ঘটনা ১:
উর্মি তাঁর বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে স্কুলের কাছেই অপেক্ষা করে। কেননা বাসায় যেতে আসতে এই জ্যামের শহরে যে সময় লেগে যাবে তাতে স্কুলের কাছাকাছি হাঁটা, বসে অপেক্ষা করাই তাঁর কাছে শ্রেয় মনে হয়। কিন্তু মুশকিল হলো তাঁর কিছুক্ষণ পরপরই ব্লাডারের চাপে টয়লেটে যেতে হয়। সোজা বাংলায় হলো প্রস্রাবের বেগ সামলানো তাঁর কাছে বেশ কষ্টকর হয়ে যায়। তাই আশে পাশে টয়লেটের খোঁজ রাখা তাঁর জন্যে অতীব জরুরী। তখনও ধানমন্ডি লেকের ধারে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হয় নি। সেই কষ্ট সামলাতে সামলাতে বাচ্চা ততদিনে কিছুটা বড় হয়ে গেছে। স্কুল বদলে অন্য স্কুলে চলে গেছে। পরের ঘটনা অজনা।
ঘটনা ২:
চৈতির বাচ্চা ধানমন্ডি এলাকার এক স্কুলে পড়ে। অনেকটা সময় বাচ্চার জন্যে অপেক্ষা করতে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে টয়লেটে যেতে হয়। প্রথমদিকে অত্র এলাকায় পাবলিক টয়লেট না থাকায় আশে পাশের শপিং মলগুলোতে যেতে হতো উইন্ডো শপিং-এ পাশাপাশি সেইসব শপিংমলগুলোর ওয়াশরুম ব্যবহারের সুযোগটা চৈতি হাত ছাড়া করতো না।
পরবর্তীতে নিজে যখন ধানমন্ডি এলাকার পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতো তখন ঢোকার সময় দেখতে পেতো পুরুষকুলের কেউ কেউ লেকের পাড়েই মুত্র বিসর্জনের কাজটি সেরে নিচ্ছে।
ঘটনা ৩:
সায়েন্স ল্যাবরেটরির ওভারব্রিজ পার হতে গিয়ে আমি নিজেই একেবারে কাচা মলের উপর পা দিয়ে ফেলেছিলাম। রীতিমতো লাফ দিয়ে সেখান থেকে রক্ষা পেলেও সিড়ির মুখে আরেক দফায় কাচা মলের সাক্ষাত মোটেই সুখকর অনুভূতি ছিল না।
সাইন্সল্যাব মোড়ের ওভার ব্রিজের উপর
সাইন্স ল্যাব ওভার ব্রিজের সিড়ির সামনে
ঘটনা ৩.১:
৩.১ একারণেই যে একই স্থানের ঘটনা এটা। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা দিয়ে যারা যাতায়াত করেন তারা নিশ্চয়ই ওভার ব্রিজের নিচে দূর্গন্ধযুক্ত তরলের সাক্ষাত পান নি এমন হতেই পারে না। রীতিমতো সয়লাব হয়ে থাকে মুত্র বিসর্জনের দগদগে সাক্ষি হয়ে থাকা সেই ফুটপাথ।
ঘটনা ৪:
খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা- খাদ্য পুষ্টি ভবন পার হওয়ার কয়েকগজ দুরেই মুত্রের দূর্গন্ধযুক্ত পরিবেশের সন্ধানও আশা করি অনেকেই পেয়ে থাকবেন। কাজটি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা করে না। করে রিক্সা চালক বা এই শ্রেণির মানুষগুলো।
এবার আর আলাদা করে ঘটনা নয়। ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই ফুটপাথ দখল করে থাকে মুত্রের দূর্গন্ধযুক্ত তরল। পথচারী কখনো একটু বাঁকা হয়ে কখনো লম্ফ দিয়ে সেসব এলাকা পার হয়ে যাচ্ছে নাকে হাত চাপা দিয়ে। কখনো বা কখনো মনে মনে বা ফিসফিস করে গালিও দিচ্ছে অপকর্মকারীদের উদ্দেশ্যে।
আবার যারা নারীতো বটেই পুরুষও যত্রতত্র টয়লেটে যেতে পছন্দ করেন না তারা ঘরের বাইরে গেলে পানি পান করেন না বা অনেকক্ষণ প্রশ্রাব চেপে রাখেন। যা শরীরের জন্যে খুবই ক্ষতিকর।
দায়ী কে?
দায়ী কে? এই কথায় অনেকেই অনেকভাবে বলতে পারেন।
১. প্রথম দিকের যে ঘটনার কথা বললাম সেক্ষেত্রে ঢাকা শহরের অপ্রতুল পাবলিক টয়লেট তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২. পাবলিক টয়লেট কাছাকাছি থাকার পরও আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ মানুষদের সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় তারা সচেতন নাগরিক নয় কোনভাবেই। ১০টাকা খরচ করে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করবে না। কিন্তু নিজের সন্তানকে সচেতন বানাতে উঠে পরে লেগে থাকেন দিবানিশি।
৩. হাতের নাগালেই পাবলিট টয়লেট না থাকায় নিম্ন চাপের সম্মুখিন হলে তখন ফুটপাথই টয়লেটের অভাব পূরণ করে।
৪. কখনো কখনো শোনা যায় পুরুষকুল নিজেদের পুরুষত্ব জাহির করতেও নাকি এই কাজটি করে থাকেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কথায় বিশ্বাসী নই।
৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন কোন টয়লেট নেই যা খুব সহজেই বহিরাগতরা ব্যবহার করতে পারেন। সে যেই শ্রেণিরই হোক না কেন। সেখানকার কোন শিক্ষার্থীকে বহন করে আনা কোন রিক্সা চালক বা সিএনজি চালক নিশ্চয়ই টিএসসির ভেতরের টয়লেট ব্যবহারের সাহস রাখে না। আর সাধারণ বহিরাগতদের জানারও সুযোগ নেই টিএসসি বা আর্টস বিল্ডিংয়ের ভেতরের টয়লেটের খবর।
৬. অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কী অবস্থা তা সংশ্লিষ্টরাই বলতে পারবে।
কিছু ভাবনা:
আমি নগর পরিকল্পনাবিদ নই। একেবারে সাধারণ একজন নাগরিক। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো খোঁচায় প্রায়শই। অনেককেই খোঁচায় ধারণা করতে পারি। নগর নিয়ে, পাবলিক টয়লেট নিয়ে কোন আইন জাতীয় কিছু আছে কিনা একটু খোঁজ নিয়ে পেলাম-
বাংলাদেশের সুষ্ঠু নগরায়নের স্বার্থে প্রস্তাবিত নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন-২০১৫তে বলা হয়েছে-
২(৬) “নগর” বলিতে এইরূপ যে কোন একটি এলাকা, যাহা পারিপার্শ্বিক পল্লী এলাকা অপেক্ষা
বর্ধিষ্ণু, পুঁজিঘন ও উচ্চ জন-ঘনত্ব সম্পন্ন এবং উন্নততর (নূন্যতম) নাগরিক সেবা-সুবিধা
সম্বলিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-কৃষিনির্ভর পেশাজীবী লইয়া গড়িয়া উঠা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল
একটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র (space)-কে বুঝাইবে যেখানে সকল পুঁজির (Economical, Social, Ecological etc.) ক্রমাগত বিকাশ লাভ করিবে
এখানে সরাসরি পাবলিক টয়লেট নিয়ে কোন কথা না থাকলেও উন্নততর নাগরিক সেবা-সুবিধার কথা বলা হয়েছে। এই নাগরিক সেবা দিতেই বর্তমানে কাঠাল বাগান এলাকায়, তেজগাঁও এলাকায় উন্নত সেবার পাবলিক টয়লেট চোখে পড়ে। যা অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা যায়। আরো চোখে পড়ে কাটাবন এলাকায়, মহাখালি এলাকায় এবং কাকলী (এলাকাটা বনানীও হতে পারে নিশ্চিত নই)তে মোবাইল টয়লেট-এর ব্যবস্থা দেখা যায়। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।
কিন্তু আমার চোখে এখন পর্যন্ত এমন কোন পাবলিক টয়লেট চোখে পড়ে নি যা বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ ভিক্ষুক, দিন মজুর, শ্রমিক শ্রেণি যারা অর্থের দুশ্চিন্তা না করেই পাবলিট টয়লেট ব্যবহার করতে পারে।
সচেতন মানুষ এই শ্রেণির কথা ভেবেছিল কিন জানি না তবে বিনামূল্যে পাবলিক টয়লেট এর দাবী জানানো হয়েছে গত ১৯ শে নভেম্বর ২০১৬ সালের বিশ্ব টয়লেট দিবসে
একবার ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদের পাশের লেকের ধারের টয়লেটটিতে কিছুদিনের জন্যে একটি প্রিন্ট করা কাগজ সাঁটা চোখে পড়লো।
নামাযের সময় মুসুল্লিদের জন্যে টয়লেট ফ্রি।
নিঃসন্দেহে এটিও ছিল সচেতন মানুষগুলোর ভালো একটি উদ্যোগ।তবুও কিছু মানুষ নামায পড়ার আগে বিনামূল্যে টয়লেট ব্যবহার করার সুযোগ পেতো। যদিও পরবর্তীতে তা আর চোখে পড়ে নি।
আমাদের মাননীয় ধর্মমন্ত্রীর একটি উদ্যোগ অনেকের কাছেই নিন্দাজনক মনে হলেও আমার মনে হয়েছিল তবুও কিছু মানুষ যত্রতত্র মল মুত্র ত্যাগ থেকে বিরত হয়ে ধারে কাছের পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করবে এবং মসজিদে গমন করবে।
ঢাকা শহরের অনেক দেয়ালেই দেখা যায় এমন সব লেখা
মানুষকে সচেতন করতে এসেও সতর্ক করে দেয়ার ঘটনাও অহরহই ঘটছে
সচেতন নাগরিকরাো এর উদ্যোগে পিছ পা হচ্ছেন না। ছবিটি ২০১৪ সালের পাবলিক টয়লেট দিবসের।
সচেতন ব্লগাররাও পিছিয়ে নেই এই পাবলিক টয়লেটের আন্দোলন থেকে। ব্লগে বিভিন্ন সময়েই দেখা যায় টয়লেট নিয়ে লিখতে। সরাসরি পথে নেমেও আন্দোলনে অংশ নেয়া ব্লগারও রয়েছে।
এই ছবিতে সহব্লগার শোভনও আছেন অন্যান্যদের সাথে।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দিয়েছেন ২০১৭ সালের মধ্যে ১০০টি পাবলিট টয়লেট নির্মানের। দেখা যাক ২০১৭ সালের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর দেয়া কথার বাস্তবায়ন করতে কতটুকু সক্ষম হন।
ছবি: ১, ৪, ৫,৯ এবং ১০ নম্বর ছবিগুলো নেট থেকে নেয়া।
২, ৩,৬,৭,৮ আমার নিজের ক্যামেরায় তোলা
১ নং ছবিটা Shefan AL Emon এর ক্যামেরায় তোলা
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:১৩