পৃথিবীব্যাপী বৌদ্ধধর্ম্যালম্বি বন্ধুদের বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভেচ্ছা।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ সালে, হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নামে একটি ক্ষুদ্ররাজ্যে শাক্যবংশের রাজা শুব্ধোদন ও তার জ্যেষ্ঠ রানী মহামায়ার একমাত্র পুত্রসন্তান হিসেবে জন্ম নেয়া সিদ্ধার্থ গৌতমকেই গোটা পৃথিবী একনামে চেনে গৌতম বুদ্ধ হিসেবে। বুদ্ধের আবির্ভাব ব্রাহ্মণ্যবাদ - এবং জন্মসূত্রে পাওয়া ব্রাহ্মণ - ক্ষত্রিয় - বৈশ্য - শুদ্র - চামার - হাড়ি - ডোম - চণ্ডাল ইত্যাদি জাতপাতের বিচ্ছেদাঘাতে জর্জরিত একটি কালে, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে। নিরঞ্জনা নদীর তীরে, বোধিবৃক্ষমূলে বসে স্নায়ুক্ষয়ি নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানের পর তিনি বোধি লাভ করেন, বুদ্ধ উপাধি ধারন করেন, যার বাংলা - 'আলোকপ্রাপ্ত'।
বুদ্ধের প্রচারিত বিশ্বাসের জন্ম বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের কোলে। সত্য লাভের আকঙ্খায় তার প্রাথমিক যে ধ্যান ও যোগচর্চা, শরীরকে নানারূপে কষ্ট দিয়ে স্নায়ু ও তন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস - তা সে ইংগিতই দেয় আমাদের। বোধিপ্রাপ্তির আগে হিন্দুধর্মের পুন্যস্থান বেনারসে তৈরি হয়েছিল তার খুব সংক্ষিপ্ত এক ভক্তকুল।
উল্লেখ অপ্রয়োজনীয় যে মধ্যপ্রাচ্যের উসর মরুঅঞ্চলে প্রবলবেগে স্রোতস্বিনী আব্রাহামিক ধর্মচর্চার স্রোত, আর গৌতম বুদ্ধের সাধনা, বোধিলাভ, ধর্মশিক্ষার সময়কাল প্রায় এক হলেও - এই দুই ধর্মমতের প্রত্যক্ষ কোন সংযোগ বুদ্ধের জীবদ্দশায় মেলে নি। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের কোলঘেঁসে যে দর্শনের জন্ম , বারো মাসে তেরো পার্বণের মহলে যার হাঁটতে শেখা, হাজারো দেবদেবী, জাতপাত, এবং শ্রেণীবৈষম্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যার বিস্তৃতি, বিচিত্রভাবে বুদ্ধ সেখানে আঘাত করলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের মূলে। তার প্রচারিত ধর্মবিশ্বাস ঈশ্বরের অস্তিত্ববিহীন , মানুষ জীবনকুণ্ডলীর ঘূর্ণায়মান চাকার পরিক্রমায় নিজ কর্মফল পূর্ণ করার মাধ্যমে নির্বাণলাভ তার দর্শনের মূল কথা। তিনি তার ভক্তকুলের মধ্যে প্রচার করলেন তার ধর্মের মূলমন্ত্র - মধ্যপথ, চার আর্যসত্য, এবং অষ্টমার্গ। ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে বৈদিক বিশ্বাস জাতিগত, বা রক্তগত আর্যতায় বিশ্বাস করতো, বৌদ্ধ প্রচার করলেন চার সত্যের আর্যতা - জীবন দুঃখময়, দুঃখের কারণ অজ্ঞতা, দুঃখ দূর হয় অজ্ঞতার দূরীকরণে, অজ্ঞতা দূরীকরণ হয় অষ্টমার্গ অবলম্বনে। অষ্টমার্গ হল - সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক চেষ্টা, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি ( নীরুকুমার চাকমা, বুদ্ধঃ ধর্ম ও দর্শন)
গৌতম বুদ্ধের জীবন ও কর্মকাণ্ডের ধর্মীয় তাৎপর্যের আলোচনা পাশে সরিয়ে রেখে যদি বুদ্ধ সৃষ্ট পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে যদি আলাপ করি, প্রথমে যেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে - বুদ্ধের পরিচয়ের লড়াইয়ের সবচে প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল বৈদিক ধর্ম। বৈদিক ধর্ম বলতে আমি ২০২০ সালের হিন্দুধর্মকে বোঝাচ্ছি না। আজকের বাংলাদেশ - ভারত - নেপাল এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিন্দুধর্ম্যালম্বিদের নিয়ে যে হিন্দুধর্ম , তা আর্যদের সাথে আসা বৈদিক ধর্মের সাথে অনার্য তন্ত্রবাদী ধর্মচর্চার সব মোটাদাগের ও সূক্ষ্মভেদের তফাৎ মোচনের পর যে মিশ্রণ দাঁড়ায় সেটাই। আমাদের বঙ্গঅঞ্চলের লোকদের আদি অরিজিন - অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আলপিয়। আর্যদের চোখে বৃহৎ বঙ্গের মানুষদের পরিচয় ছিল অসুর হিসেবে। কৃষিভিত্তিক বঙ্গের চাষাভুষা অনার্য ব্রতাচার - আর্যদের ধর্মানুষ্ঠানের তুলনায় ভিন্ন ছিল বলেই আমাদের ব্রাত্য বলে উল্লেখ করা হত। এখন যেমন অ্যামেরিকান বা ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরেজি বলাকে স্ট্যাটাস হায়ারারকির র্যাঙ্ক হিসেবে ধরা হয়, গৌতম বুদ্ধের সময়ে সে স্ট্যাটাস ভোগ করতো সংস্কৃত ভাষা।
গৌতম বুদ্ধের জীবনদর্শনের রাজনৈতিক আলাপে তার এই দুই কাজ - ঔপনিবেশিক আর্যজাতির প্রচারিত বৈদিক ব্রাহ্মণবাদের সূত্রে সৃষ্ট জাতভেদ অস্বীকার, এবং আর্য ভাষা সংস্কৃতের বদলে ব্রাত্যজনের ভাষা 'পালি' কে ধর্মোপদেশ প্রচারে ব্যাবহার।
এভাবে - জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, শ্রেণীভেদ মোচন, এবং ব্রাত্যজনের কথ্যভাষাকে আপন করে নেয়ার জন্যে - কলোনিয়ালিজম , অর্থাৎ উপনিবেশবাদী জাতি, তাদের ভাষা, তাদের নির্মিত তত্ত্ব ও চিন্তার বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্যে বুদ্ধের যে রাজনৈতিক চেতনা - তা উপনিবেশবিরোধী তত্ত্বচর্চার আন্দোলনে আমাদের পথিকৃৎ হয়ে থাকবে।
আলাপ একটু ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা যাক।
বাংলাভাষায় চিন্তা করেন এবং লেখেন, অথবা চিন্তা করা ছাড়াই লেখেন - এ জাতীয় একশ্রেণীর মানুষ আছে, যারা বিশ্বাস করেন, এবং প্রচার করতে পছন্দ করেন যে - পাশ্চাত্যের রাজনীতি, লাইফস্টাইল, ইকোনমিক পলিসি কোনোরকম বাছবিচার, কাটছাঁট না করে যদি বাংলাদেশের উপর, বা পাক - ভারত উপমহাদেশের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় , তবে আমাদের এই অঞ্চলের যত সমস্যা, তা ঝাড়ে বংশে নির্মূল করা সম্ভব।
এই চিন্তা অজ্ঞতাপ্রসূত, নিজের পিতৃপরিচয় সম্পর্কে ওয়াকেফহাল না থাকার ফল। এ প্রচারণা কলোনিয়াল হেজিমনি প্রচারের এক ন্যাক্কারজনক পায়তারা।
কিছুক্ষণ আগে শশী থারুরের লেখা , ভারতে ব্রিটিশ রাজের উপর প্রামাণ্যগ্রন্থ - অ্যান এরা অফ ডার্কনেস উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। বইটির চতুর্থ পাতায় তিনি একটি পরিসংখ্যান দিয়ে আলোচনা শুরু করেন -
সতেরশো শতকে , মুঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের ইকোনমি ছিল গোটা পৃথিবীর ইকোনমির ২৭ শতাংশ - যা ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, অন্যান্য স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সহ পুরো ইউরোপের ইকোনমির সমান।
তার ২০০ বছর পর, ব্রিটিশ রাজের অধীনে ভারতীয় উপমহাদেশের ইকোনমি এসে দাঁড়ায় বৈশ্বিক ইকোনমির ৩% এ।
আসুন প্রশ্ন করি - কেন? কিভাবে?
আমাদের যে বন্ধু বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্যের জীবনব্যবস্থার গুণকীর্তন করতে করতে কীবোর্ডের বাটন ক্ষয় করে ফেলছেন, তাকে অনুরোধ করি, আপনার ফসটার ফাদারদের আজ যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, তাদের যে উন্নত জীবনব্যবস্থা, তাদের যে নিছক জ্ঞানচর্চার খাতিরে দর্শনের ডুগডুগি, প্রযুক্তির পেছনে ঢালার মত অঢেল টাকা, এর পেছনে আমার - আপনার দাদার দাদার দাদার দাদা'র রক্ত, ঘাম মিশ্রিত অর্থের ইউরোপ অভিমুখী পাচার আছে। ইউরোপের জীবনব্যবস্থা আর তাদের চিন্তা-দর্শন দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত বা এই ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক সমস্যা সমাধানের টোটকা পরামর্শ দেয়ার আগে এই ঐতিহাসিক সত্য যেন ভুলে না যাই।
যেন ভুলে না যাই যে মনুষ্যরূপী শয়তানের মূর্ত প্রতিকৃতি আপনার ইউরোপিয়ান ফসটার ফাদারেরা। ব্রিটেন থেকে লোভী পশুগুলো যখন প্রথমবারের মত অ্যামেরিকা খুঁজে পেয়ে ওখানে গিয়ে ওঠে, তখন নিজেদের উপনিবেশ ছড়ানোর জন্যে সরল সোজা অ্যামেরিকান ইন্ডিয়ান, বা রেড ইন্ডিয়ান (এইটা কিন্তু একটা রেসিস্ট টার্ম, মনে রাখবেন, যেমন কিনা নিগ্রো। রেড ইন্ডিয়ান বলার বদলে অ্যামেরিকান ইন্ডিয়ান, বা ওল্ড অ্যামেরিকান বলা উত্তম, যেমন কিনা নিগ্রোর বদলে কালারড অ্যামেরিকান) দের মধ্যে গিয়ে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে যে পোশাক এবং কম্বল প্রদান করে, সে পোশাক এবং কম্বলে ছড়ানো ছিল গুটিবসন্তের বীজ। (আহরার আহমেদ, জ্ঞানতাপশ আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন, অ্যামেরিকান রেভলিউশানের ওপর বক্তৃতা)। অ্যামেরিকার আদি অদিবাসিদের ইমিউন সিস্টেম ঐ গুটিবসন্তের সাথে পরিচিত ছিল না বলে বেচারারা ব্রিটিশদের বিশ্বাস করে তাদের উপহার দেয়া পোশাক গায়ে দিয়ে গুটিবসন্তে ভুগে ঝাড়ে বংশে উজাড় হয়ে গেছে। তাদের জায়গায় জায়গা দখল করে তৈরি আজকের অ্যামেরিকা।
মাঝেমধ্যে হালকা চালের কথাবার্তায় - "আরে হালা তুই তো দেখি ব্রিটিশ!" বাক্যে, ব্রিটিশ বলতে আসলে কি মিন করা হয়, হয়তো বুঝেছেন।
পৃথিবীব্যাপী দাসব্যাবসার সবচে বড় নেটওয়ার্ক ছিল ইউরোপের দাসব্যাবসায়িদের হাতে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাই - যে কথাটা বুদ্ধ বলেছিলেন খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ সালে, হজরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন বুদ্ধের জন্মগ্রহণ করার ১০০০ বছর পরে - এই সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যে অ্যামেরিকায় সিভিল ওয়ার হয় ১৯ শতকে, দাসপ্রথা রদ করার জন্যে।
যারা একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের স্বপ্নে দেশ ছেড়ে বিদেশ-বিভূঁই এ পাড়ি জমিয়েছেন, আমাদের গরীব দেশে বিদেশী রেমিটেন্সের ফ্লো বজায় রেখেছেন তাদের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা। কিন্তু তাদের মধ্যে যে শ্রেণী অজ্ঞাতকুলশীলের কিছুদিন আল্পস পর্বতের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মনে হয় - এবার হিমালয়রে ল্যাং মারা দরকার, বা পাশ্চাত্যের জীবনধারা - দর্শন - চিন্তাচেতনার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে তা কোনরকম বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া আমাদের দেশের সমস্যা সমাধানের চূড়ান্ত মাধ্যম বলে প্রচার করছেন, তাদের থামা উচিৎ। এটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। আমরা দুটো ভিন্ন ধারার ফলাফল। আমাদের অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের পেছনে ঐ অজ্ঞাতকুলশীল ( ব্রাত্যজনের বাংলায় এর তর্জমা হারামজাদা) রা যে ক্রমাগত আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে কুসংস্কার/ অন্ধবিশ্বাসের সমার্থক বলে প্রচার করে এবং দায়ী করে, ওদের কেউ বুঝায়ে বইলেন, এটাও পশ্চিমের তৈরি ঠুলি।
অধ্যাপক নীরুকুমার চাকমা এবং অধ্যাপক রায়হান রাইনের যে বইদুটো পড়ে বুদ্ধ ধর্ম এবং বাংলার চিন্তার আদি ইতিহাস নিয়ে পড়ছি, তারা দুজনেই একটা বিষয়ে একমত - পাশ্চাত্যের জ্ঞানচর্চা কলাকৈবল্যবাদের সমান্তরাল। জ্ঞানচর্চার খাতিরে জ্ঞানচর্চা।
উদাহরণ - "আমি আমার সামনের দেয়ালটাকে দেখছি বলে দেয়ালের অস্তিত্ব স্বীকার করা যায়, কিন্তু আমি যে দেয়ালটা দেখছি - এইটাতো আমি দেখতে পাচ্ছি না। তাইলে আমার অস্তিত্বের প্রমাণ কি? আমি আছি? আমি নাই? তাইলে কি দেয়ালও নাই? তবে আমি আছি কিনা এই চিন্তা যেহেতু আমার মাথায় আছে, তাই আমিও আছি" - এই হচ্ছে পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চার একটা ধারা। এত চিন্তা করার বদলে সামনের দেয়ালে মাথায় দুইটা ধাম ধাম বাড়ি দিয়েও তো আমি আসলে আছি নাকি নাই তা পরীক্ষা করা যায়। জোকস অ্যাপার্ট, ডেকারতের অতিসরলীকরণ করা হয়ে গেল বটে, কিন্তু জ্ঞানচর্চার জন্যে জ্ঞানচর্চাটা কিরকম, তা এরচে সহজ ভাবে কিভাবেই বা বোঝানো যেতো।
বৌদ্ধধর্ম, এবং আমাদের অবিভক্ত বঙ্গের যে ধর্মীয় চিন্তাচেতনা এবং দর্শন - তা জ্ঞানচর্চার খাতিরে জ্ঞানচর্চা না। জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রায়োগিক দার্শনিক চিন্তা।
কিভাবে?
পড়েন। রেফারেন্স তো উপরে দিয়েই দিলাম।
নিজের মাটির ঘ্রাণছড়ানো দর্শন বাদ দিয়ে পশ্চিমা দার্শনিকদের কথা শেষ কথা মনে করে নিয়েন না। তাদের তৈরি পরিভাষায় নিজেকে মাপতে জায়েন না। ঐটা তাদের ছক, তাদের ট্র্যাপ, তাদের জগতব্যাপি শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রোপ্যাগান্ডা। তার বুদ্ধিবৃত্তিক নিম্নরূপ হচ্ছে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা, আর পরিশীলিত রূপ হচ্ছে তাদের জ্ঞান- তত্ত্ব - দর্শনচর্চা।
পরিভাষা হচ্ছে সংজ্ঞা, কোন একটি টার্মের ডেফিনেশন।
ইংরেজি আর বাংলার পরিভাষাগত পার্থক্যের কারণে, ধুপধাপ ইংরেজি থেকে বাংলায় টার্ম অনুবাদ করবার ফলে প্যাঁচ লাগে কিভাবে তার একটা উদাহরণ দেখবেন?
যদি জিজ্ঞেস করি রিলেজিয়ন মানে কি, আপনি বলবেন ধর্ম। যদি বলি রিলেজিয়নের অ্যান্টোনিম কি, বলবেন এথিস্ট। যদি বলি এথিস্ট কারে বলে, বলবেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। যদি বলি গৌতম বুদ্ধ তোঁ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো না, তাইলে তো বুদ্ধ এথিস্ট, অধর্মের প্রচারক।
কিন্তু আমরা তো বলি - বৌদ্ধবাদ, একটা ধর্ম। আমাদের পাসপোর্টে , ন্যাশনাল আইডি কার্ডে ধর্মের জায়গায় লেখে - বুদ্ধিস্ট।
সমস্যা কোন জায়গায়?
সমস্যা হইল - পরিভাষার অনুবাদে।
বা ইউরোপের রিলেজিয়নের কনসেপ্টে বাংলার ধর্ম যাচাইয়ের চেষ্টা।
ইংরেজি ভাষায় যে জ্ঞানচর্চা হয়, তার লিটারেল পারিভাষিক অনুবাদ দিয়ে আপনি অঙ্গ -বঙ্গের অনেক কিছুর ব্যাখ্যাই করতে পারবেন না।
যেমন, বাংলায় ধর্ম শব্দের উদ্ভব ধৃ ধাতু থেকে, যার অর্থ ধারন করা। জীবনের পক্ষে যা কিছু ধারণযোগ্য, তাই ধর্ম। এ অর্থে সমস্ত জীবনই ধর্মক্ষেত্র। সংসারধর্ম, রাজধর্ম, পিতৃধর্ম - ইত্যাদি কথা ধর্ম শব্দটির অর্থের বিস্তারকে নির্দেশ করে। সাত্ত্বিক বা রাজসিক সমস্ত কর্মই ধর্ম - পরোপকার, শরীরচর্চা, রাজকার্য পরিচালনা করা, বা ভ্রমণ, এসবই ধর্ম, যদি তা জীবনের পক্ষে হয়, নতুবা তা অধর্ম। অর্থাৎ, বাংলার পরিভাষায় ধর্ম কথাটি দিয়ে যা বোঝানো হয় তা নৈতিকতার সমর্থক। কাজে ধর্ম কথাটির এ অর্থ অন্সারে মানুষের কাজের শ্রেণী তিনটি নয় বরং দুটি - ধর্ম এবং অধর্ম। এ অর্থে ধর্ম নিরপেক্ষ কোন শ্রেণী থাকতে পারে না। ( নিখিলরঞ্জন মতিলাল, রায়হান রাইনে উদ্ধৃত, ২০১৯)। কাজেই ইংরেজি রিলেজিয়ন শব্দটির সাথে এককাতারে ফেলে বাংলার ধর্মচর্চার তুলনা করতে যাওয়াটাই একটা সমস্যা।
এতো গেলো অর্থগত দিক, এবার আসেন পরিভাষার অনুবাদে উদ্ভূত প্রায়োগিক সমস্যা লক্ষ্য করি।
পাশ্চাত্যের দার্শনিক প্রচেষ্টা সেই বানরের মত, যার কৌতূহলের শেষ নাই। যাই সামনে পায় একটু ঝাঁকায়ে দেখে, একটু ঘ্রাণ নেয়, একটু চাটে, কামড়ানোর চেষ্টা করে , তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অর্থাৎ ম্যাটেরিয়ালিস্টিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ভাববাদের চর্চাও যে হয় নাই তা না। কিন্তু বঙ্গীয় দর্শনের মূলে দেহসাধনা। দেহাত্মবাদ। দেহের সাথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে অ্যানালজি - তারা সে অনুপাতে নিজের আত্মার ভেতরে খোঁজে পরমাত্মা, সহজ মানুষ, মনের মানুষ। তান্ত্রিক নাথপন্থা - সহজিয়া বৈষ্ণব হয়ে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে যদি বাংলার সূফী মুসলিমদের কাছে আসি, যারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, জিকির করে এবং ছয় লতিফার প্রজ্বলনের অপেক্ষায় থাকে - তারা। এই ছয় লতিফা কিন্তু তান্ত্রিক নাথপন্থী হিন্দুদের ষড়-পদ্মের ধারণা থেকেই উদ্ভূত। যে কুণ্ডলিনীর উদ্ভাসনের অপেক্ষায় থাকে তান্ত্রিক যোগী, মুসলিম ফকির একই জিনিসের অপেক্ষায় থাকে, কেবল তারে উল্লেখ করে নূর হিসেবে। আর লালন বলেন - চাতক থাকে মেঘের আসে/ মেঘ বরিষে সে কোন দেশে / বল চাতক বাঁচে কিসে / ওষ্ঠাগত প্রাণ আকুল/ সমুদ্র কিনারে বসে জল বিনে চাতকি মরল।
বৈদিক ধর্ম যখন সেন আমলে, পালদের অধিকৃত বৃহৎবঙ্গে অনুপ্রবেশ করে, তখনও কিন্তু 'বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ অ্যাজ ইট ওয়াজ' প্রচলন করা সম্ভব হয় নাই। আপসরফা করতে হয়েছে বৌদ্ধধর্মের হীনজানি শাখার সাথে। এর ফলে তন্ত্রজানি বৌদ্ধিক চর্চার শুরু হয়, যার ধর্মীয় গ্রন্থ 'অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা' পাওয়া যায় বাংলা অঞ্চলের আদি চিত্রকলার প্রথম নিদর্শন। নিরাকার, নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধধর্মের ধর্মগ্রন্থে অবতারের ছবি পাওয়ার আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে?
বলতে চাইছি যে - মিলে মিশে কিভাবে বসবাস করতে হয়, বঙ্গের মানুষকে এটা কখনো শেখানো লাগে নাই। কিন্তু এই যে হিন্দু - মুসলমান - বৌদ্ধ - খ্রিস্টান মিলেমিশে থাকতে পারবে না, এই চিন্তার বীজ প্রথমত আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছে "বিটিশ"ব্রিটিশরা। মোঘলদের, মুসলমানদের উপর আজকের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের অনেক ক্ষোভ। ধরেন সঞ্জয় লীলা বানসালির পদ্মাবত মুভিতে আলাউদ্দিন খিলজির যে ইনহিউম্যান বা পশুর মত চিত্রায়ন (ওর তাঁবুতে বসে খাওয়ার দৃশ্যগুলি স্মরণ করেন, বা কুস্তির সিন, বা পুরা মুভিতেই ওর অভিনয়), অথবা মারাঠাদের বীরত্বগাঁথার প্রচার প্রসারে পানিপথ, তানহা জির - মত একটার পর একটা মুভি বানানোর প্রয়াস থেকেই সে ক্ষোভের উদ্গিরন বোঝা যায়। কিন্তু মুঘলদের একটা বিষয় চিন্তা করে দেখেন, তারা কিন্তু এখানে এসে এ অঞ্চলের জনগণের সাথে মিশে গিয়েছিল। বিয়ে করেছিল। সন্তান উৎপাদন করেছিল। ইরান - তুরানে সম্পদ পাচার করে নাই, ঐ মাত্রায়, যে মাত্রায় তাদের পর আসা ব্রিটিশরাজ করেছে। আকবরের দরবারে গুণীজনের কদর ছিল। মারাঠাদের তিনি নিজের ঘনিষ্ঠ অমাত্যের স্থান দিতেন। আওরাঙ্গজেব সে উদারনীতি থেকে সরে আসার ফলে হিন্দু - মুসলিম প্রথমবারের মত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখা শেখে। কিন্তু বিভেদের রাজনীতির সংজ্ঞা আমাদের শিখিয়েছে ব্রিটিশরাজ। ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির জন্ম তাদের হাত ধরে। অবিভক্ত জনগণের আত্মপরিচয় নিয়ে কনফিউশন তৈরি করার প্রয়োজন ছিল তাদের। এনলাইটমেন্টের আলোয় মূর্খ ভারতবাসীদের আলোকিত করবার দায়িত্ব ছিল তাদের। নিজেদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ানোর প্রয়োজন তাদের। তাদের প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টার ভাঁটা পড়েছে ১৯৪৭ এ। কিন্তু এত দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শোষণ করার ফলে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের বীজ আমাদের মাথায় এমনিতেই শেকড় গেড়ে বসেছে। তাই বাংলা ভাষাভাষী বাঙ্গাল পাঠক - লেখকদের অনুরোধ করছি - তাদের ঔপনিবেশিক প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ানোর দায়িত্ব বোকার মত কান্ধে নিয়েন না। পয়সা দিয়ে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ানোর লোক তারা ভাড়া করে রেখেছে তাদের প্রাক্তন কলোনিগুলোর প্রশাসনে , আকাদেমিয়ায়।
বৌদ্ধধর্ম্যালম্বি বন্ধুদের বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভেচ্ছা জানাতে বসেছি আসরের নামাজ পড়ে। এখন কিছুক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত করবো। তারপর, আজান পড়লে ইফতার। একজন আচরি মুসলিম হওয়া সত্যেও গৌতম বুদ্ধের গুরুত্ব স্বীকারে এবং উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক মহান মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে মেনে নিতে আমার কোন সমস্যা হয় না। কারন আমি জানি, মায়ানমারের বিন লাদেন ভিক্ষু গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত বৌদ্ধ না, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চের মসজিদে ঢুকে গুলি করা হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট ক্রাইস্টের মতানুসারি খ্রিস্টান না, ইসলামের নামে বোমা মেরে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যাকারি মুসলমান না।
আলাপের শেষ তাহলে কি দাঁড়ালো?
শেষ দাঁড়ালো এই যে - পাশ্চাত্যে তত্ত্বের পিম্পগিরি বন্ধ করতে হবে। পাশ্চাত্যের প্রযুক্তি, ঔষধ তো ব্যাবহার করা লাগবেই। যে দাঁত ক্যালায়ে বলবে - 'অ্যালায় ক্যালা? আয়ুর্বেদ ইউনানি ঔষধ খাও, ইহুদী নাছারাগো বানানো ট্যাবলেট খাও ক্যান?' তারে বলবেন - দুইশ বছর আমাদের রক্ত চুষে খাওয়ার ফলশ্রুতিতে দাঁড়ানো অর্থনীতি, শিল্পবিপ্লব, আর কলকারখানা থেকে তৈরি ওষুধ আবার আমারেই চড়া দামে বিক্রি করতেছে। হালা বিটিশ আর কারে কয়!' পড়তেও যাবেন পাশ্চাত্যে। মাথা উঁচু করেই। ওরা যদি আপনারে স্কলারশিপ দিয়ে নিয়ে যায় - বুঝতে হবে আপনার ব্রেইন নিংরায়ে ওদের নিজেদের কিছু একটা প্রোজেক্ট হাসিল করার জন্যেই আপনারে স্কলারশিপ দিয়েছে। কাজেই এইটা গিভ অ্যান্ড টেক। আপনিও পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে আবার উপনিবেশবাদের কলার চেপে ধরবেন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:০৭