ব্যভিচার কি ? ব্যভিচার বা পরকীয়া হলো যার সাথে বিয়ে হয়নি তার সাথে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক। পশ্চিমের আইনে নর-নারী রাজি থাকলে পরকীয়া অপরাধ নয়, তাই সেখানে আজকাল পরকীয়া খুব বেড়ে গেছে। এর ফলে পশ্চিমে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হবার পথে। কোরাণে ব্যভিচারকে বর্জন করার সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে (সুরা বনি ইসরাইল ৩২, মুমতাহানা ১২, ইত্যাদি)।- ব্যভিচারিণীদের শাস্তি হিসেবে বলা আছে আজীবন ঘরে বন্দি রাখতে অথবা আলাহ অন্য কোন পথ নির্দেশ না করা পর্যন্ত − সুরা নিসা, আয়াত ১৫।- আর আছে ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে একশ’ করে চাবুক মারতে − সুরা নূর, আয়াত ২।- অথচ শারিয়া আইনে আছে বিবাহিত বা বিবাহিতা অপরাধীর শাস্তি জনগণের সামনে পাথরের আঘাতে মৃত্যুদণ্ড, যাকে রজম বলা হয়। আর যার বিয়ে হয়নি তাকে একশ’ চাবুক − (সূত্র : হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৭৮, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড, ধারা ১২৯, পাকিস্তানের হুদুদ আইন ৭-১৯৭৯, অর্ডিন্যান্স ২০-১৯৮০ দ্বারা পরিবর্তিত, আইন নম্বর ৫ (২)-এর “অ” ইত্যাদি). অর্থাৎ এ-আইন কোরাণকে লঙ্ঘন করেছে।
অনেকে এ-আইনের সমর্থনে হাদিস পেশ করেন মিশকাত (২৬ অধ্যায়ের ১ম পরিচ্ছেদ) আর সহি বোখারী থেকে (হাফেজ মহাম্মদ আবদুল জলিল সম্পাদিত বাংলায় বোখারি শরীফের মোটামুটি হাদিস নম্বর ১২৩৪ থেকে ১২৪৯ পর্যন্ত, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন খানের অনুবাদ ও মওলানা আজিজুল হক সাহেবের অনুবাদ ২৬৮ নম্বর হাদিস)। –সব হাদিসে বলা আছে, নবীজী বিবাহিত/তা-দের মৃত্যুদণ্ড, আর অবিবাহিত/তা-দের একশ’ চাবুক ও এক বছরের নির্বাসন দিয়েছিলেন।
তাহলে আমরা দেখছি, কোরাণের আয়াতের সাথে হাদিসগুলো মিলছে না। কেন এমন হচ্ছে ? তাহলে নবীজী কি সুরা নূর নাজিল হবার আগে পরকীয়ায় বিবাহিত/তা-দের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ? এ-প্রশেড়বর জবাব আছে ১২৪২ নম্বর হাদিসে, সাহাবী বলেছেন তিনি তা জানেন না। আমরা ধরে নিতে পারি যে নবীজী রজম করে থাকলে এ-সব আয়াত নাজিল হবার আগেই করেছিলেন, পরে নয়। কেননা পরে করলে তা কোরাণের বিপক্ষে যেত, সেটা সম্ভব নয়।
এবারে একটা বিখ্যাত হাদিস দেখা যাক। সহি বোখারি হাদিস ১২৩৭, ১২৩৮, ১২৩৯, এবং মিশকাত ২৬-এর ১ (“মুসলিম জুরিসপ্র“ডেন্স অ্যাণ্ড দ্য কোরাণিক ল’ অফ μμাইম্স্” থেকে) হাদিস থেকে আমরা দেখি :
মায়াজ নামের সাহাবি নবীজীকে বলল তাকে পবিত্র করতে।
নবীজী তাকে হাঁকিয়ে দিলেন এই বলে − দূর হও, অনুতাপ কর ও ক্ষমা চাও।
মায়াজ ফিরে গিয়ে আবার ফিরে এসে একই কথা বলল। নবীজী একই কথা বললেন।
তিনবার এটা ঘটার পর নবীজী জিজ্ঞেস করলেন − ব্যাপার কি। মায়াজ বলল সে
ব্যভিচার করেছে।
তারপর নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, মায়াজ কি পাগল ? নেশা করেছে ? লোকেরা বলল, না।
নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন − মায়াজ কি বিবাহিত ? লোকেরা বলল, হ্যাঁ।
তখন নবীজী তাকে পাথর মেরে হত্যা করতে নির্দেশ দিলেন।
এ-হাদিস সত্যি হলে নবীজী অন্তত তিনবার তাকে অনুতাপ-ক্ষমার দিকে ঠেলেছেন, শাস্তি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন, শেষে একান্ত বাধ্য হয়েই রজম ঘোষণা করেছেন। শারিয়ার আইনে এই সুনড়বত মেনে কোন ‘অপরাধী’-কে তিনবার ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ম নেই। পাগলামি বা নেশার কথা জিজ্ঞেস করাও নেই। আমরা জানি মানুষ ভ্রান্তিময়, অপরাধ এক হলেও সব অপরাধী এক হয় না। একই অপরাধ কেউ করে অভাবে, কেউ করে স্বভাবে, খাসলতে। একই অপরাধ কেউ করে উত্তেজনার গরম মাথায়, কেউ করে পরিকল্পনা করে ঠাণ্ডা মাথায়। সে-জন্যই একই অপরাধের সর্বদা একই শাস্তি হতে পারে না। অথচ শারিয়ার হুদুদে ঠিক তাই’ই হয়, হঠাৎ-অপরাধ ও খাসলতের অপরাধে বিচারককে একই শাস্তি দিতে হয়, তাঁর হাত-পা বাঁধা থাকে।
লোকেরা মায়াজকে পাথর মারা শুরু করতেই ব্যথার চোটে হতভাগার মনে হল যে পবিত্র হয়ে এখনই পটল তোলার চেয়ে তওবা টওবা করে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। লেজ তুলে সে দিল দৌড়। কিন্তু লোকেরা ওকে ধরে মেরে ফেলল। এঘটনা শুনে নবীজী কি বললেন ? কি করলেন ? মৃদুকণ্ঠে উচ্চারিত হল তাঁর লিখিত আইন ভাঙ্গা অলিখিত আইন − “লোকটাকে তোমরা যেতে দিলে না কেন ?” − মিশকাত ২৬-এর ১, সহি ইবনে মাজাহ ৪র্থ খণ্ড হাদিস ২৫৫৪ ও সহি সুনান আবু দাউদ হাদিস ৪৪০৫ ও ৪৪০৬ . এই হলেন রহমতুলিল আল্ আমিন, এই হল ভ্রান্তিময় অনুতপ্ত মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ দরদ, অসীম ক্ষমা। তাঁ র গভীর অন্তদৃর্ িষ্ট শুধ ু শাস্তির দিকেই নয়, ক্ষমার দিকেও। স্বভাব-অপরাধীর খাসলত আর ভালো মানুষের হঠাৎ পা পিছলে যাবার মধ্যেকার বিরাট ফারাকটা জানেন বিশ্বনবী।
আবার কোরাণে ফিরে আসি। সুরা নিসা, আয়াত ১৬ : “তোমাদের মধ্য হইতে যেই দুইজন সেই কুকর্মে লিপ্ত হয়, তাহাদিগকে শাস্তি প্রদান কর। অতঃপর যদি উভয়ে তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে, তবে তাহাদের হইতে হাত গুটাইয়া নাও।”
কোথায় পাথর, কোথায় মৃত্যুদণ্ড ? মেরে ফেলার পর তার লাশ কি তওবা করবে নাকি, নিজেকে সংশোধন করবে নাকি ? এর চেয়েও কঠিন প্রমাণ আছে কোরাণে : সুরা নিসা, আয়াত ২৫ − দাসী-স্ত্রী পরকীয়া করলে তাকে “স্বাধীন-নারীদের অর্ধেক শাস্তি” দিতে হবে। এ-আয়াতের ব্যাখ্যায় শারিয়াপন্থীরা বলেন স্বাধীন নারী মানে স্ত্রী নয়, অন্য অবিবাহিতা নারী যাকে একশ’ চাবুক মারার বিধান আছে। কিন্তু চাবুক মারার আয়াত আছে তো সব ব্যভিচারীর বেলায়। আয়াতটা পড়ে দেখুন, স্পষ্ট বোঝা যায় দাসী নয় এমন নারীকে বিয়ে করা স্ত্রীর কথাই বলা হচ্ছে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে দাসী-স্ত্রীর কি শাস্তি হবে ? মৃত্যুদণ্ডের তো অর্ধেক হয় না।
আসলে পরকীয়ার মৃত্যুদণ্ডের বিধান এসেছে ইহুদী-কেতাব ডিউটেরোনমি থেকে। “যদি কাহাকে অন্য লোকের স্ত্রীর সহিত বিছানায় দেখা যায় তবে তাহাদিগকে মরিতে হইবে … তখন তোমরা উহাদিগকে নগরের ফটকে লইয়া আসিবে এবং পাথর দ্বারা আঘাত করিবে যাহাতে তাহারা মরিয়া যায় …।”
শারিয়ার পক্ষে হজরত ওমরের নামে বিখ্যাত এক হাদিস আছে, সহি মুসলিম ২য় খণ্ডের ৬৫ পৃষ্ঠাতে (মুহিউদ্দীন খানের বাংলা-কোরাণ, পৃষ্ঠা ৯২৬) আর সহি বোখারী ১২৪৩ ও ১২৪৯ (হাফেজ আবদুল জলিল), বোখারী ৮ম খণ্ড হাদিস ৮১৭ (ডঃ মুহসিন খান, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ইবনে হিশাম/ইশাক -৬৮৪ পৃষ্ঠায় : “আলাহতালা যাহা নাজেল করিয়াছেন তাহার মধ্যে রজমের আয়াতও রহিয়াছে … রসুলুলাহ (দঃ) রজম করিয়াছেন তাই আমরাও তাঁহার পরে রজম করিয়াছি … রজমের আয়াত পাঠ মনসুখ (বাতিল) হইয়া গিয়াছে কিন্তু হুকুম ও বিধান চালু রহিয়াছে।” কিন্তু সেই বাতিল আয়াতটা কি ? কোথায় সেটা উধাও হল ? আয়াতটা হল -“কোন বয়স্ক নর ও নারী ব্যভিচার করিলে তাহাদিগকে পাথর মারিয়া হত্যা কর” − সহি ইবনে মাজাহ্ ৪র্থ খণ্ড হাদিস নং ২৫৫৩। কিন্তু এর মধ্যে ফাঁক আছে। কারণ আইন বাতিল হলে তার শাস্তি চালু থাকতে পারে না। আয়াতটা কোথায় উধাও হল তা লেখা আছে ইমাম হাম্বলের দলিলে আর সহি ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড হাদিস নং ১৯৪৪-এ। এ-এক মারাত্মক হাদিস, দেখুন − “বর্ণিত আছে যে বিবি আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন, “রজমের আয়াত নাজিল হইয়াছিল। অবশ্যই ইহা একটি কাগজের উপরে লিখা হইয়াছিল যাহা আমার কুশনের নীচে রাখা ছিল। রসুল (দঃ)-এর ইন্তেকালের পর আমরা যখন তাঁহার সৎকার করিতে ব্যস্ত ছিলাম তখন একটি গৃহপালিত ছাগল ঘরে ঢুকিয়া উহা খাইয়া ফেলে।” এর ফটোকপি দেয়া হলো।
বিশ্ব-মুসলিমের জন্য এ-এক মারাত্মক হাদিস। কারণ সুরা হিজ্র্, আয়াত ৯-এ আলাহ সুস্পষ্ট বলেছেন − “আমিই এই উপদেশগ্রন্থ নাজিল করিয়াছি এবং আমিই উহা সংরক্ষণ করিব।” আলাহ পাক-এর কালাম ছাগলে খাওয়া ছাড়াও এ হাদিস আরও এক ভয়াবহ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তা হলো, নাজিল হওয়া আয়াত কোরাণে নেই। অন্যান্য আয়াত বাতিলের হাদিসও আছে, বুখারী ৪র্থ খণ্ড ৬৯. কিন্তু কে কবে কোথায় আলাহর কালাম বাতিল করল কেন ও কোন্ অধিকারে করল তার দলিল পাওয়া যায়নি।
এবারে কোরাণ থেকে শেষ প্রমাণ। সুরা আন-নূর, আয়াত ২৬ ও ৩ : “দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য ও দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য … ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী নারী বা মুশরিকা নারীকেই বিবাহ করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী বা মুশরিক পুরুষই বিবাহ করে।”
অর্থাৎ ব্যভিচারী পুরুষ-নারীকে মৃত্যুদণ্ড দিলে তাদের লাশের সাথে লাশের বিয়ে দিতে হয়। সেটা সম্ভব নয়। কোরাণ একেবারে নীরব হলেও নাহয় কথা ছিল, যে কোন আইন বানাবার সুযোগ ছিল। কিন্তু কোরাণে তো ব্যভিচারীদের বিয়ের কথা বলা আছে। আরও একটা অকাট্য প্রমাণ দেখুন। সারা জীবন এত কষ্ট করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার পর মুসলমানের প্রতি স্বয়ং নবীজীর সর্বশেষ নির্দেশ কত গুরুত্বপূর্ণ ! সেই বিদায় হজ্ব-এর ভাষণে তিনি বলেছেন, “স্ত্রী অশীল কর্মে অর্থাৎ জ্বেনায় লিপ্ত হইলেই কেবল তাহাকে হালকা মারধর করা যাইবে, মারাত্মকভাবে নয়” − বিধিবদ্ধ ইসলামি আইনের ৩য় খণ্ড ৮৫২ পৃষ্ঠা। না, ব্যাভিচারিণীর মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেননি আলার রসুল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর নির্দেশ উপেক্ষা করে, কোরাণের নির্দেশ উপেক্ষা করে শারিয়ায় অনেক আইনের মত এ আইনও ঢোকানো হয়েছে।
পরকীয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শারিয়া আইনে যে মৃত্যুদণ্ড আছে তা কোরাণের খেলাফ ॥
লেখক পরিচিতি
হাসান মাহমুদ
hasan@hasanmahmud.com
http://www.hasanmahmud.com/
In SHARIAKIBOLE.COM it is written as:-
সদস্য – ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস উপদেষ্টা বোর্ড
সাধারণ সম্পাদক- মুসলিমস ফেসিং টুমরো- ক্যানাডা
রিসার্চ এসোসিয়েট- দ্বীন রিসার্চ সেন্টার, – হল্যান্ড
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশীপ কোয়ালিশন
ক্যানাডা প্রতিনিধি, ফ্রি মুসলিমস কোয়ালিশন
প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল’ ও প্রেসিডেন্ট, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:০৩