আমার বিছানা থেকে ডান দিকে ঘাড় কাত করলেই, জানালা পেরিয়ে পূবের আকাশ দেখা যায়। সেই আকাশ জুড়ে মেঘ ঘুরে বেড়ায়। ঘুড়ি উড়ে। এক ঘুড়ি আরেক ঘুড়ির সাথে কাটাকাটি করে। পাখিরা পাখা মেলে ভেসে বেড়ায়। সামনের পাখি পেছনে যায়। পেছনের পাখি সামনে যায়। ঝিকিমিকি তারারা মিটিমিটি হাসে। লাল তারা। নীল তারা। মা শিখিয়েছে সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে আর চাঁদ ওঠে পশ্চিম দিকে। কিন্তু, আমার পূবের জানালা দিয়ে প্রতি মাসের অল্প ক’দিন বড় হয়ে চাঁদ ওঠে। রূপালী থালার মত। জানালার কাঁচ খুলে দিলে, এমন করে ঘরে বাতাস ঢুকে, মনে হয় এক সমুদ্র হাওয়ায় ভেসে যাই আমি।
এই জানালা নিয়ে আমাদের অনেক মজা। বাবা বলে, গো যোগ অক্ষ, গবাক্ষ। মনের কোনায় কোনায় আনন্দের রেণু ছড়িয়ে দিয়ে যার সার্থকতা, তার নাম গবাক্ষ হতে হবে কেন? আর হো হো করে হাসে। এ নিয়ে মা-বাবা’র প্রায়ই কথা হয়। আরো যেন কি কি সব বলে। পাশের ঘরে বসে শোনা মা-বাবা’র কথাগুলো আমি সব বুঝতেও পারি না। একা থাকার সময় আমার কেবলই মনে হয়, মেঘ যদি আমার বন্ধু হত? তবে আমি ওর বাড়ি বেড়াতে যেতাম। হারিয়ে যেতাম। আমি বিড় বিড় করে বলি, আয় মেঘ, আয় মেঘ। কিন্তু, মেঘ আর আসে না।
পড়তে শিখছি শুনে, দাদুমনি আমাকে একটা বই দিয়েছেন। মা বলেছে তার শিশুবেলায়, ঠিক এমন একটা বই মা’কে তার নানী দিয়েছিলেন। আমি ভীষন অবাক হয়েছি! যে বই মা পড়েছে, সেই বই আমিও পড়ছি! মা অনেক আগ্রহভরে সন্ধ্যাবেলায় সেই বইটা নিয়ে আমাকে পড়াতে বসায়। সেই বইয়ের কোন কোন কথা আমার মনে অজস্র প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই যেমন, ‘চোখ পেটের চেয়ে বড়’। মা বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমি কোনভাবেই বুঝি না। বড় মামার বড় ভুড়ি নিয়ে সবার কত কথা, কত হাসাহাসি। বাবা মজা করে বলেন, এতো ভুড়ি নয় কাঞ্চনজঙ্ঘা! আমিতো জানিই, কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশাল এক পাহাড়ের নাম। তারপরেও চোখ পেটের চেয়ে বড়? মাথা দুলে ওঠে। আর যখনই এমন হয়, আমি আমার জানালার কাছে চলে আসি। মেঘের ভেলার দিকে তাকাই। কারন, আমি মেঘের সাথে মিতালী করতে চাই।
আমি স্কুলে যেতে ভালবাসি। ওখানে বন্ধুদের সাথে অনেক কথা হয়, গল্প হয়। আমরা প্লেডোহ দিয়ে খেলি। ছবিতে রঙ করি। গান করি। দলবেধে নাচি। এসবের মধ্যেও ইরিনা আমার সাথে আলাদা করে কথা বলে। ইরিনা বলে, ওর নাকি একজন বিশেষ বন্ধু আছে। যার সাথে ও বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যায়। গত গরমের ছুটিতে ওরা পুরো পরিবার দু’দিনের জন্য নানুবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। নানুবাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় ও যখন বারান্দায় বসে একা একা খেলা করছিল, তখন সেই বন্ধু ওর কাছে এসেছিল। ওরা দু’জন মিলে সেই সন্ধ্যায় এন্টার্কটিকা গিয়েছিল, পেঙ্গুইন আর সাদা ভাল্লুক দেখতে। সেই বন্ধুটি ওর কাছে প্রায়ই আসে। ওরা কথা বলে। একসাথে খেলে। ঘুড়ে বেড়ায়। আমাকে অবাক করে দিয়ে ইরিনা বলেছে, ঐ বন্ধু ওকে মেঘের দেশেও নিয়ে গিয়েছিল। মেঘের দেশে সবকিছু সাদা। দূর থেকে মনে হয় তুলার রাজ্য। সেখানে ঠান্ডা বাতাস। হাটতে গেলে পা ডুবে যায় নরম নরম মেঘে। সে এক দারুন ব্যাপার।
ইরিনা বলেছে ওরা দু’জন একবার মেক্সিকোর জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে নাকি লম্বা জিরাফ, গন্ডার আর শিম্পাঞ্জি দেখেছিল। গন্ডারের সাথে মারামারি করে শিম্পাজির আটটা দাঁত পড়ে গিয়েছিল। সেই একই দিনে, জঙ্গলে বোমা ফুটে ২৮টা গাছ, ৩১টা ফুল আর ৪৮টা প্রাণী মারা গিয়েছিল। তারপরের দিন, ইরিনার ভীষন জ্বর হয়েছিল। উথাল-পাথাল জ্বর।
ইরিনা এসব শুধু আমাকেই বলে। কারন, আমারও এমন একটা বন্ধু আছে। গোপন বন্ধু।
সে রাতে নেমেছিল জ্যোৎস্নার ঢল। আকাশ থেকে চুইয়ে পড়া জ্যোৎস্নার আলো খোলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে অবিরত। বিছানায় ডান কাতে শুয়ে, বাবার বুকে মুখ ডুবিয়ে আমি বলেছিলাম আমার সবচেয়ে গোপন কথা,
-- বাবা জান, আমি ইজিপ্ট গিয়েছিলাম?
--- তাই নাকি?
-- হুম। ওর সাথে।
--- ও কে?
-- আমার বন্ধু। তুমি জান না বুঝি?
ওর সাথে মাদাগাস্কারে গিয়ে বালির দূর্গ বানিয়েছি। ইন্দোনেশিয়ার রেইন ফরেস্টে বিশাল র্যাফলেশিয়া ফুল দেখেছি। একসঙ্গে আমরা সমুদ্রের নিচেও গিয়েছি। পাথুরে মাটিতে হেটে বেড়ানো বিশাল স্পাইডার ক্র্যাব দেখেছি। ভাইপার মাছের সূঁচের মত দাঁত এত্ত বড় যে ওরা মুখই বন্ধ করতে পারে না। আমরা মহাশূন্যেও গিয়েছি। শনি গ্রহের বলয়ে পা ঝুলিয়ে বসে নীল রঙের পৃথিবী আর লাল রঙের মঙ্গল গ্রহ দেখেছি।
মা-বাবা দু’জনেই মাঝে মধ্যে ওর কথা জিজ্ঞেস করে। ও কি আমার কাছে আসে? কখন আসে? কি কথা বলে? কি রঙের জামা পরে এইসব। কিন্তু আমি সব কথা বলতে চাই না। ওরা মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলে।
আমি গবাক্ষ নামের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। বাতাসের রঙ দেখি। গন্ধ শুঁকি। আমি ভেসে বেড়াই। মেঘের রাজ্যে। তারাদের রাজ্যে। ঘুরতে থাকি গায়ে জ্যোৎস্না মেখে।
মা বলেছে, ওকে দাওয়াত দিতে। আমাদের বাসায় বাসায় প্লে-ডেট করতে। আমি চাইনি। কারন, ও আমার বন্ধু। শুধু আমারই বন্ধু।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:২১