যায়ের প্রত্যেকটি বাংলা "ব" বর্ণটি দিয়ে শুরু করেছি। এই কাজ করতে গিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে সেই প্যারার প্রথম বাক্যের বদলে দ্বিতীয় বাক্যটি দিয়ে প্যারা শুরু করা লেগেছে, যদিও অর্থ কোথাও বদলায় নি, কোহিয়ারেন্স- বা গল্পের যৌক্তিক যে প্রবাহ, তা নিরবচ্ছিন্ন রয়েছে।
পুরো উপন্যাসে ছোট ছোট যে সমস্ত কবিতার ব্যবহার আছে, আমি তাদের শাব্দিক অনুবাদ করি নি। ভাবানুবাদ করেছি। শাব্দিক অনুবাদ অনেক ক্ষেত্রেই অনুবাদের সৌন্দর্যকে হত্যা করে। এতো ব্যাখ্যার বদলে যদি এক কথায় এটা এলিফ শাফাকের উপন্যাসের ভাবানুবাদ বলতাম, তা হলেও হতো। কিন্তু আমি অনুবাদকের জায়গা থেকে বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন বোধ করেছি। কারন ভাবানুবাদ বলতে আমাদের দেশে যা প্রচলিত, এটা সে অর্থে ভাবানুবাদ নয়। এলিফ শাফাক যা বলেন নি, বা বোঝান নি - এমন কিছু আমি সংযোজন করি নি এই অনুবাদে। একই সঙ্গে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা বাদ দিই নি কোথাও। শাফাকের উদ্দেশ্য ছিল শামস - রুমি সম্পর্কের মর্মমূলকে স্পর্শ করা। তাতে তিনি সফল। অনুবাদক হিসেবে আমার উদ্দেশ্য ছিল এলিফ শাফাকের এই বইটির রূহকে ধারন করা। আমি তাতে কতোটুকু সফল হতে পেরেছি, তা আমার প্রিয় পাঠকরাই বিচার করবেন। এবং, সহৃদয় পাঠকের পাঠে যদি কোন ভুলত্রুটি ধরা পরে, আমার গোচরে আনলে তা পরবর্তী সংস্করনে সংশোধন করে নেবো বলে আশা রাখি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৮