somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কৃষ্ণপক্ষের গল্প

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাইয়ার এসএসসি পরীক্ষা সামনে। ওর পড়ার জন্য আরেকটু জায়গা দরকার। ভাই-বোনেরা বড় হচ্ছি। জায়গা দরকার আমাদেরো। এসব বিবেচনা করে, বাড়িটাকে আরেকটু বড় করার কথা ভাবলেন আব্বা। দেখতে দেখতেই নতুন একটা ঘর উঠল আমাদের। জোড়া লেগে গেল, পুরানো বাড়িটার সাথে। আমার খুশির মাত্রাটা একটু বেশি। কারন, নতুন ঘরের বাইরের দেয়ালে, ছাদ ঘেঁষে, দু’টো লোহার হুক লাগানো হয়েছে। যেখানে, বাঁশের পোল লাগানো যাবে। সেসময়, খেলার দিনে প্রিয় দলের পতাকা বাঁশের মাথায় লাগিয়ে উড়ানো এক ধরনের নিয়মের মদ্ধে পরত। অলিখিত একটা প্রতিযোগিতাও হত। কার পতাকা কত বড় আর কত উঁচুতে উড়েছে, সে নিয়ে। পত্রিকা পড়ার প্রয়োজন পড়ত না। পাড়ায় বের হলেই বলে দেয়া যেত, আজ মোহামেডানের খেলা, অথবা আবাহনী।

খেলা দেখতে মামা আর খালাতো ভাইয়ের সাথে ছয় বছর বয়সে প্রথম স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম ১৯৮০ সালে। ঢাকা লীগের খেলা। মোহামেডান ৪-০ গোলে জিতেছিল পুলিশের সাথে। সালাম, বাদল রায় আর মোসাব্বের গোল করেছিল সেদিন। সেই শুরু।

যখন বড় হতে লাগলাম, মধ্য আশির সময়গুলোতে, কি ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বিতাই না হত। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সাথে গন্ডগোল করার অপরাধে, খেলার মাঠ থেকে সালাহউদ্দিন, চুন্নু, হেলাল আর আনোয়ারকে একবার পাঠিয়ে দেয়া হল যশোর জেলে। পরদিন, দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় শুধুই এ ঘটনার বর্ণনা। এল ক্লাসিকোর চেয়ে, লন্ডন ডার্বির চেয়ে মানে পিছিয়ে ছিলাম, তবে কোনভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নয়।

শেষ দুপুরে খেলা শুরুর দু-তিন ঘন্টা আগেই উপচে উঠত গ্যালারী। তার আগে সকাল থেকেই চাপা উত্তেজনা। কি হবে আজ, কি হবে। আবাহনীর লেফট উইঙ্গার চুন্নুর সাথে মোহামেডানের রাইট ব্যাক আবুল কি পারবে? রাইট ব্যাকে কে সবচেয়ে ভাল? ‘রিক্সাওয়ালা আবুল’ নাকি সদ্য অবসরে যাওয়া নির্ভীক মঞ্জু?

দলবদল মানেই বাড়তি উত্তেজনা। পত্রিকার কাটতি বেড়ে যাওয়া। ইলিয়াস আলীকে ড্রেসিং রুমের পেছন দিয়ে বের করে, মোটর সাইকেলে চড়িয়ে সোজা নিয়ে আসা হল ঢাকায়। সম্রাট হোসেন এমিলি পর পর ছয় বছর চ্যাম্পিয়ন দলে খেললেন। মোহামেডান থেকে আবাহনীতে গিয়েই ‘জামাই আসলাম’ হয়ে গেলেন সুপারস্টার। খুলনায় খেলতে গিয়ে ব্রাদার্সের মোহসিনের গায়ে একবার বোমা পরল। বিআরটিসির রুমি, কৃষ্ণা মানেই আবাহনীর আতংক। টাচ লাইন ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্রাদার্সের ওয়াসিম, মোহামেডানের জোশি, মনু। রক্ষনে অতন্দ্র প্রহরী আবাহনীর মোনেম মুন্না।

চীমা ওকেরী কোন দলে খেলবে, সে নিয়ে ভীষন ফ্যাসাদ। দুই দলই তাকে দলে ভেড়াতে চায়। শামির শাকের, করিম আলভি, নাসের হেজাজির, এমেকা ইউজিগো, নালজেগার, রহিমভ কতসব তারকা। কেউ বিশ্বকাপ খেলে এসেছে। কেউবা এখানে খেলে বিশ্বকাপে গিয়েছে। এশিয়ান ক্লাব কাপে ইরানের পিরুজি ক্লাবকে ২-১ গোলে হারিয়ে মোহামেডান চুড়ান্ত পর্বে খেলতে থাইল্যান্ড গেল এশিয়ার কুলীনদের সাথে লড়াই করবে বলে।

বেকেলহফট দিয়ে শুরু। তারপর কত বিদেশী কোচ এলেন। হাই প্রোফাইল অটো ফিস্টারো এসেছিলেন। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সে কোচদের তালিকায় জার্মান, ডাচ, কোরিয়ান, ইরানিয়ান, ইরাকি, ব্রাজিলিয়ান এমনকি নিকটতম প্রতিবেশি ভারতও আছে।

মালদ্বীপের কোন দল এলে, খেলা দেখার আগ্রহে ভাটা পড়ত। সবাই জানত চার, পাচ গোলের ব্যাবধানে জিতবে আমাদের দল। ফল জেনে গেলে খেলা দেখার ইচ্ছেটা মরে যায়। আমাদেরো যেত। শ্রীলংকা, ভুটানকে দুধভাত মনে করে, কত কথাই না হত। জাতীয় দলতো দুরের কথা। ভুটানের সাথে খেলা উচিত সেকেন্ড ডিভিশনের কোন দল। এমন ভাবত কত শত জন।

ক্লাবগুলোতে সবসময়ই জুয়ার আসর বসত, এখনো বসে। বহু বছর ধরেই এদেশে পাতানো খেলা হ্ত, এখনো হয়। রাজনীতি সবসময়ই ছুঁয়ে থেকেছে খেলার মাঠ। তারপরেও একজন মেজর হাফিজ ছিলেন। একজন রহিম ছিলেন। কায়কোবাদ, গোলাম সারওয়ার টিপু ছিলেন। এনায়েত, সালাহউদ্দিন, মোনেম মুন্না, কায়সার হামিদরা ছিলেন। খেলোয়াড়-কোচ-সংগঠকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সময় মত ফেডারেশন কাপ হত, লীগ হত। কিন্তু, নব্বইয়ের পর থেকেই কি যেন হয়ে গেল আমাদের। বিভিন্ন পর্যায়ে সেই লোকগুলো থাকলেন ঠিকই, কিন্তু প্রক্রিয়াগুলো থাকল না।

হঠাৎ করে উদয় হল, ভুঁইফোড় কিছু ক্লাব। তারই ধারাবাহিকতায় ধানমন্ডি নামের সুন্দর একটা ক্লাবের নাম পালটে গেল একদিন। আগা খান গোল্ড কাপ বন্ধ হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই। ফেডারেশন কাপও বন্ধ হয়ে গেল। দলীয় রাজনীতির প্রয়োজনে একটা বিশেষ পরিবারের নাম কেন্দ্রিক বড় বড় টুর্নামেন্ট শুরু হল। তবুও মানে থাকত, যদি অর্থবহ কিছু হত। এসব নামে ভারী টুর্নামেন্ট যদি নিয়মিত হত। সেটাও হয়নি।

এরি মাঝে এদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, বিদেশে প্রথম লীগ খেলে আসা সালাহউদ্দিন সাহেব আমাদের নির্বাচনী স্বপ্ন দেখান। বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের মূল পর্বে খেলবে। পারলে বিশ্বকাপ জিতবে একথাও বলে ফেলেন। কি নির্লজ্জ। কি বেহায়া। কি বেশরম। অবশ্য হায়ার মাথা খেয়েছেন বলেইতো এমন কথা বলেছেন। শরম নেই বলেইতো এখনো আছেন। আমাদের সোনালী ফুটবলের সকল সম্ভাবনাকে ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের অতল গহবরে ঠেলে দিয়েও বলছেন, “আমি যাবনা, আমি যাবনা”, একথা সহস্রবার।

যাদুকর সামাদের এদেশে, শরতের পেজা তুলো, হেমন্তের পাতা ঝড়া গান আর শীতের হিমেল হাওয়ার সুরভি নিয়ে ফুটবল আসত, আমাদের ঘরে। আমাদের বেঁচে থাকার নিয়ামক হয়ে। প্রতিদিনের অজস্র কষ্টের মাঝে, প্রতিকুল পরিবেশে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মাঝে, জীবনে তরঙ্গ তুলতে, উৎসব হয়ে আসত ফুটবল। ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে সবার জন্য।

শহরতলীর যেখানে আমরা থাকতাম, ফিবছর বর্ষার পানিতে তার একটা বড় অংশ ডুবে যেতে। নতুন পানিতে, পরিষ্কার জলে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়তাম। বলটাকে কায়দা করে পেটের নিচে চেপে ধরে রাখতে পারলেই, ডুবে যাবার ভয় নেই। গোলাকার বলটা এভাবেই ভাসিয়ে রাখত, জীবন রাঙাতো আমাদের।

আজ সেই বল নেই। নতুন জলে সন্তরনের জায়গাও নেই। ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষের রাতে ঘুম ভাঙলেই মনে হয়, ডুবে যাচ্ছি না তো! সত্যি, নাকি দুঃস্বপ্ন?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:২৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×