আমাদের চিন্তাধারা ও মননের গঠন ও বিবর্তনে সহায়ক যেসব শক্তি বিশ্বে বিদ্যমান তার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হলো গণমাধ্যম। সঙ্গতকারণে গণমাধ্যম কর্মীরাই বাংলাদেশে জেন্ডার সংবেদী সংস্কৃতি গড়ে তোলায় গণমাধ্যমের ভূমিকাকে আরও বেগবান করে তুলতেপারেন। সমাজের যে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা সামাজিক রীতি-নীতি ও আচার-আচরণ শিখে থাকি, তার মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী হলো গণমাধ্যম। বহুধা বিস্তারের ফলে গণমাধ্যম এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও শিক্ষার সিংহ ভাগই এখন মানুষ গণমাধ্যম থেকে পায়। নারী-পুরুষের বৈষম্যের প্রশ্নেও বলা যায় যে, গণমাধ্যম নানাভাবে এই বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখতে পারে। আবার একইভাবে গণমাধ্যমের মধ্য দিয়েই একটি সমতামূলক সমাজগঠন বার্তার প্রসার ঘটতে পারে। আর তাই সমাজে রাষ্ট্রে তথা অন্তর্জাতিক অঙ্গণে নারী ও পুরুষের ভারসাম্যময় উপস্থিতির জন্য গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত জরুরী।
প্রায় সব ধরনের মিডিয়া বা গণমাধ্যমে প্রবেশের সুযোগ এদেশের মানুষের রয়েছে। এসব গণমাধ্যমের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। যেমন-
• শ্রবণ সম্বন্ধীয়- রেডিও, ক্যাসেটস, সিডি, সেলুলার ফোন ইত্যাদি
• শ্রবণ-দর্শণ সম্বন্ধীয়- ছায়াছবি/চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, ভিডিও, মঞ্চ, নাটক, ইন্টারনেট ইত্যাদি
• দর্শণ সম্বন্ধীয়- ছবি, পোস্টার, কার্টুন, শিল্পকলা, পেইন্টিং ইত্যাদি
• মুদ্রণ শিল্প- সংবাদপত্র, বই, ম্যাগাজিন লিফলেট ইত্যাদি
গণমাধ্যমে নারীর বর্তমান চিত্র জানতে এখানে রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, পোস্টার, সংবাদপত্র এবং বিকল্প মাধ্যম অর্থাৎ ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেয়া হবে।
ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে নারী:
আজকে বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থিতি নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করবো-
নব্বইয়ের দশকে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে যে সব বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো বর্তমানে তা আরও আকর্ষণীয়, জৌলুসপূর্ণ ভাবে প্রচারিত হয়ে থাকে, বদলে গেছে উপস্থাপনের ধরণ। তবে তারপরও বিজ্ঞাপনে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায় তা সাধারণত নেতিবাচক। একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় দেখা যায়বিশেষ একটি ব্র্যান্ডের টিভি স্বামীর (!) বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়ের অনুষ্ঠানেই জেদ ধরে মেয়েটি। এধরনের বিজ্ঞাপন যৌতুকের মতো ঘৃণ্য প্রথাকে প্রকারান্তরে সমর্থন করে। আবার মুখের ক্রিমের বিজ্ঞাপন গুলোতে দেখানো হচ্ছে মেয়ে কালো বলে বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে, আর সেই নির্দিষ্ট ক্রিম মাখার কারণে রং ফর্সা হওয়াতে নতুন উদ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে এখানে মেয়ের গুণ নয় বরং রূপকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের খ্যাত অভিনেত্রী সূবর্ণা মুস্তফা, রোকেয়া প্রাচী, ভারতের কাজল, বিপাশা বসু, হলিউডের হ্যলবেরি বা জেনিফার লোপেজের গায়ের রং তাদের পথ চলার ক্ষেত্রে কোন বাধা হতে পারেনি।আর এসব বিজ্ঞাপন প্রকারান্তরে বর্ণবাদকেই উসকে দেয়। যত মসলার বিজ্ঞাপন আছে তার সবটা জুড়ে থাকে নারী, যেখানে সুবিধাভোগী হিসেবে পুরুষকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এমনও দেখা যায় স্বামী –স্ত্রী উভয়েই সারাদিন অফিস করে এসে স্ত্রী ঢুকলেন রান্না ঘরে আর স্বামী সংবাদপত্র পড়ে, টিভি দেখে সময় পার করছেন এবং টেবিলে এসে রান্না মুখরোচক কম হওয়াতে স্ত্রীকে বকাবকি করছেন। এবং সেই মসলায় রান্নার মুখরোচক হওয়া খাবারে সংসারে শান্তি ফিরে আসে। বস্তুত যারা বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেন এবং করান তাদের কেউ কেউ মনে করে থাকেন বিজ্ঞাপনে নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তা সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু পণ্যের উৎপাদক ও বিক্রেতা নারীর ইতিবাচক ভূমিকাকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন মাত্রায় দেখানো হলে একদিকে পণ্যের প্রচার ও হয় আর অন্যদিকে নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে একটি চায়ের বিজ্ঞাপনে নারীকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে বরং নিজের গুণাবলির প্রকাশ ঘটাতে বলা হচ্ছে। অন্য একটি ফলের জুসের বিজ্ঞাপনের নারীর নির্দিষ্ট একটি ফল নিয়ে ভবিষ্যত ভাবনার উপস্থাপন এবং বার্ধক্যে তার সেই ভাবনার বাস্তবরূপ দেখানো অন্য বিজ্ঞাপনের তুলনায় এধরনের বিজ্ঞাপনের প্রচারে প্রসার কোন অংশে কম নয় বরং বেশিই হতে পারে।
চলবে-
উৎসর্গ: নারীর ইতিবাচক উপস্থাপনে নিবেদিত গণমাধ্যমের কর্মীদের সম্মানে