বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা নিয়ম তাঁর পছন্দ ছিল না। তাঁর ভাবনা আন্দোলিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধ, মন্বন্তর ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতন বিভিন্ন সামাজিক অথবা জাতীয় সমস্যায়। মতাদর্শে ছিলেন সাম্যবাদী। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজতান্ত্রিক। কালের অনিয়ম তাকে প্রবলভাবে অন্দোলিত করত। কানে একটু কম শুনতেন। তবে, আর্তের আর্তনাদ শুনেছেন ঠিকই।
আর তাই তিনি সূর্যের কাছে প্রবল আকুতি জানিয়েছিলেন, ‘রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটিকে’ উত্তাপ দেবার জন্য। তাঁর তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে পূর্ণিমার চাঁদের সৌন্দর্য ছাপিয়ে ঝলসানো রুটি প্রাপ্তির তৃপ্তিই প্রখর হয়ে ধরা পড়েছে। কবি হলেও, তাঁর কাব্যে নিসর্গের বদলে জীবনই মূখ্য। সকল নবজাতকের কাছে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাবেন বলে।
জীবন নিয়ে অনিয়মের প্রবল পীড়ন রুগ্ন তরুণ শরীর বেশিদিন বইতে পারেনি। তিনি আকাশের তারা হয়ে গিয়েছিলেন মাত্রই ২১ বছর বয়সে। অথচ হারিয়ে গিয়েও বেঁচে আছেন প্রজ্বলন্ত সব কবিতায়। বুঝিয়েছেন পদ্য শুধু বিমূর্ত সাহিত্য নয়, এর মূর্ততা পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার। তিনিই কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
সুকান্তের জন্মের প্রায় সাড়ে আট দশক আগে আরো একজন ক্ষণজন্মা এসেছিলেন বাংলার সাহিত্যাকাশে। ‘হুতোম প্যাঁচা’ ছদ্মনামে, গাজনতলায় ঢাকের বাজনার সাথে পায়ে নুপুর, মাথায় জরির টুপি আর কোমরে চন্দ্রহার পরিহিত তৎকালীন নব্য ধনিক বাবু সমাজের বিচিত্র সব মানুষের চিত্রাঙ্কন করেছিলেন তিনি। তাঁর নকশা ছিল লঘু ভাষায় ভরপুর, হাস্যরসে পরিপূর্ণ, নাতিদীর্ঘ অথচ তীক্ষ্ণ ইঙ্গিতে সমুজ্জ্বল। সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলার বদলে সহজ কথ্য ভাষা বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
তিনি ১৮ থেকে ২৬ বছর বয়সের মধ্যে মহাভারতের ১৮টি পর্ব বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সৃষ্টি হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি একটি বিশেষ মাইলফলক।
মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ‘মহাকবি’ আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। একাধারে লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক ছাড়াও ছিলেন সমাজ সচেতন জনহিতৈষী ব্যক্তি। হুতোম প্যাঁচা ছদ্মনামের পেছনের এই মানুষটি কালীপ্রসন্ন সিংহ। বেঁচে ছিলেন মাত্র ২৯ বছর।
সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ এই বাংলায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এসেছিলেন। একজন এঁকেছেন পদ্য, আরেকজন লিখেছেন গদ্য। তবে উভয়ই তাদের স্বল্পকালীন প্রখর উপস্থিতিতে বাংলা সাহিত্যকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছেন প্রবলভাবে। প্রথমজন মর্ত্যলোকে ছিলেন ২১ বছর, আর দ্বিতীয়জন ২৯। বিরল প্রতিভাধর সুকান্ত আর কালীপ্রসন্ন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে, বাংলাকে আরো কতটা ঋদ্ধ করতে পারতেন সেটা সাহিত্য আলোচনার বিষয়। তবে যা দিয়েছেন, তা দিয়েই তারা নীল আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে টিকে থাকবেন আজীবন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২০ বিকাল ৪:৩০