দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের চার কলাম জুড়ে বিদেশী মোবাইল ফোনের বেশ বড়সড় একটি বিজ্ঞাপন। ভাষা অত্যন্ত বাহারী। “সুপার, ডুপার, বাম্পার। ঝাক্কাস। একদম মাস্ত। & xtra বোনাস।“ আপাতদৃষ্টে বিজ্ঞাপনটিকে খুব নির্দোষ একটি ব্যাতিক্রমি প্রচেষ্টা মনে করে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি, খুব অস্বাভাবিক মনে হবে না। বিদেশী ভাষা ব্যবহারের এ ব্যাপারটি যখন সংহারী রূপ নিয়ে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে অহরহই ব্যাবহৃত হচ্ছে, তখন এটাকে খুব বিচ্ছিন্ন কিছু ভেবে গা এলিয়ে দেবার উপায় নেই। এটা বরং ঢাল বেয়ে গিরিখাদে নেমে যাবার প্রারম্ভিক উপসর্গ। ঈষাণ কোনের মেঘ।
দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল সার্ভিস অপারেটর নিজেদের ব্যাবসার স্বার্থে আমাদের তরলমতি যুব সমাজের আবেগ-উচ্ছ্বাসের সাথে সুকৌশলে তাদের একটা প্রোডাক্ট জড়িয়ে দিয়েছে। যেটা বলতে গেলে ছোট খাট একটা বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে। লোকে বলে “ডিজুস বাংলা।“ এক চিমটি হিন্দি, এক মুঠো ইংরেজী আর আধ লিটার অশুদ্ধ বাংলার সমন্বয়ে প্রস্তুত এ “স্যালাইন বাংলা” আজ এ প্রজন্মের কারো কারো কাছে স্মার্টনেসের এক অবিচ্ছেদ্য উপকরন। স্যালাইন, শব্দটা এখানে বাংলার আগে জুড়ে দিতে হল। কারণ, এ ধারায় চলতে থাকলে কোন একদিন আমাদের মায়ের ভাষাকে হয়ত স্যালাইন দিয়েই টিকিয়ে রাখতে হবে। হয়ত পাঠাতে হবে যাদুঘরে।
ভাষার পরিবর্তন ধারাবাহিক। সত্য। যুগে যুগে কালে কালে মানুষের মুখেই টিকে থেকেছে, ঘটেছে ভাষার শ্রীবৃদ্ধি। আবার, সংস্কৃতের মত সমৃদ্ধ ভাষারও মৃত্যু হয়েছে। আধুনিকায়ন, সৃষ্টিশীলতা আর স্বাধীনতার পাল তুলে ভাষা যে কোন গন্তব্যে ছুটে চলেছে সেটা একটা প্রশ্ন বৈকি?
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) বলে একটা কথা আছে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো গরীব দেশে বাণিজ্য করতে এসে সে কথা যে সব সময় মানবে না, সেটা জানা কথা। কিন্তু, দেশের ইলেক্ট্রনিক এবং প্রেস মিডিয়া, তারা কি করছে?
একটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের স্বউদ্ভাবিত বানান রীতির বই আজ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এবং কি করছে তারা?
এই সেদিন আমার এক পরিচিতের বাচ্চা স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছে, শিক্ষক তার বানান কেটে দিয়েছে বলে। আমরা তির বোঝাতে যে ‘কূল’ লিখি, সে তার প্রিয় পত্রিকার অনুকরণে লিখেছে ‘কুল’। আবার আলো অর্থে যে ‘দীপ’ লিখি, একই পত্রিকা অনুসরন করে সে লিখেছে ‘দিপ’। এভাবেই আমাদের ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট দীর্ঘ-উ এবং দীর্ঘ-ই কারকে সুচিন্তিতভাবে পাঠানো হচ্ছে হিমাগারে।
কিছু কিছু পত্রিকা ভাষাকে আধুনিক এবং গতিময় করার নামে অপ্রয়জনীয় এবং যথেচ্ছভাবে আমদানী করছে বিদেশী শব্দ। জাতীয়কে ‘ন্যাশনাল’, বিনোদনকে ‘এন্টার্টেইনমেন্ট’, শিল্প ও সংস্কৃতি কে সরাসরি লিখছে ‘আর্ট এন্ড কালচার’।
বাংলা ভাষা যে সকল বিশেষ বৈশিষ্টগুলোর কারণে বিশ্বের সকল ভাষার মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে তার অন্যতম একটি হল, ভাষায় ত্রিস্তরী শব্দের উপস্থিতি। অথচ কি এক মূর্খতায় আমাদের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলো এ ত্রিস্তরী শব্দগুলোকে ভেঙ্গে কখনো একস্তর আবার কখনোবা দ্বিস্তরী করে ফেলছে। যেমন, ‘হজ্জ্বকে’ লিখছে ‘হজ’; ‘উজ্জ্বলকে’, ‘উজ্জল’।
সব সৌন্দর্যেরই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট থাকে। সে সব বৈশিষ্ট মানুষ পরম মমতায় সংরক্ষণ করে, লালন করে। অথচ আমরা কি করছি?
আধুনিক বাংলা ব্যাকরণের যে সংগঠিত রূপ তার শুরুর কথা কোন তর্কাতীত বিষয় নয়। তবে ১৮০১ সালে স্যার উইলিয়াম কেরির ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠা এবং তৎপরবর্তী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বাংলা গদ্য বর্তমানে শক্ত ভিত্তি পেয়েছে নিঃসন্দেহে।
আমাদের দেশে সর্বস্তরে লিখিত বাংলার একটি নির্দিষ্ট রূপ প্রচলন এবং প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রণীত ‘প্রমিত’ বানান রীতি রয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে স্বাধীন বাংলায় আমরা ‘স্বাধীন’ (!) বাংলা ব্যাবহার করে আত্মতৃপ্তি লাভ করছি।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানুষের মুখ থেকে মুখেই ভাষা বেঁচে থাকে। প্রায় ৫০০০ খৃীষ্ট পূর্বাব্দের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা হতে নানা স্তর, নানা শাখা-প্রশাখা পেরিয়ে আজকের বাংলা এই ২০০৮ সালে এসে তার আদি ভাষা থেকে পুরোপুরিই আলাদা। ভাষা সৃষ্টি হয়, ভাষা বদলে যায়, ভাষা এগিয়ে চলে এভাবেই।
কোনদিন যদি কোন বিদেশী বাংলাদেশে আসতে চায়, আমি বলব, “ফেব্রুয়ারী মাসে এসো। ২১ দেখতে পাবে।“
কে পারে ভাষাকে এভাবে ভালবাসতে?
কে পারে ভাষার জন্য এভাবে মরতে??
============================
সাইফুল্লাহ
সিঙ্গাপুর থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:০৪