somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আইয়ুবের প্রেতাত্মারাঃ শেষ পর্ব

৩০ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আইয়ুবের সেসময়ে কানাডা, দুবাই, সিঙ্গাপুরে টাকা পাচারের সংস্কৃতি বা সুযোগ সেভাবে তৈরি হয়নি, বেগমপাড়া বলেও কোন কিছুর অস্তিত্ব তখন ছিলোনা। টাকাটা পাচার হতো মূলত এক পাকিস্তান থেকে অন্য পাকিস্তানে— খোলাসা করে বললে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানের সেই ২২ পরিবারের শিল্প উদ্যোগতারা তাদের পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাবসায়িক মুনাফার সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতেন। সে সময়ে পাকিস্তানের যে রপ্তানি আয় হতো তার ৭০% আসতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। মানে বৈদেশিক মুদ্রার যোগানের বৃহৎ অংশটাই আসতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। অথচ সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় বাজেটের মাত্র ৪০% পেত পূর্ব পাকিস্তান, বাকি ৬০% যেত পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে।অথচ জনসংখ্যার বিচারে পূর্ব পাকিস্তান ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে বড়। Great Decade এর সুফল পাওয়া পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় যেভাবে বাড়ছিলো ঠিক একই ভাবে সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু জাতীয় বাজেট বরাদ্দ কমছিল।
পূর্বের টাকা পশ্চিমে পাচার, আর বাজেট বৈষম্যের কারণে দুই পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যাবধান ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। যার পরিণতিতে বাড়তে থাকে জনঅসন্তোষ। সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক রেহমান সোবহান এই বৈষম্যেকে তুলে ধরেছিলেন একাডেমিক ডিসকাশনে। ১৯৬১ সালে তার দেওয়া দুই অর্থনীতির পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ এনালাইসিসই পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসাহিত করেছিলো ৬ দফা প্রণয়নে।
এবার আসা যাক আইয়ুব পতনের ইতিহাসে। একজন শক্তিমান, পাশ্চাত্যের অনুগত এবং উন্নয়নের ম্যাজিক দেখানো স্বৈরশাসকের পতন হলো কিভাবে? কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনঅসন্তোষ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলো?
পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন মূলত প্রসার হতে থাকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে। ১৭ দিনের এ যুদ্ধ ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি eye opening ঘটনা। পূর্ব পাকিস্তানকে একরকম অনিরাপদ রেখে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সামরিক রসদ থেকে শুরু করে সৈন্য বাহিনী। ভারতবেষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার পতি পাঞ্জাবিদের এ উদাসীনতা ভাবিয়েছিলো সাধারণ জনগণকে। শেখ মুজিবুর রহমানও এই নিরাপত্তাহীনতার কথা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই অর্থনৈতিক স্বাধিকারের পাশাপাশি ৬ দফায় যুক্ত করেছিলেন পৃথক প্যারামিলিটারির দাবি। তবে আইয়ুব সরকার এ ৬ দফাকে না মেনে বরং ৬ দফার প্রচারকদের বিরুদ্ধে দমনমূলক আচরণ শুরু করে দিলেন। পাবলিক সেফটি এক্ট নামক একটি নিপীড়নমূলক আইন দিয়ে গ্রেফতার করলেন ৬ দফার প্রপাগেটর শেখ মুজিব সহ অন্যান্যদের। আইয়ুব খানের এ ৬ দফা বিরোধী অবস্থানই মূলত তৈরি করেছিল তার পতনের ক্ষেত্র।
১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সবকিছুই মোটামুটি আইয়ুব খানের মন মতো চলছিলো, তবে ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি থেকে পরিস্থিতি ক্রমশ আইয়ুব খানের নাগালের বাইরে চলে যেতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুবের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো গঠন করে বসেন আইয়ুব বিরোধী দল পি.পি.পি আর এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হতে থাকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদসহ একাধিক আন্ডারগ্রাউন্ড দল।এরমধ্যে সবথেকে বিপদজ্জনক দলটি তৈরি হয় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্য থেকেই। বাঙ্গালি নৌকমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু বাঙ্গালি সদস্য যুক্ত হন আন্ডারগ্রাউন্ড এক্টিভিটিজে। এই গুপ্তদল ত্রিপুরার আগরতলাতে মিলিত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার মিশনে ভারতীয় সহায়তা চেয়ে বসে। এদিকে পূর্ব-পশ্চিম দু’ পাকিস্তানেই গঠিত হয় আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক মোর্চা। নিমিষেই টালমাটাল হয়ে যায় আইয়ুবের রাজত্ব।
বেসামাল আইয়ুব প্রশাসন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে একটি রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করতে থাকে একের পর এক পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও তার সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে পাক-ভারত যুদ্ধের ইস্যুতে।
আইয়ুব খানের একটি পেটোয়া ছাত্র বাহিনী ছিলো, যার নাম ছিলো এনএসএফ। যাদের কাজ ছিলো সরারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোকে দমিয়ে রাখা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্যাডার রাজনীতি মূলত এই সংগঠনের মাধ্যমেই শুরু। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরোধী এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করার কাজই ছিলো ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) নামে এ ছাত্রসংগঠনটির। ‘শয়তানের থেকেও ভয়ঙ্ককর’ এ সগঠনের পাশাপাশি ছিলো পেটোয়া পুলিশ বাহিনী, যাদের কাজ ছিলো আইয়ুবকে টিকিয়ে রাখার জন্য জানপ্রাণ চেষ্টা করা। এদের গুলিতেই সেসময় নিহত হয়েছিলেন আসাদ, মতিয়ুরসহ আরও অনেকে।
কিন্তু এত দমন নিপীড়ন করেও আইয়ুবের শেষ রক্ষা হয়নি। সমান্তরালভাবে চলতে থাকা রাজনৈতিক আন্দোলন আর ছাত্র আন্দোলন এক হয়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। আর তাতেই নিশ্চিত হয়ে যায় আইয়ুবের পতন।
তো উপনিবেশোত্তর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম স্বৈরশাসকের পতনের পিছনের মূল কারিগর ছিলেন কারা? কিংবা এই পতন থেকেই বা আমরা কি শিক্ষা নিতে পারি? মূলত ৩টি পক্ষের ঐক্যবদ্ধ অন্দোলনের কারণেই পট হয়েছিলো আইয়ুব খানের— ১) আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক দল, ২)ছাত্র সগঠন এবং ৩) বুদ্ধিজীবী সমাজ। এই ৩ পক্ষের সমন্বয়ে যে নেক্সাস তৈরি হয়েছিলো তা মোকাবিলা করার মতো শক্তি ছিলোনা আইয়ুব খানের।
এ ঘটনা যে শুধু আইয়ুব খানের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যখনই এ অঞ্চলে কোন গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সে অভ্যুত্থানের সফলতার পিছনে কাজ করেছিলো এ ত্রিপক্ষীয় শক্তি। ১৯৫২ সালে থেকে শুরু করে, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর ৯০এর গনঅভ্যুত্থান পর্যন্ত এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কোন নজির এদেশে নেই। বরং রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যখন ছাত্র এবং সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন যুক্ত হয়, তখনই হয় পরিবর্তন। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা থেকে দুই-অর্থনীতির যে ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন রেহমান সোবহানরা সেই ধারণাকেই স্থান দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান তার ৬ দফায়। ৬ দফার সেই আন্দোলনই পরবর্তীতে রূপ নিয়েছিলো ছাত্রদের ১১ দফার আন্দোলনে। ১১ দফার পাশাপাশি বাংলা নববর্ষ এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত ইস্যুতে তৈরি হওয়া সাংস্কৃতিক আন্দোলন — ত্রিপক্ষীয় শক্তির এই আক্রমণকে রুখতে পারেনি আইয়ুব খানের ক্যাডার বা পুলিশ বাহিনী। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পরে একজন স্বৈরশাসকের তৈরি রাজত্ব।
ছবির উদ্ধত বালকের মতো লাখো জনতার ক্রোধে ইতিহাসে বিলীন হয়ে যান এককালের স্বৈরশাসক- আইয়ুব খান।

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ১২:২৯
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শেখ হাসিনার শেষের ঘন্টা ও কিছু কথা!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৩২

এই বৃষ্টি ভেজা রাতে আজ অনেক ঘটনাই মনে পড়ছে, কোনটা রেখে কোনটা লিখি তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে! তবে প্রথম যে ঘটনা লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে তা হচ্ছে শেখ হাসিনার পলায়নের শেষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি নিষিদ্ধ

লিখেছেন আজব লিংকন, ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৪১

আমি নিষিদ্ধ! হইলেও হইতে পারি!
শুনছি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের বেশি আকর্ষণ। দূর থেইক্কা আপনি আমারে দেখেন। টুকটাক আমার লেখালেখি পড়েন। কই কখনো তো আপনারে লাইক কমেন্ট কিংবা খোঁচা মারতে দেখলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি।। আমি পদত্যাগ করিনি , ডাইনী করেছে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪০

জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানা আপু

লিখেছেন সোহেল ওয়াদুদ, ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৩

শুভ জন্মদিন আপু! আপনার জন্মদিনে সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন কামনা করছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনি এবং দুলাভাই অনেক প্রজ্ঞাবান মানুষ। দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পদ ত্যাগ না করলেও ছেড়ে যাওয়া পদ কি শেখ হাসিনা আবার গ্রহণ করতে পারবেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৯



তিনি ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে পদ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে গেছেন। পদের লোভে তিনি আবার ফিরে এসে ছাত্র-জনতার হাতে ধরাখেলে তিনি প্রাণটাই হারাতে পারেন। ছাত্র-জনতার হাত থেকে রক্ষা পেলেও তাঁর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×