একরাশ বিরক্তি নিয়ে হিমু মেলা দর্শন করছি। রেষ্ট্রিকটেড এরিয়া বোধহয়; কাউকে সিগারেট খেতে দেখছি না, তাই নিজেও খেতে পারছি না। পারলে ধোয়ার সাথে কিছুটা বিরক্তি উড়িয়ে দিতাম।
সামনের মঞ্চে এতোক্ষন একজন গান গাচ্ছিলো, গায়ে বাসন্তি রঙের পাঞ্জাবী। হিমু হারমোনিয়াম বাজিয়ে সমানে হেড়ে গলায় গান গেয়ে যাচ্ছে, ভাবতেই চমকিত হচ্ছি। শিল্পী হিমু, তাই বোধহয় বাসন্তি পাঞ্জাবী।
চারিদিকে চোখ বুলালাম, প্রচুর হিমু দেখা যাচ্ছে। কেউ পাঞ্জাবী পড়েছে আবার কেউ বা ফতুয়া, কয়েকজন দেখলাম ব্যস্ত ভঙ্গিতে হলুদ শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে প্যান্ট-শার্ট-কোট এর ওপর শুধু হলুদ ওড়না চাপিয়ে চলে এসেছে, একজন ফ্রান্স প্রবাসী হিমু আবার সানগ্লাসও পড়েছে। যেটা অবাক লাগছে সেটা হলো বেশিরভাগ হিমুরাই হলুদ পাঞ্জাবীর পরিবর্তে বাসন্তি পাঞ্জাবী পড়েছে, এরা বোধহয় অতিরিক্ত হিমু।
এখন স্টেজে একদল বাসন্তি পাঞ্জাবী পরিহিত হিমু, উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মাঝে ফিসফিস করছে। হাসিখুশি উপস্থাপককে দেখা গেলো, হুমায়ুন আহমেদ এর জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটার ঘোষনা দিলেন। মঞ্চে ছুড়িহাতে হিমুদের দেখা যাচ্ছে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে কেক কাটবার জন্য অপেক্ষা করছে তারা।
মেলার অন্যান্য হিমুরাও ভিষন ব্যস্ত, মেলাজুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। কেউ ম্যাজিক দেখাচ্ছে, কেউবা গান গাচ্ছে। একজনকে দেখলাম সুকান্তের অন্ন সম্পর্কিত একটা কবিতা আবৃতি করছে, ইনি সম্ভবত ক্ষুধার্ত হিমু। আরেকজনকে দেখলাম হলুদ শার্ট, জিন্স আর লাল টাই পড়ে টাচস্ক্রিন মোবাইল গুতোগুতি করছে; ডিজিটাল হিমু। প্রচুর রুপাও দেখা গেলো, নীল রঙের শাড়ির ছড়াছড়ি। এদের মাঝে উপস্থাপক একজন এর সাক্ষাতকার নিচ্ছেন, মাঝবয়সী মহিলা। সমানে কথা বলছে আর পান চিবুচ্ছে, সামনে তার বাচ্চাদুটো ছোটাছুটি করছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম ইনিও একজন রূপা, তবে বিবাহিত রূপা।
স্টেজে এখন বিখ্যাত একজন শিল্পীকে দেখা যাচ্ছে, তার কথায় জানা গেলো সে হুমায়ুন স্যারকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। তিনি একটি গান লিখেছেন স্যারকে নিয়ে, ভাবলাম এখনি গেয়ে শোনাবেন তাই এগিয়ে গেলাম। আশাহত হতে হলো, তিনি বলছেন শীঘ্রই গানটি একটি জনপ্রিয় চ্যানেলে প্রচারিত হবে। সম্ভবত ভালোবাসার মূল্য নির্ধারন এর কাজটা এখনো বাকি রয়ে গেছে...
অনুষ্ঠান থেকে বাহিরে বের হয়ে এসে চমকে গেলাম, গেটের সামনে হুমায়ুন স্যার দাড়িয়ে। আমাকে দেখে বললেনঃ কি খবর তোমাদের, কেমন চলছে?
আমি বিনিত ভঙ্গিতে হেসে বললামঃ জি হুমায়ুন সাহেব, মন্দ না।
দেখেছো? বলেছিলাম না যে হিমুদের ছড়িয়ে দেবো, দিয়েছি।
ঠিক বলেছেন, হিমুরা ছড়িয়ে গেছে। সংস্কৃতি ও শিল্পকলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা অবদান রাখছে, আমরা যুগপযোগী হিমুদের দেখা পাচ্ছি।
স্যারকে চিন্তিত দেখাচ্ছে, বললেনঃ অতিরিক্ত ছড়ালে তো মুশকিল, পরবর্তীতে কর্পূরের মতো উবে যাবে। কর্পূর চেনো? অতিরিক্ত ছড়িয়ে দিলে বাতাসে উবে যায়, হিমুরাও তো উবে যাবে। কি মুশকিল!
আমি বললামঃ হুমায়ুন সাহেব; মধ্যদুপুর চলছে, চলুন হাঁটি।
চলো। আচ্ছা একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, তুমি আমাকে স্যার বলছো না কেনো?
আমি হেসে বললামঃ স্যার, আমি আপনাকে স্যার বলেই ডাকছি।
স্যার অবাক হলেন! তাইতো, একটু আগেও কি স্যার বলেছো?
জি হুমায়ুন সাহেব, একটু আগেও আমি আপনাকে স্যার বলেই ডেকেছি।
হুমায়ুন স্যারকে দিধান্বিত লাগছে। ভ্রুঁ কুচকে আমাকে দেখছেন, বললেনঃ তোমার হলুদ পাঞ্জাবী কোথায়?
আমি হাসিমুখে বললামঃ নেই, পড়িনা।
তুমি কি করো?
স্যার; আমি সন্ন্যাসী, উন্মাদ সন্ন্যাসী।
সন্ন্যাসী হলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও, একটা কচ্ছপ যেখানে ৫০০ বছর বাঁচে সেখানে মানুষের আয়ু এতো কম কেনো?
আমি বললামঃ তার আগে বলুন, আপনি কি ৫০০ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন?
স্যার বললেনঃ হ্যা, অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেছে।
আমি বললামঃ জি না স্যার, কিছুই বাকি রয়ে যায়নি। দীর্ঘ ৪ দশকের সাহিত্য জীবনে আপনার যতটুকু দেবার কথা, ততটুকুই দিয়েছেন। যদি ৫০০ বছর বাঁচতেন তবে আপনার ৪ দশকের সাহিত্য রচিত হতো ৫০০ বছরের দীর্ঘ সময় নিয়ে, সৃষ্টিগুলো পেতো কচ্ছপ গতী। মানুষ নিশ্চিন্ত থাকতো এই ভেবে যে, আমাদের একজন হুমায়ুন আহমেদ আছে যিনি ৫০০ বছর বাঁচবেন।
তারমানে তুমি বলতে চাইছো যে সৃষ্টির গুরুত্ব বুঝাতে স্রষ্টার অনুপস্থিতি জরুরি?
জি স্যার, তাছাড়া ভালোবাসা বুঝতে হলেও অনুপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।
স্যার মাথা দোলালেনঃ ঠিক বলেছো। আচ্ছা চলো তো, আরেকবার মেলা থেকে ঘুরে আসি।
মেলার খোলা গেটের সামনে হুমায়ুন স্যার এর সাথে দাড়িয়ে আছি, তিনি অবাক চোখে মেলার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে বিষন্ন লাগছে, বললেনঃ সন্ন্যাসী, এরা এগুলো কি করছে?
আমি বললামঃ হুমায়ুন সাহিত্য ঘিরে হিমু মেলা পালন করছে।
তিনি বললেনঃ তাহলে মিসির আলি বাদ পড়লো কেনো?
আমি বললামঃ কারন মিসির সাহেব হলুদ পাঞ্জাবী পড়েনা।
স্যার বিষন্ন ভঙ্গিতে বললেনঃ এরাতো দেখছি আমাকে নিয়ে বিরাট কচলা-কচলি করছে, আমি মানা করেছিলাম। এতো কচলালে তো লেবু তিতা হয়ে যাবে, তিতা লেবু বাজারে চলবে না।
আমি বললামঃ চলবে। পাবলিক যখন আসল লেবু পাবেনা, তখন তারা তিতা লেবুই খাবে। আমরা হবো তিতা লেবুর সমাজ...
স্যার অবাক চোখে স্টেজ এর দিকে তাকিয়ে আছেন। স্টেজে দুজন ছেলে-মেয়ে দেখা যাচ্ছে। একজন হিমু সেঁজেছে; তার গায়ে বাসন্তি রঙের ওপর কালো ষ্ট্রেইপ এর পাঞ্জাবী, মাথায় একটা হলুদ কাপড় বাঁধা; চোখে গাড় রঙের সানগ্লাস। মেয়েটার গায়ে নীল রঙের জামদানী শাড়ি, এতো দূর থেকেও ঠোঁটের টকটকে লাল লিপষ্টিক দেখা যাচ্ছে। দুজনকেই বেশ হাসিখুশি লাগছে; ছেলেটা মেয়েটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো, শুনে মেয়েটা হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।
দুরে কোথাও গান বাজছে, "ও কারিগর; দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়...।" স্যার এর দিকে তাকালাম, তিনি কাঁদছেন। মনে মনে বললামঃ কাঁদুন স্যার; বড্ড ভুল করে ফেলেছেন, তাই আজ আপনার কাঁদা উচিত।
স্যারকে একা একা কাঁদতে দিয়ে আমি আবারও পথে নামলাম। বিষন্ন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে মধ্যদুপুরের আকাশ, চারিদিকে এক অদ্ভুত হাহাকার। নির্জনতার মাঝে নিজের ছায়া খুঁজছি, পাচ্ছি না। সন্ন্যাসীদের ছায়া পড়েনা. . .
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:১১