"সময়টা খুব সম্ভব জুনের শেষ। হঠাৎ করেই তোমার কাছাকাছি যাওয়ার একটা সুযোগ হল। তোমার কাছাকাছি মানে সমুদ্রের কাছাকাছি। সোজা বাংলায় জাহাজের ভিতর। কি যে উদ্বেগ,কি যে উত্তেজনা। আমি কত কি শপিং করলাম। নাইফ থেকে শুরু করে রোপ পর্যন্ত। ছোটবেলায় যত সামুদ্রিক অভিযানের গল্প পড়েছিলাম মনে হচ্ছিল সব আমার সাথে ঘটবে। ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা খুব হাসাহাসি করছিল আমার ছেলেমানুষি দেখে। অন্য সময় হলে খুব মেজাজ খারাপ করতাম ওদের উপহাসে। কিন্তু এবার আমার মেজাজ খারাপের সময় কোথায়? প্রিয় মানুষের সব নাকি প্রিয় লাগে। আমিও নিবিড়ভাবে দেখতে ব্যকুল ছিলাম কি পাও জাহাজের ওই ছোট্ট কেবিনটাতে যা আমার সংসারে নেই। তুলনার এক অদৃশ্য কাটা যা আমাকে রোজ যন্ত্রণা দিত। সব প্রস্তুতি শেষ,এবার যাত্রা। হঠাৎ জানলাম তোমার খাড়ুস ক্যাপ্টেন আমাকে নেবার অনুমতি দেয়নি। কিন্তু তুমি যে আমার তুমি। কিভাবে কিভাবে জানি ম্যানেজ করে ফেললে। অতিরিক্ত উত্তেজনার কারনে আমি একটা মাত্র ড্রেস নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। পতেঙ্গা বিচে যখন গেলাম তখনো সন্ধ্যা নামেনি। পড়ন্ত বিকেল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। উত্তাল সাগর আমাকে তার আসল রূপ দেখিয়ে বরণ করার জন্য তৈরী ছিল। সমুদ্রে তখন তিন নম্বর বিপদ সংকেত। কোন স্পীড বোট যেতে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে পরিচিত একজন পাওয়া গেল,যার একটাই শর্ত বিপদের কোন দায় তার না॥
আমি উঠলাম। যে আমি সাঁতার জানিনা দেখে কখনো পুকুরে নামিনি সেই আমি জীবনে প্রথমবারের মত স্পীড বোটে উঠে বসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম কেন কেউ আসতে চাচ্ছিল না ।ওহ কি বিশাল একেকটা ঢেউ ॥ পাঁচ ছয় ফিট একেকটি ঢেউয়ের তোড় আর চার পাশের বিশাল সমুদ্র আমার ২২ বছরের না দেখা ভুবনটাই অন্য রকম করে দিল। একজন মেরিনারের চোখে এ দৃশ্য অতি তুচ্ছ, কিন্তু আমার মত একটি সাধারণ মেয়ের জন্য এটা অলীক বিস্ময়। আমার ভয় পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল। কে জানে কেন পেলাম না। হয়ত রক্তকণিকা এতক্ষণে বুঝে গেছে আমি একজন মেরিনারের ওয়াইফ। আমাকে ভীত করা সম্ভব নয়। চলতে চলতে দূরের বিন্দু সমান জাহাজ আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হল। জাহাজের কাছাকাছি যেয়ে আমি চিন্তা করতে লাগলাম উপরে কিভাবে উঠবে? উপর থেকে হঠাৎ যা নেমে এল তা হল ক্রেন দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া একটি খাঁচা। এতক্ষণে ভয় পেলাম। মনে হল এখনই টুস করে পানিতে পড়ে যাব। তার উপর যখন দেখলাম তুমি আগে খাঁচার ভিতর ঢুকে গেলে আর আমি বোটেই থেকে গেলাম তখন মনে হল ধরনী দ্বিধা হও। ঢেউয়ের কারনে আমাকে নিয়েই বোট ওয়ালা আরো তিন চার চক্কর দিল ।আমার সমস্ত দোয়ার ভান্ডার শেষ হবার একটু আগে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম জাহাজের ডেকে। আমার স্বভাব সুলভ স্বতঃস্ফূর্ততায় আমি একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড় লাগালাম এবং যথারীতি তোমার কাছে কঠিন একটি ঝাড়ি খেয়ে তোমার কেবিন নামক গর্তে প্রবেশ করলাম। শুরু হল আমার জীবনের সেরা সাতটি দিন ॥