লেখাটি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়েছে
গ্রহ নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান বিচার করে পৃথিবীর উপর তাদের প্রভাব হিসাব করাই জ্যোতিষশাস্ত্র। জাতকের জন্ম সময়ের উপর ভিত্তি করে জ্যোতিষ একটি ভাগ্যচক্র বা কুষ্ঠি তৈরী করেন। এই বিদ্যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পশ্চিমা মতে ১২ টি রাশি নিয়ে রাশিচক্র গঠিত। চীনা মতে ৬০ বছরের চক্রাবর্তে চন্দ্রবৎসর মেনে রাশিচক্র হিসাব করা হয়।
ব্যবিলনে শুবু হয়ে দ্রুত এই বিদ্যা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভূমধ্যসাগরে। তারপর গ্রীক ও.রোমানদের মধ্যে এটা অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ভারত, মিসর এবং আসিরীয় অঞ্চলেও এর প্রসার ঘটে। মধ্যযুগে ইউরোপে রাজপরিবারগুলিতে নিজস্ব জ্যোতিষ রাখা হতো এবং তাদের উপর এর বিরাট প্রভাব ছিল। এলিজাবেথান ও জ্যাকোবিয়ান সাহিত্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
চীন ও ভারতে বিশ্বাস করা হয় যে গোটা সৃষ্ট জগত একে অন্যের সংগে একটি ছকের মধ্যে চলছে এবং এই ছকের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্যই জ্যোতিষচর্চা আবশ্যক।
আমেরিকাতে সব সংবাদপত্রে প্রতিদিন হরোস্কোপ ছাপা হয় এবং সবাই বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, নিজের রাশির নাম জানে। মধ্যযুগে অনেক জ্যোতিষী নানা রকম সুবিধা ভোগ করতেন কারন সবাই বিশ্বাস করতো যে তারা ভবিষ্যত জানেন।
হিন্দুরা বিবাহের আগে পাত্র পাত্রীর কুষ্ঠি বিচার অবশ্যই করিয়ে থাকেন। পুণর্জন্মে তারা বিশ্বাস করেন তাই তারা মনে করেন জন্মের সময় গ্রহ বিচার অতীত জীবনের কর্মফল জানতেও সাহায্য করে।
মনে করা হয় যে সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্রের এক ধরনের স্বগীয় প্রভাব আছে মানুষের উপর। ্এদের সঠিক অবস্থান নির্নয়ের মাধ্যমে স্বর্গীয় ইচ্ছা জানা সম্ভব। ধীরে ধীরে এদের আপেক্ষিক অবস্থান নিয়ে চর্চা শুরু হয় এবং মানুষের মনের উপর গ্রহের প্রভাব, বিভিন্ন রাশিতে গ্রহের অবস্থান এসবও গুরুত্ত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে শুরু করে। এছাড়াও যদি কোন গ্রহের বিশেষ কোন অবস্থানে কোন বিশেষ ঘটনা ঘটে তবে মনে করা হয় ঐ একই অবস্থানে গ্রহটি আবার আসলে সেই একই ধরনের ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটতে পারে। মানুষের স্বাস্থ্যের উপর গ্রহের অবস্থানভিত্তিক প্রভাব নিয়ে প্রচুর বিতর্ক থাকলেও অনেকেই এতে বিশ্বাস করেন। উদাহরন স্বরুপ বলা যায় যে মেষ রাশির প্রভাব আছে, মাথা, মগজ এবং চোখের উপর। ফলে মেষ রাশির জাতকের মাথার রোগ বা আঘাতের সম্ভাবনা বেশী থাকে। নাকের উপর প্রভাব বৃশ্চিক রাশির তাই তাদের বেলায় সাইনাসাইটিস হবার সম্ভাবনা বেশী। আমি নিজে একদম এতে বিশ্বাস না করলেও মেডিক্যাল অ্যাস্ট্রোলজি নামে একটি শাখা এসব নিয়ে কাজ করে আজকাল। রোগীকে মানসিক জোর দিতে এসব বেশ উপকারী। ক্রনিক রোগে শণির প্রভাব এবং হঠাৎ অসুখে মঙ্গলের প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়।
আমি নিজে অ্যাস্ট্রোলজিতে বিশ্বাস করি না। এর পিছনে আমার নিজস্ব যুক্তি আছে কিছু। প্রথমত বিপদ নিয়ে ভবিষ্যদ্বানী করলে সেটা সবসময় গণকের পক্ষে যায়। কারন বিপদটা হলে সে মহাগনক হিসাবে সুনাম পেল। আর না হলে সে যে রতœ পাথর বা নিয়ম বাতলে দিয়েছিল বিপদ কাটাতে সেটার কার্যকারীতা প্রমানিত হলো।
চন্দ্র আর সূর্য যদি এতো প্রভাব ফেলে তাহলে অন্যান্য গ্রহের যে উপগ্রহগুলো আছে তাদেরও প্রভাব থাকা উচিত। তাহলে আকাশ জুড়ে আমরা যে হাজার খানেক কৃত্রিম উপগ্রহ ছেড়েছি তারও প্রভাব আমাদের উপর পড়া উচিত। জন্মের সময় শণি আর মঙ্গল এর বরাবর যদি কোন স্যাটেলাইট থাকে তবে কি শনির প্রভাব কিছুটা বাধা পাবার কথা নয়?
তারপর বছরের শুরুতে পৃথিবী সংক্রান্ত যেসব ভবিষ্যদ্বানী করা হয় তার সবগুলোই থাকে সাধারন। ২০০৬ সালের শেষে কোন গনক বলেননি,শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার কারাবরনের সম্ভাবনার কথা। আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা বা ক্যু বিষয়ক সঠিক ভবিষ্যদ্বানীর সংখ্যা হাতে গোনা। একথা শোনার সাথে সাথে জন এফ কেনেডি ও তার ব্যাপারে জিন ডিক্সনের ভবিষ্যদ্বানী সফল হবার কথা বলে অনেকে বলবার চেষ্টা করেন যে গনকরা ভবিষ্যত বলতে পারেন। তাহলে জিন ডিক্সন সম্পর্কে একটু বলা যাক। বিখ্যাত এই তথাকথিত সাইকিক ১৯৯৭ সালে পরলোকে গেছেন, নিজের মৃত্যুর সন তারিখ ঘোষনা না করেই। তিনি ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে জন এফ কেনেডি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আততায়ীর হাতে নিহত হবেন। তার বলা কথাটি ছিল এরকম যে ১৯৬০ সালে নির্বাচিত একজন নীলচোখ ও বাদামী চুলের ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট দায়িত্বপালনরত অবস্থায় মারা যাবেন। আততায়ীর কথা তিনি বলেন নি। পরে তিনি দাবী করেন তিনি আততায়ীর কথা বলেছিলেন।
ডিক্সন পরে রোনাল্ড রিগ্যান এর স্ত্রী ন্যান্সি রিগ্যান এর ব্যক্তিগত অ্যাস্ট্রোলজার ছিলেন। ন্যান্সি গণকদের সাথে কথা বলে রিগ্যান এর কর্মতালিকা তৈরী করতেন বলে অভিযোগ আছে। পরে ন্যান্সি জিন ডিক্সনের উপর আস্থা হারিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জন কুইলিকে অ্যাস্ট্রোলজার হিসেবে বেছে নেন। ডিক্সন ৭ টা বই লিখেছিলেন। তিনি কুকুরের ভাগ্য গণণা এবং গ্রহ বিচার করে রান্নাবান্না করার উপরও বই লিখেছিলেন। তিনি নিজেকে অতিলৌকিক ক্ষমতা বা ই এস পি (একসট্রা সেন্সরী পারসেপশন) এর অধিকারী বলে দাবী করতেন। কেনেডী মারা যাবার পর রাতারাতি সেলেব্রিটি হয়ে যাওয়া ডিক্সন খবরের কাগজে সিন্ডিকেটেড হরস্কোপ ছাপতে শুরু করেন ও অনেক টাকার মালিক বনে যান। রুথ মন্টগোমারী বলে এক কলামিস্ট তাকে নিয়ে একটা বই লেখেন যা তাকে আরো জনপ্রিয় করে দেয়।
আসলে কেনেডি ছাড়া আরো অনেক ভবিষ্যদ্বানী ডিক্সন করেছিলেন যা হাস্যকরভাবে ভুল প্রমানিত হয়। যেমন ১৯৫৮ সালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে চায়নার সাথে বনিবনা না হওয়ায় , রাশিয়ানরা প্রথম চাঁদে মানুষ পাঠাবে, ওয়াল্টার রুদার নামে এক শ্রমিক নেতা ১৯৬৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন। জন অ্যালেন পলোস নামে একজন গনিতবিদ একে নাম দিয়েছিলেন জিন ডিক্সন এফেক্ট এবং দেখিয়েছিলেন একটা ভবিষ্যদ্বানী সফল হলে কিভাবে জ্যোতিষরা এর সুযোগ নেয় এবং পরে তার ১০০ টা বানী ভূল হলেও নাম করে যায়।
তারপর জ্যোতিষরা আপনাকে বিবাহ, ব্যবসা, পড়ালেখা, স্মৃতিশক্তি বাড়ানো, রাগ কমানো, রতিশক্তি বৃদ্ধিসহ নানা রকম উপদেশ ও রতœপাথর দিয়ে থাকেন। এগুলো যদি কাজ করত তাহলে পৃথিবীতে কোন জ্যোতিষ এর নিজেদের বিবাহ বিচ্ছেদ হতো না, তাদের সন্তানেরা সব বোর্ডের পরীক্ষায় সেরা স্থান লাভ করত, তাদের রাগ, হিংসা কিছুই থাকত না এবং সকলেই প্রভূত ধনসম্পদের মালিক হতেন। এমনটি আমরা কমই দেখি। যদি সত্যি সত্যি গ্রহবিচার করে কিছু বলা যায় তাহলে তাদের সকলের গণণার ফল একই আসত। অংক ঠিক হলে অংকের ফল সবারইতো একই আসবার কথা। এটাও আমরা দেখি যে তারা একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়ে থাকেন। যেমন প্রাচীনকালে যুদ্ধের সময় দুপক্ষের রাজাকেই তাদের জ্যেতিষী জয়ের নিশ্চয়তা দিতেন। শেষমেষ জিতত কিন্তু একদিক।
প্রকৃতপক্ষে প্রেডিক্শন বুদ্ধিমান মানুষদের একটি সাধারন জ্ঞান নির্ভর খেলা। যেমন অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে, ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস করে মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি বা দারিদ্রমোচন নিয়ে আগাম কথা বলেন তেমনি একজন মোটা মানুষকে তার হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসের আগাম বার্তা দেয়া আমার পক্ষেও সম্ভব। মোটা মানুষের হাটুর ব্যাথা অতি পরিচিত রোগ। ফলে তাকে বলা সম্ভব - ‘হাঁটুর ব্যাথার কি অবস্থা’? একটি কৃশকায় মানুষকে বলা সম্ভব - ‘কি ভাই পেটের সমস্যা কতদিনের’?
আমি যেমন বলতে পারি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আরো ভালো খেলবে এবং ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো হবে। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আরেকটি আন্তর্জাতিক সম্মান পেতে পারেন। ড. ইউনুস আবার রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হবেন। তারেক রহমানের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। সাপ্তাহিকের সার্কুলেশন আগামী বছর বাড়বে। সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার বিদেশ ভ্রমনের সম্ভাবনা প্রবল। সহকারী সম্পাদক জব্বার হোসেন আগামী বছর বিয়ে করতে পারেন। প্রকাশক আমীরুল ইসলাম একাধিক পুরষ্কার পাবেন বলে মনে হচ্ছে।
যদি উপরের একটাও না ফলে তাহলে বিফলে মূল্য ফেরত। কিসের মূল্য ফেরত? গাপ্তাহিকের এই সংখ্যাটির। এটা পুরোপরি বিফল হবে ২০১০ এর আগমনে। কেননা তখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে যে আমার একটি ভবিষ্যদ্বানীও সফল হয়নি। কিন্তু ২০১০ এই সংখ্যাটির কার্যকারীতা শেষ কারন তখন সাপ্তাহিক এর নতুন আরেকটি রাশিচক্রের সংখ্যা আপনার হাতে। যেহেতু এই সংখ্যাটির তখন কোন বাজার মূল্য থাকবে না, ফলে আমাকে বা সাপ্তাহিকের সাথে জড়িত কাউকে কোন টাকা ফেরত দিতে হবে না।
হাসবেন না। যদি আমার ভবিষ্যদ্বানী সফল না হয় তাহলে এটা নিছকই রম্য রচনা। আর সফল হলে জ্যোতিষবাবা আব্দুন নূর তুষারের অবস্থা ভাবুন একবার।