পৃথিবীর আদিমতম সঙ্গীতকার ছিলেন দেবতারা, দেবতাদের পরেই ছিল কয়েকজন মরণশীল মানুষ যারা সঙ্গীতকলায় পারদর্শিতা দেখিয়ে প্রায় দেবতুল্য হয়ে উঠেছিল । এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ছিলেন অর্ফিয়াস, মায়ের দিক দিয়ে অবশ্য দেবত্বের কিছুটা অংশীদার ছিল সে; তার মা ছিল মিউজদের একজন, পিতা ছিল থ্রেস দেশীয় রাজকুমার । গ্রীকের লোকদের মধ্যে থ্রেসীয়রা ছিল সর্বাধিক গীতপ্রিয় । দেবতারা ছাড়া অর্ফিয়াসের আর কোনো প্রতিদ্বন্দী ছিল না কোথাও, তার বাঁশী এবং গানের অসাধ্য কোনো কাজ ছিল না; কোনো মানুষ বা অন্য কিছুর সাধ্য ছিল না তাকে দমাতে পারে । অর্ফিয়াস বাঁশী বাজাতে বাজাতে যেতেন, আর জড় ও জীব সবাই তার পেছন পেছন যেত । তিনি পাহাড়ের পাথর সরাতে পারতেন, নদীর গতিপথ পর্যন্ত পাল্টে দিতে পারতেন ।
অর্ফিয়াস ও ইউরোডিসি এর বিয়ে >> সঙ্গীতের থেকেও অর্ফিয়াস বেশি বিখ্যাত তার বিয়ের জন্যে, ইউরিডিসি এর সাথে সেই বিয়োগান্তক বিয়ের কাহিনী তাকে অমর করেছে । ইউরোডিসি নামের মেয়েটির সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল অর্ফিয়াসের, রোমান কবি ভার্জিল এর কাহিনীতে তার কোনো স্পষ্ট বর্ণনা নেই । তাদের বিয়ে হলো, একটি প্রেমের সার্থক পরিণতী ঘটল ।
হ্যা, বিয়ে হল ঠিকই; কিন্তু দাম্পত্যসুখ টিকলো না বেশি দিন । বিয়ের রাতে কনে ইউরোডিসি সখীদের সাথে বাগানে হাঁটছিল, এক সাপ কামড়ে দিল তাকে এবং সে মারা গেল । অর্ফিয়াসের দুঃখের সীমা রইল না, পত্নী বিয়োগের ব্যথা অসহ্য বোধ হল তার । সে স্থির করলো, পাতালে মৃত্যুপূরীতে যাবে সে এবং গানের সুরে মৃত্যুপুরীর রাজাকে ভুলিয়ে ইউরোডিসিকে ফিরিয়ে আনবে ।
পাতালপূরীর ভয়াল যাত্রায় পা রাখলো অর্ফিয়াস, রোমান কবি ওভিড এর মতে; প্রেমের জন্য মর্ত্যের আর কোন মানুষ এতটা বিপদসংকুল পথে যাত্রা করেনি আর কখনো । অর্ফিয়াস বাঁশিতে সুর তুললেন, সেই সুরে সমগ্র চরাচর স্তব্ধ হয়ে গেল । তিন মাথাওয়ালা প্রহরী-কুকুর পথ ছেড়ে দিল পাতালের; ইক্সিয়নের নিরন্তর ঘূর্ণ্যমান চাকা থেমে গেল, সিসিফাস তার পাথর ঠেলার কর্ম ভুলে বসে পড়লো পাথরের উপর; ট্যাটটালাস ভুলে গেল তার অনিবারণযোগ্য তৃঞ্চার কথা । গান শুনে এই প্রথম পাতালের ভয়ংকর পিশাচদের চোখেও জল এল, হেডিসের রাজা প্লুটো ও তার পত্নী পার্সিফনী মুগ্ধ হয়ে শুনলেন অর্ফিয়াসের গান । অর্ফিয়াসের কন্ঠস্বর শুনলে তার আবেদন কেউ অগ্রাহ্য করতে পারত না; প্লুটো ডেকে পাঠালেন ইউরিডিসিকে, প্রত্যর্পণ করলেন অর্ফিয়াসের হাতে । কিন্তু দিলেন একটি শর্ত >> ইউরিডিসি তার পেছন পেছন আসবে, কিন্তু উপরের পৃথিবীতে না পৌছা পর্যন্ত অর্ফিয়াস পেছন ফিরে তাকাতে পারবে না ইউরিডিসির দিকে ।
দুজন যাত্রা করলো পৃথিবীর দিকে, হেডিসের বিশাল তোরণ পেরিয়ে চড়াই পথ ডিঙিয়ে চলল তারা । অর্ফিয়াস জানত তার স্ত্রী আসছে পেছনে কিন্তু তবু একবার পেছন দেখে নিশ্চিত হওয়ার অদম্য ইচ্ছা হল তার, ইতিমধ্যে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে, আনন্দিত মনে দিনের আলোর চত্বরে পা রাখলো অর্ফিয়াস । এবং; ফিরে তাকাল পেছনে ।
ইউরিডিসি তখনও অন্ধকার গুহা পার হয়নি; আধো আলো আধো অন্ধকারে ইউরিডিসিকে দেখল সে, হাত বাড়িয়ে দিল ধরার জন্যে । কিন্তু সেই মুহূর্তে অন্তর্হিত হল ইউরিডিসি, অন্ধকারে তলিয়ে গেল সে; অর্ফিয়াস শুধু শুনতে পেল প্রিয়তমা পত্নীর ক্ষীন কন্ঠে বলা "বিদায় ।"
অর্ফিয়াস প্রাণপণে চেষ্টা করলো ইউরোডিসিকে অনুসরন করতে, কিন্তু তার অনুমতি পেল না; মর্ত্যের মানুষকে দ্বিতীয়বার হেডিসে ঢুকতে দিতে দেবতারা রাজি হল না ।
অর্ফিয়াস এর মৃত্যু >> অর্ফিয়াস মানুষের সঙ্গ পরিত্যাগ করলো । থ্রেস এর গহীন বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগল সে, তার দুঃখের একমাত্র সঙ্গী তার বাঁশিটি । তার করুণ সুরে ঝুড়ে ঝুড়ে কাঁদল বনস্থলী, পাহাড় ও প্রাণকুল । অবশেষে একদিন ঘটল আরেক দুর্ঘটনা, পথবিবাগী অর্ফিয়াস সামনে পড়ল একদল উন্মত্ত মীনাড এর । এরা রক্তপিপাসী, মত্ত ডিওনিসুস-ভক্তের দল । সর্বকারের শ্রেষ্ঠ গীতকার অর্ফিয়াসকে তারা হত্যা করল, প্রতিটি অঙ্গ আলাদা করল শরীর থেকে এবং ছিন্ন মুণ্ডি ফেলে দিল খরস্রোতা নদী হেব্রাস-এ । ভেসে ভেসে সে মস্তক চলে এল নদীর মোহনায় লেসবীয় তীরভূমিতে । মিউজরা সেটি পেয়ে দ্বীপের অভয়ারণ্যে সমাহিত করল, অর্ফিয়াসের হাড়গোড় সংগ্রহ করে তারা কবর দিল অলিম্পাস পর্বতের পাদদেশে । আজকের দিনেও, এই অরণ্যের নাইটিঙ্গেলরা পৃথিবীর অন্য যেকোনো স্থানের নাইটিঙ্গেলদের চেয়ে মধুরতর স্বরে গান গায়. . .
বিঃ দ্রঃ >> সম্পূর্ণ পোষ্টটি মোবাইল থেকে লিখিত, অনিচ্ছাকৃত ভুল-ক্রটির জন্যে ব্লগার αζρ ক্ষমাপ্রার্থি; ধন্যবাদ. . .
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৩০