২/
Ñযতদূর দেখেছি বুঝতে পারছি বাড়িটি নিশ্চিদ্র নিরাপদ। আচ্ছা, ইতিপূর্বে বাড়িতে এমন কোন ঘটনা কি ঘটেছে যে গতরাতের ঘটনাটার কারণ হতে পারে?
কাকা কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,‘ সে রকম একটা সন্দেহ তো হতেই পারে!’
Ñ কি রকম?
Ñ সে তো প্রণয় নিজেও জানে। দিন পনের পূর্বে উর্মীর বিয়ের দিনে একটা অপ্রত্যাশীত ব্যপার ঘটেছিল।
Ñ হঠাৎ যেন ডর্ব নিদারুন হতাশ হয়ে গেল। মনে হল কাকার এই কথায় ডর্বের সমস্ত সংগ্রহই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বজ্রকঠিন ডর্বের গলাটা অন্যরকম শোনালÑ‘ তার মানে উর্মী বিবাহিত?’
Ñকাকা দ্রুত মাথা নাড়লেন,‘ উ হু, বিয়ে হয়নি। আসলে হতে দেওয়া হয়নি!
Ñতার মানে?
কাকা আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন,‘ প্রণয় তুমি বল’।
আমি ডর্বকে বললাম,‘ ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত। বিয়ের সমস্ত কাজ ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু পুলিশি বাধায় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি!
Ñকেন, বিয়েতে পুলিশি বাধা আসবে কেন? নিশ্চই অবৈধ কিছু উপস্থিত ছিল?
Ñআইনের দৃষ্টিতে তাই বটে। উর্মী এখনো মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়নি-সে দিক থেকে তার স্কুলের রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত বয়স্কের সার্টিফাই করে না। তবে তার প্রকৃত বয়স আঠারোর্ধ্ব কিন্তু স্কুলে দুই বছর কম দেখিয়ে এন্ট্রি করা হয়েছিল। তাই তার বিয়েতে বিবাহ আইন বাধা হয়ে দাড়াল। ফলতঃ বিয়েটা হয়নি।
ডর্ব খানিকটা নিরব থেকে কিছু ভেবে নিয়ে ফের প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, উর্মীর কি এই বিয়েতে মত ছিল?’ তার জিজ্ঞাসু চোখ আমার দিকে স্থির হল।
Ñনা, সে ব্যপারে আমরা কেউ তার মতামতের কথা অতটা ভাবিনি।
Ñবিয়ের বিষয়েতো সাধারনত কেউ পুলিশকে ইনফর্ম করে না। অন্ততঃ এদেশের প্রেক্ষাপটে এরকম বিয়েতো হরহামেশাই হচ্ছে, তাহলে পুলিশ কি করে জানল যে অপ্রাপ্ত বয়সের উর্মীর বিয়ে হচ্ছে? ব্যপারটায় কেমন যেন একটু খটকা লাগছেনা?
Ñতা আমরা কেউ বলতে পারবনা। এ ব্যপারে পুলিশের কাছ থেকেও আশানুরোপ কোন উত্তর পাইনি। শুধু এইটুকু জানতে পেরেছি যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর সম্বলিত একটা অভিযোগ পত্রের উপর ভিত্তি করে তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন। পরে জানতে পেরেছি যে উর্মী নিজেই এই বিয়ে ভাঙ্গার ব্যপারে তার সহপাঠীদের সহযোগীতায় চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছিল!
তাজ্জব ব্যপার! তখনো কি জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করনি যে উর্মীর নিজস্ব কোন পছন্দ আছে কি না? আশ্চর্য!
ডর্ব সোফা ছেড়ে ওঠতে ওঠতে আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করল,‘ প্রণয়, নিজের নামটাই কেবল জবরদস্তু করে তুললে, মূল্যবোধ কিছু নয়!’ চল এখানে আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। বাড়ির মালির সাথে একটু কথা বলে আসি।
আমি ডর্বকে নিয়ে আমার কামরায় আসলাম এবং বাড়ির মালিকে ডেকে পাঠালাম। মালিকে ডর্ব কয়েকটি প্রশ্ন করেই ছেড়ে দিল। তার মুখের দিকে চেয়েই বুঝতে পারলাম মালির কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্ধার করতে পারেনি।
মালি বেরিয়ে যাওয়ার পর ডর্ব আমাকে বলল,‘ প্রণয়, ভেবেছিলাম জালটা গুটিয়ে এনেছি কিন্তু মালি আমাকে একেবারেই হতাশ করল। এখন দেখছি অন্ধকারে ঢিল ছুড়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। তবেÑ’ সত্যিই ডর্বকে হাল ভাঙ্গা নাবিকের মত দিশেহারা দেখাচ্ছিল।
‘তবে কি?’ আমি ব্যস্ত হয়ে ডর্বের দিকে তাকালাম।
Ñ‘যতদূর অনুমান করতে পেরেছি-আমার মনে হয় সবাই যা ভাবছে ঘটনাটা আসলে তা নয়। আই মিন, খুনোখুনির বলে আমি মেনে নিতে পারছিনা! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা একটা পরিকল্পিত পালায়ন! বিষ্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গেল। এ কি করে সম্ভব? বাড়ির প্রতিটা গেট যথাযথ ভাবে আটকানো, মেঝে বা ছাদের দিক দিয়ে এমন কোন ফাঁক ফোঁকর নেই যে মানুষ কেন একটা হাত গলানো যায়। কাঠের দেয়াল গুলোরও এক বিন্দু বিচ্যুতি নেই। ডর্বের এই মন্তব্যটা আমি মনের দিক থেকে কোন ভাবেই গ্রহণ করতে পারলামনা। তবে মনে মনে এও ভাবছিলাম এ ধরনের মানুষের মন্তব্য অকাট্য।
এমন সময় বহির্বাড়িতে গড়গড় শব্দ করে একটা পুলিশ ভ্যান এসে থামল। আমি ডর্বকে জানালে সে আমাকে বলল,‘ তাঁদের তদন্তে তোমাদের সাহায্য করা কর্তব্য। কিছু মনে করোনা প্রণয়, আমাকে এখন আমার অর্জিত সূত্রগুলোকে একটু নাড়াছাড়া করে দেখতে হবে। তাই তোমাকে একলাই পুলিশকে সময় দিতে হবে। তাঁরা হয়তো এর একটা কূল-কিনারা করতে পারবেন।
অগত্যা আমি ডর্বকে ঘরে একা রেখে বেরিয়ে এলাম। সুঠামদেহী পুলিশ অফিসারের চেহারায় আভিজাত্য আছে। চোয়াল শক্ত, গম্ভীর মুখভঙ্গী, তীক্ষè চাহনী, প্রতিটি পদক্ষেপ হিসেবী। আমিই এগিয়ে গিয়ে তাঁদের স্পটে নিয়ে গেলাম। পুলিশ অফিসার দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেলেন। মগ্ন হয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে তাঁর নোটবুকে নোট নিলেন এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে লাশ নয় ঘরটারই একটা সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করলেন। বলা বাহুল্য যে তিনি প্রথমেই উর্মীর বিয়ের ঘটনারই জের টানলেন। উল্লেখ্য গত দিন পনের আগে তিনিই উর্মীর বিয়েতে বিবাহ আইনের প্রয়োগ দেখিয়েছিলেন। কাকাকে তিনি আশ্বস্তও করলেন এই বলে যে, ‘ বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়াতে ঐদিন বরপক্ষরা চরম অপমান বোধ করে। এরপর বর চোকরা জেদের বশে ফন্দি আঁটতে থাকে কিভাবে এর শোধ নেওয়া যায়। যার ফলশ্র“তিতে স্বদলবলে গভীর রাতে হানা দিয়ে কৌশলে কার্য সিদ্ধি করতে চেয়েছে কিন্তু সেখানে দ্বিতীয় পক্ষ বাধা হওয়াতে তাকে খুন করতে বাধ্য হয় এবং লাশের অস্থিত্ব বিনাশ করতেই গুম করে ফেলে। চিন্তুা করবেন না তদন্ত ভার যখন আমাকে দেওয়া হয়েছে, আশা করছি সন্তুষ্টজনক একটা ফলাফল অচিরেই দিতে পারব।’
কাকা পুলিশের এই মুখরোচর গল্প মেনে নিতে পারলেও আমি পারিনি। বললাম,‘ স্বদলবলে যদি হানা দিয়েই থাকে হন্তকরা, তবে নিশ্চই তাদেরকে ঘরে ঢুকতে হয়েছে? তাছাড়া ঘরেতো নিহত ছাড়া আর কারো উপস্থিতির সূত্র আপনারা তৈরী করতে পারেননি?
পুলিশ অফিসার সোফায় একটু নড়ে চড়ে বসে বললেন,‘ তা এক রকম ঠিক বলেছেন। কিন্তু অপরাধীরা তাদের অপরাধ মিথ্যে প্রমাণ করতে দূর্লভ অথচ পরিচ্ছন্ন পথ আবিষ্কার না করে এমন জঘন্য কাজে হাত দেয় না, সে কথাটাও মাথায় রাখতে হবে! সে পথটি না হয় সময় হলে অপরাধীর মুখ থেকেই শোনা যাবে। বাই দ্যা ওয়ে, এবার আমি ওঠলাম! থানায় একটা ডায়েরী করতে হবে, দুপুর নাগাদ আপনি একবার থানায় আসবেন।’ কাকাকে এই কথা বলে তিনি ওঠে দাড়ালেন। আমি আমার কৌতূহল কোন ভাবেই নিভৃত করতে পারছিনা ‘Ñ তবে কি আপনারা তথাকথিত উর্মীর ভাবী বরকেই গ্রেফতার করছেন?
পুলিশ অফিসার সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,‘ দেখা যাক কিসে কি হয়!’
বাড়ি থেকে পুলিশ বিদায় হলে আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম। একি আশ্চর্য ! ডর্ব শো-পিসের চিরকূট থেকে নোট নেওয়া দূর্বোধ্য শব্দগুলোকে নিয়ে একটা প্রশস্ত সাদা কাগজে আঁকিবুকি করছে। আমাকে শান্ত থাকতে বলে গভীর ধ্যায়ানে আঁকজোক করতে লাগল। আমি অগত্যা তার পাশে বসে নির্বিকার হয়ে তা দেখে যেতে লাগলাম। দীর্ঘক্ষণ বাছবিচার, উলটপালট,নিরীক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আমার দিকে তাকাল।
দেখলাম তার মুখটা ক্রমশঃই উজ্জ্বল হয়ে ওঠছে। আমাকে একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বলল,‘ রহস্যের মূল সূত্র হাতের কাছে ঝুলছে, অল্পের জন্য নাগাল পাচ্ছিনা, মুষ্ঠিগত করতে আরেকটু বেগ আমাকে পোহাতেই হবে। আচ্ছা তুমি কোন কলেজ থেকে যেন উচ্চ মাধ্যমিক নিয়েছিলে বলেছিলে না?’ আচমকা আমাকে জিজ্ঞেস করল।
Ñহ্যা, বিদুনাথ বয়েজ কলেজ থেকে। কিন্তু কেন? হঠাৎ একথাÑ
Ñতোমার স্মৃতি জড়ানো এই কলেজটা আমার একটু দেখা দরকার!
ডর্বের এমন অভিপ্রায়কে আমি সাধুবাদ জানাতে পারলাম না। আমি যে রীতিমতো তার কথায় বিরক্তিবোধ করছি হয়তো ডর্বের দৃষ্টি এড়ায়নি। সে আমার কাঁধে মৃদু একটা চাপর দিয়ে বলল,‘ বিরক্ত হচ্ছ কেন বন্ধু, গত দু’এক দিনের মধ্যেই হয়তো ওখানে রক্তদান কর্মসূচী হয়েছিল! একাই যেতে পারতাম,ভাবলাম কলেজটা তোমার চেনাজানা তাই তোমাকে সাথে নিলে তেমন বেগ পেতে হবেনা।’
আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে ডর্বের দিকে চেয়ে থাকলাম। আমার মুখ দিয়ে সহজে কথা সরছিল না। জোর করে বললাম,‘ওখানে রক্তদান কর্মসূচী হয়েছে তা তুমি কি করে জানলে?’
ডর্ব কোন কথা না বলে কচি আমের ভেতর পাওয়া চিরকূটার প্রতিলিপিটা আমার হাতে দিল। আমি চোখ বুলিয়ে এর পাঠোদ্ধার করতে পারলাম না।
‘কর্মসূচিটার কথা এখানে লেখা আছে’ ডর্ব আমাকে সাহায্যের চেষ্ঠা করল।
বুঝলাম সময় নষ্ট না করে তাকে নিয়ে চলাই উত্তম।
ডর্বকে নিয়ে কলেজে হাজির হলাম। প্রিন্সিপাল স্যারের যে আমি কেবল স্নেহধন্য ছাত্র ছিলাম তা নয় তাঁর সাথে বাবারও বেশ অন্তরঙ্গতা আছে। সুতরাং পি জি ডর্বের মনষ্কামনা পূর্ণ করাটা সহজ সাধ্যই হল। ডর্বের সাথে স্যারের পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি আমাদের আসন গ্রহণ করতে বললেন। ডর্ব বান বণিতা না করে সারাসরি কাজে হাত দিলÑ ‘স্যার, আপনার কলেজেতো স¤প্রতি একটা রক্তদান কর্মসূচী হয়েছে?’
‘হ্যা, গতকালই মেডিকেল টিমের সহযোগিতায় সম্ভব হল।’ স্যার বললেন।
‘এই কর্মসূচীতে রক্তদানকারীদের লিষ্টটা একনজর দেখতেই আপনাকে বিরক্ত করতে আসা?’ ডর্ব সবিনয় অনুরোধ করল।
স্যার আমার দিকে তাকালেন। আমি স্যারকে যতটা সম্ভব ঘটনাটা খুলে বললাম। স্যার আমার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে নিজের ডেস্কের ড্রয়ার থেকে ফাইলটা বের করে দিলেন।
ডর্ব ফাইলটা নিয়ে একাগ্রচিত্তে জহুরির দৃষ্টি বুলাতে লাগল। ভাল করে দেখা শেষ করে কয়েকজনের নাম, বয়স, লিঙ্গ, রক্তের গ্র“প ইত্যাদি নোট করল। ‘দেখলাম ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে তিন জনের টিম এসেছিল। তার মধ্যে একজন এ্যাটোনমি সার্জন, আর একজন মেয়ে এবং অন্যজন ছেলে। তারা দুজনই শিক্ষার্থী আর বাকি কয়েকজন সহযোগীÑ সম্ভবত আপনার কলেজের ছাত্র?’ ডর্বের জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি স্যারের দিকে।
স্যার বললেন, ‘হ্যা, ওদের সবারই ভবিষত ইচ্ছে চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করবে।’
পরে স্যারকে কতজ্ঞতার স্বরে অভিবাদন জানিয়ে ফাইলটা ফিরিয়ে দিল। ‘আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। এবার তাহলে আমরা আসতে পারি স্যার?’
‘নিশ্চই, আশাকরি তোমরা সফল হবে।’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি।
কলেজের চত্বর পেরিয়ে ডর্ব মুঠোফোনে একটা কল সারল। লাইনটা কেটে দিয়ে পকেট বুকে কি সব নোট নিল।
ডর্ব ড্রাইভ করছে। আমি তার পাশের সিটে বসে আছি। হঠাৎ মৌনতা ভেঙ্গে সে বলল,‘ এবার একটা গ্রামকে খোঁজে পেতে সাহায্য করতে হবে আমাকে। জানইতো তোমাদের এই এলাকাটা সম্বন্ধে তেমন চেনাজানা নেই আমার। থানা এবং ইউনিয়ন তোমাদেরই, যদি বারুই গ্রামটা তোমার চেনা থাকে তো সে দিকেই রাস্তার দিক নির্দেশনা দিও।’
আমি তাড়াতাড়ি বলে ওঠলাম,‘ বারুই গ্রাম! সেখানেতো রথের মেলা বসে প্রতি বছর। বেশি দূরে নয়, এখান থেকে কিলো বিশেক হবে।’
Ñতবে আর চিন্তা কি, সেখানেই হয়তো তোমার স্নেহের চাচাত বোন উর্মীকে আবিষ্কারের মূল হোতাকে পাওয়া যাবে!
আমি ভিতরে ভিতরে রাগে গড়গড় করতে লাগলাম। ডর্ব এখন হয় আমাকে প্রবোধ দিচ্ছে নয়তো ঘটনাটা নিয়ে খামখেয়ালী করছে। কোন কথা বললামনা। চোখ বন্ধ করে গলায় ওঠে আসা একটা কঠিন কথা ফিরতি পথে পেটে পাঠালাম। এবং নির্বাক থেকেই কেবল আঙ্গুলের ইশারায় রাস্তা বাতলে গেলাম। আধঘন্টার মধ্যেই বারুই গ্রামের বিরাটাকার মঠ মন্দিরটার পাশ কেটে গ্রামটার মাঝামাঝি রাস্তার উপর গাড়িটা থামাল ডর্ব। পথচারী একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,‘ সাগর কান্ত গুহদের বাড়িটা কোন দিকে?’
পথচারী হাত উঁিচয়ে একটা গৃহস্থ বাড়ি দেখিয়ে দিল। রাস্তাটাকে সামনে রেখেই বাড়িটা। বাড়ির দেউড়ির কাছে দু’টি আট-নয় বছর বয়সের ছেলে-মেয়ে গ্রাম্য খেলায় মত্ত। আমাদের দেখে ওদের মনোযোগ টুটল। একবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে পরক্ষণেই গাড়ির দিকে। ডর্ব ওদের উদ্দেশ্য করে মোলায়েম গলায় বলল,‘ বাড়িতে গিয়ে বল, মেহমান এসেছে ঢাকা থেকে’!
বাচ্চা দুটি পলকেই বাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটু পরেই শান্ত, সৌম্য, ধবধবে ফর্সা আকর্ষণীয় চেহারার এক টগবগে যুবক এসে আমাদের সামনে হাজির হল। তার দৃষ্টি আমাদেরকে চেনার জন্য জিজ্ঞাসু হয়ে আছে।
ডর্ব দুকদম এগিয়ে গিয়ে বলল,‘ আমরা সাগর কান্ত গুহ’র সাথে দেখা করতে এসেছি।’
যুবক একটু যেন বিচলিত হল,‘ আপনাদের ঠিক Ñ’।
Ñ‘চিনতে পারলেন না তো? সে হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চই সাগর কান্ত গুহ?’
Ñ‘জি, হ্যা, কিন্তুÑ’ ওর কথার স্বর কেমন যেন কেঁপে ওঠল।
Ñ‘এভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়েই পরিচয় নেবেন না কি একটু বসতে বলবেন?
Ñ‘নিশ্চই। আসুন ভেতরে আসুন।’ যতটা লজ্জিত দেখাল তার চেয়েও বেশি আত্মমগ্ন দেখাল সাগরকে। বোধকরি ভেতরে ভেতরে অনেকটা ঘাবড়ে গেছে।
আমরা তার ড্রইং রুমে বসলাম মুখোমুখি হয়ে। বান-বণিতার লক্ষণ পূর্বেও যেমন ডর্বের আচরণে দেখিনি এখানেও তার কোন কারণ ছিলনা। সরাসরি কাজে হাত দিতেই পছন্দ করে সে, তাই ঝটপট ডর্ব আমাকেই আগে উপস্থাপন করল। হয়তো এখানে আমাকে উপস্থাপন করা সমীচিন মনে হয়েছেÑ ‘ওর নাম প্রণয়, আমার বন্ধু আর আপনার কাছে যার বড় পরিচয় হল উর্মীর চাচাত ভাই!’
দেখলাম সুডৌল চেহারার যুবকটির চোখ দুটি সন্দেহে ঈষৎ চমকে ওঠল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের অসতর্কতা কাটিয়ে মৃদু হেসে বলল,‘তাহলে আপনারা বোধহয় কোথাও ভুল করছেন।’
‘ওকে, দেখুনতো আমার পরিচয়টা আপনি পড়তে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।’ (২ি১,৮ি,১৩,২র্৩ ১৬,১ে১া,৩্রা,১৬া,২৭) যার মানে ‘‘পি জি ডর্ব ফটোগ্রাফার’’ এমন লেখার ছোট্ট চিরকূটা ডর্ব ওর দিকে এগিয়ে ধরল।
হাত বাড়িয়ে চিরকূটটি নিল সাগর কান্ত এবং পড়তেই তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্ফুটে তার গলা থেকে বেরুল ‘অসম্ভব’!
ডর্ব তার গলার স্বরটাকেই খপ করে ধরে ফেলে বলল,‘ দুঃসাধ্য বটে কিন্তু অসম্ভব নয়! আমি আপনাদের ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছি। এখন নিজেকে বিদঘুটে বিপদের মধ্যে না জড়াতে চাইলে সরল স্বীকারোক্তি আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারে। তা না হলে সমস্ত ব্যপারটাই আইনের হাতে হস্তান্তর করব! আমরা উর্মীর সঙ্গে দেখা করব, আশাকরি আপনি আমদের সাহায্য করবেন Ñ বুঝতেই পারছেন এতদূর যেহেতু আবিষ্কার করতে পেরেছি এখন উর্মীকে আমাদের সামনে হাজির না করলেও নিজেকে আইনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না। কারণ উর্মীকে দেওয়া এতগুলো চিরকূটের মধ্যে আপনাদের প্রেমের গভীর স্বাক্ষর আছে, এছাড়া স¤প্রতি এই (২৭,১ত,১৬া,২০ ১,২র্৫,৩১ূ,৬ী,১ে৬ অ,৩১,৩থ২ি৩,১৮ু,২০া,২০থ২৭া,১ে৬ ১ৈ৬,২৭ী ২ে৮,১ো) যার মানে ‘‘রক্তদান কর্মসূচীতে আসছিÑ বিদুনাথÑরাতে তৈরী থেকো’’ যে বার্তাটি আমের ভিতর লুকিয়ে প্রেরণ করেছেন সেটাতে আপনার উপস্থিতি অকাট্যভাবে প্রমাণ করবে।’ তাছাড়া ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন সে কথাটি সহ আরো অনেক কথাই একই ভাষায় প্রেমিকার কাছে ব্যক্ত করেছেন। আপনি চাইলে প্রতিটির তর্জমা আপনাকে দিতে পারি। তবে হ্যা, বলতে পারেন, এগুলো যে আপনি লিখেছেন এর প্রমাণ কি? সেটা অবশ্য আপনি নিজেই প্রতিটি চিরকূটে রেখেছেন ংশম সংকেতটি লিখে। এর একটি জ্যান্ত প্রমাণও আমাদের চোখের সামনে আপনার গায়ে সেঁটে আছে। আপনার গায়ে জড়ানো যে শার্টটি আছে তার কলারে ংশম মনোগ্রামটা করে বোধ করি উর্মী আপনাকে গিফট করেছে!’
স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন সাগরের ঘাড়টা ঘুরে চোখ শার্টের কলারের মনোগ্রামটা দেখে নিয়ে দৃষ্টি ডর্বে দিকে স্থির হয়ে গেল। আমাদের দিকে স্থব্দ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই সাগর কান্ত গুহ’র চোখ হঠাৎ জলে ঝাপসা হয়ে গেল। ভাঙ্গা গলায় বলল,‘ আপনাদের কাছে লুকানোর আর কিছু নেই! কিন্তু আমি তাকে এসব করতে মানা করেছিলাম!’ যেন নিজেকে শোনাল কথাগুলো।
সাগর কান্ত গুহ যখন আমাদের সাথে গাড়ীতে ওঠে বসল তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গেছে। তার কথা অনুযায়ী গন্তব্যের রাস্তা আমাদের দু’ঘন্টার। ডর্ব সাচ্ছন্দ্যের সাথে ড্রাইভ করে চলল। আমি আর সাগর পাশাপাশি বসেছিলাম কিন্তু কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছিনা। ও আত্মমগ্ন হয়ে মাথা হেট করে বসেছিল।
যখন শহরের একটা ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে এসে আমাদের গাড়ী থামল সাগর নিজেই আমাদের পথ দেখিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠতে লাগল। দুতলার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে উর্মী উদগ্রীব হয়ে হয়তো অপেক্ষা করছিল তার জন্য কিন্তু সাগরের পিছনে আমাদেরকে দেখে বিষ্ময়ে বোবা হয়ে গেল।
তার পড়নে মিষ্টি কালারের উদাও হওয়া জামাটা। উর্মীকে চোখের সামনে দেখে হঠাৎ আমি আবেগ প্রবণ হয়ে গেলাম। তাকে আমি যথার্থই স্নেহ করি। কিন্তু উর্মীর কথা শোনে বুঝতে পারলাম স্নেহের ধনও কখনো কখনো নিজের প্রতিশ্র“তির কাছে নির্মম দুঃসাহসী হতে পারে। তার কথা থেকে যা বুঝলাম তাতে সাগরকে এক প্রকার মানসিক চাপ দিয়ে তাল মিলাতে বাধ্য করা হয়েছে। সমস্ত ঘটনার নাটের গুরু উর্মী নিজেই। তবু উর্মীকে ছাড়া আমি ফিরতে চাইছিলাম না। কিন্তু ডর্বের পরামর্শে অগত্যা তাকে রেখেই ফিরতে হল। ডর্ব আমাকে বলল,‘ এখন ওকে নিয়ে গেলে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। আগে দেখি পুলিশি তদন্ত কতদূর এগিয়েছে। সব দেখে শুনে কৌশলে থানা থেকে অভিযোগটা ওঠাতে হবে তারপর নিজেদের মধ্যে ব্যপারটার বিহিত করতে হবে।’
আমি ডর্বের কথামতো তার সাথে বাড়ির দিকে রওনা হচ্ছিলাম কিন্তু এই অসম্ভব দূর্লভ রহস্য উদঘাটনের কৌশলটার কৌতূহল কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম,‘ ডর্ব এই অসম্ভকে তুমি কি করে সম্ভব করলে?
ডর্ব একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, তাহলে ওখানে বস বলছি, কোথাও গড়মিল হলে ওরা দু’জন শোধরে দিতে পারবে! ডর্বের পাশে আমি বসলাম। উর্মী আর সাগর বসল আমাদের সামনাসামনি। বস্তুত ওদের দু’জনকে মানিয়েছিল ভাল!
ডর্ব বলতে শুরু করল,‘তোমাদের সবার মনে যখন অলৌকিক, ইন্দ্রজালিক ব্যপারটা মগজে বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল তখন আমার মগজে তা বিন্দু মাত্র স্পর্শও করতে পারেনি। কারণ আমি এসব বিশ্বাস করিনা। মানুষের বিচক্ষণ বুদ্ধি আর সুচিন্তিত পরিকল্পনার কৌশল প্রয়োগই ভূতুড়ে ইন্দ্রজালিক মনে হয়। এই বিষয়টা মাথায় রেখে তীক্ষèধি একটা মগজকে প্রতিপক্ষ করে পর্যবেক্ষণ শুরু করলাম। প্রথম দিকে খুব গোলমেলে আর দূর্বোধ্য লাগলেও যখন টবের ভিতর থেকে ভাগ্যহতের রক্তমাখা জামা-কাপড় পেলাম তখনই আমার এগিয়ে চলার প্রথম ধাপটি পেলাম। কারণ হত্যাকারী লাশ গুম করার চেষ্ঠা করলে হয় কেটে টুকরো টুকরো করে প্যাক করতে হবে অন্যতায় আস্ত লাশটি বস্তাবন্দি কিংবা এই জাতীয় কিছু করে জানালা গলে নিচে নামতে হবে। এক্ষেত্রে যেমন বড় রকমের ঝুঁকি থাকে তেমনি পরিধেয় বস্ত্রগুলো অক্ষত খোলার প্রচেষ্টা হয়ে যায় অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি। তাছাড়া আস্ত মানুষটিকে মেরে ফেলার পর রক্তমাখা কাপড়গুলোর প্রতি মায়া গজিয়ে ওঠা অনভিপ্রেত। কাপড় গুলোকে তন্নতন্ন করে খোঁজেও কোথাও কাটা-ছেঁড়া পেলামনা। স্বভাবতই ধরে নিলাম এগুলো স্বইচ্ছায় পরিত্যাগ করা হয়েছে। তাই খোঁজ নিলাম তার অন্যসব কাপড় ঠিকঠাক আছে কি না। সেখানে যখন এক সেট কাপড়ের হদিশ হলনা তখন ধরে নিলাম সে গুলো পরিধান করা হয়েছে। সেটা চোখের সামনেই এখন দেখতে পাচ্ছ উর্মীর পড়নে।
শো-পিসটা নাড়চড়া করে যখন ভেতর থেকে অনেক গুলো দূর্বোধ্য ভাষার চিরকূট পেলাম তখনই এক রকম নিশ্চিত হলাম যে উর্মীর সাথে কারো অত্যন্ত গোপনীয় সম্পর্ক আছে। তা না হলে নিজস্ব এই ভাষা তৈরী করত না তারা।
অবশ্য ভাষাটা আবিষ্কার করতে আমাকে অনেক পেরেশানী পোহাতে হয়েছে। দারুন এক অভিনব কৌশল। দেখলে ঠিক যতটা অসাধ্য মনে হয় কার্যত ততটা নয়। বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ গুলোকে গাণিতিক সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছে। এবং একই উচ্চারণের কাছাকাছি দুটি বর্ণ যেখানে আছে সেখানে দ্বিতীয়টিকে ইংরেজি সংখ্যায় আর ‘‘কার’’ সহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক যুক্তবর্ণ গুলোকে যথাযথ প্রয়োগ করেছেন। স্বরবর্ণকে ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বুঝাতে চেষ্ঠা করাতেই এমন বিদঘুটে এলোমেলো হয়ে গেল চিরকূটের ভাষা। ‘ক্ষমা’ দিয়ে প্রতিটি বর্ণকে আলাদা করার প্রয়াসই আমাকে সহজ সাধ্য করেছে ভাষাটা আবিষ্কারের জন্য। তবে মাথা খাটিয়ে বর্ণগুলোকে পাশাপাশি সাঁজাতে পারলে যে কারো জন্য বিষয়টা জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মেঝেতে এক জায়গায় রক্তক্ষরণ দেখে প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। জবাই করে খুন করা হলে অজস্র রক্তবিন্দু ছিটকে যেত আর আঘাত করে হত্যা করা হলে এক স্থানে অতরক্তপাত হওয়াই অস্বাভাবিক। পায়ের গোঁড়ালী সহ সেলুয়ারের ছাপ আর বিছানার ছাদরে দুহাতে খামছে ধরার ছাপ থেকে সহজেই বুঝা যায় এগুলো তদন্তকারীকে বিব্রত করার প্রয়াস। কারণ মৃত্যু পথযাত্রী আহত মানুষ কখনোই গোটা কয়েক পরিকল্পিত সুস্পষ্ট হাত-পায়ের রক্তমাখা ছাপ রাখতে পারে না।
Ñ‘রক্তটা এল কোত্থেকে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
Ñ‘আগন্তুকের হাত বয়ে!’
Ñ‘কিন্তু দরজা, জানালতো ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, আগন্তুক ঘরে ঢুকবে কি করে? তাছাড়া ঘরে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতির আলামত তো উদ্ধার করতে পারনি?’ আমার গলায় অবিশ্বাসের স্বর।
Ñ‘অধৈর্য হচ্ছ কেন বন্ধু’Ñ ডর্ব নিজের ওভার কোটের পকেট হাতড়ে একটা ছোট্ট শিশি থেকে দানা দানা কি যেন মুখের ভিত ছুড়ে মারল। বলছি শোন, দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যায়নি কারণ বলতে পার সে মুটামুটি নিষ্ক্রিয়ই ছিল। মাত্র দু’একটি কাজে হাত লাগাতে হয়েছে, তাও তার গায়ের প্রয়োজনীয় অঙ্গ গুলো পশমের কাপড়ে আবৃত ছিল বলে কোথাও তার ছাপ পড়েনি! তোমার নিশ্চই মনে আছে যে, আমি পূব পাশের জানালার একটু উপর থেকে কাঠপোকায় খাওয়া সরু ছিদ্র থেকে একটা সুঁতা টেনে বের করেছিলাম?
আমি সাগ্রহে বললাম, ‘হ্যা!’
Ñ‘এই সুতাঁটাই ইন্দ্রজালিক ক্ষমতাধর! এই সুঁতাটার ঠিক মাঝখানটা জানালার আগড়ে আটকানো ছিল আর প্রান্ত দুটি ছিল সরু ছিদ্রপথ বেয়ে দেয়ালের বাইরে! ঠিক একই কায়দা করে ঝুলন্ত রশি পাতা হয়েছিল জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর, যার খানিকটা দাগ পড়েছে খাটের পায়ায় আর জানালার গরাদে। এই রশি বেয়েই তারা নিচে নেমে পালাতে পেরেছে। মোমটা জ্বালানো হয়েছিল কাপড় পাল্টানোর পর ঘরটাকে ভাল করে দেখে নেওয়ার জন্য। জানালা গলে বেরিয়ে আসার পর বাহির থেকে টেনে আস্তে আস্তে সুঁতার একটা প্রান্ত ছেড়ে টানার ফলে স্বাচ্ছন্দেই আগড়টা ভেতর থেকে আটকে যায়। হয় ভুল করে, নয়তো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেই এই একটুকরো সুঁতাকে সরানোর প্রয়োজন মনে হয়নি। সমস্ত কাজটায় সাগর কান্তকে সুপারি গাছে চড়তে হয় দু’বার। একবার জানালায় ঠুকা দিয়ে উর্মীকে সংকেত পাঠাতে এবং রক্তের ব্যাগ সহ ঝুল রশি দিতে আর দ্বিতীয়বার জানালাটা ভেতর থেকে আটকে দিতে। সমস্ত পরিকল্পনাই ঠিকঠাক ছিল কেবল ভুলের মধ্যে ছিল মোমটি নিভানো হয়নি আর শো-পিসের স্বাক্ষর গুলো সরানো হয়নি।
‘আমের ভেতর যে বার্তাটি ছিল, সেটা কি করে এল?’
সেটা উর্মীর হাত বয়ে সকালের দিকে এসেছে! এটাই যেহেতু শেষ দিন তাই তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে উর্মীকে যথার্থ চালাক মেয়ে বলতে হবে। মালিকে দিয়েও কখনো কখনো বাড়ির বাগানের উত্তর দিকের শেষ মাথার ঝাঁকরা মাথার পত্রনন্দন গাছটার গোড়া থেকে আম, পেঁপে,পেয়ারা আনালেও কখনো বুঝতে দেয়নি আসলে এই বস্তু গুলোর অন্তরে কি অমৃত লুকানো থাকে। মালির কখনো সখনো সন্দেহ হলেও মনিবকে ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি।
এসব ব্যপারে নিরীক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেই টের পেলাম আসল কারসাজিটা কি! ভেবেছিলাম মালির কাছ থেকেই সমাধানের সূত্রটা পাওয়া যাবে কিন্তু বেচারী আমাকে একেবারেই নিরাশ করল। হাল ছাড়লাম না আমি। তোমাকে পুলিশের সাথে উপরে পাঠিয়ে দিয়ে প্রথমেই একবার ঢু মারলাম উর্মীর তথাকথিক ভাবী বরের বাড়ি। তোমাদের চাকরকে সাথে নিয়েছিলাম। ওখানে যাওয়াটাই ভেস্তে গেল। কারো সাথেই দেখা হল না। এরপর ভাবলাম উর্মীর সেলফোনের কললিষ্টটা একবার দেখব কিন্তু চিরকূট গুলোর দূর্লভ ভাষার কাছে তা গৌণ মনে হল। কারণ ফোনালাপে যদি তাদের যোগাযোগ থাকতো তাহলে কষ্ট করে এমন বিদঘুটে ভাষা সৃষ্টির কোন মানে হয়না। চিরকূট গুলোকেই শেষ হাতিয়ার করে নিয়ে বসলাম। বলতে পার অনেকক্ষণ ধরে চেষ্ঠ-চরিত্রির পর এগুলোই কার্যোদ্ধারের মোক্ষম বস্তু হয়ে গেল। অবশেষে এর পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হলাম। রীতিমতো মেধাবী মগজধারী না হলে এরকম ভাষা সৃষ্টিও দুঃসাধ্য। স্রষ্টাকে মনে মনে তার সৃষ্টির তারিফ না করে পারলাম না। আগেই বলেছি গণিত, ইংরেজি এবং বাংলা বর্ণগুলোর মিশ্ররূপের ফসল এই ভাষা!
তার পরের সব ঘটনা জলের মত পরিষ্কার। প্রেমিক চিরকূটে দেওয়া বিবৃতি অনুযায়ী বিদুনাথ বয়েজ কলেজে গেলাম। সেখান থেকেই তোমার স্যারের সহযোগিতায় টিম এবং অংগ্রহণকারী সবার সম্বন্ধে খসরা ধারণা নিলাম। যেহেতু একটি চিরকূটে লেখা ছিল সে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে এবং সেটা গত এ্যাডমিশন টেস্টে এলাও হয়ে, তার বিদ্যাপীঠ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ। আর গতকাল বিদুনাথ বয়েজ কলেজে রক্তদান কর্মসূচীতে অংশ নিচ্ছে, এরপর লুকানো ছাপানো কিছু ছিলনা। আমার এক স্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক সার্জন। তাঁর কাছে ফোন করে বিদুনাথ কলেজের কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণকারী টিম লিডার সার্জনের ফোন নম্বর নিয়ে তাঁর কাছ থেকেই সাগর কান্ত গুহর দরকারী বায়োডাটাটা নিলাম। অন্য কেউ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা কারণ টিম লিডার সার্জন বয়স্ক মানুষ দ্বিতীয় জন শিক্ষার্থী মহিলা অন্যরা সবাই বিদুনাথের স্টুডেন্ট সুতরাং তাদেরকে বাদ দিলে একমাত্র সাগর কান্ত গুহকেই স্পষ্ট প্রতিপন্ন করা যায়। অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাগর কান্ত গুহই আমাদের সাহায্য করেছেন। এরপর আমার বলায় যতটুকু বাদ পড়েছে সেটুকু আপনার কাছ থেকেই শোনতে চাই!’ ডর্ব উর্মীর দিকে তাকাল।
উর্মী আমার চোখে এক পলক চেয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল। ডর্ব তাকে তাগিদ দিল,‘ আপনাকে বলতেই হবে, তা না হলে যে আপনাদের অভিপ্রায় অসমাপ্ত থেকে যাবে!
উর্মী বলতে সক্রিয় হল,‘ আমাদের প্রথম পরিচয় বারুই গ্রামের রথমেলায়। আমাদের স্কুলের খুব বেশি দূরে না হওয়াতে প্রতিবছরই আমরা বান্ধবীরা মিলে মেলায় যাই। সেখানেই সাগরকে ঠাকুরের রথভ্রমণের পাশে প্রথম দেখলাম। পূজারিরা যেখানে প্রসাদোৎসব করছিল সেখানে বেদীর কাছে সাগরকে পেয়ে আমি একলা চলে আসি। বান্ধবীরা আমাকে দেখেনি কারণ তার সবাই মিলে একটা কসমেটিকসের দোকানে হিড়িক দিচ্ছিল। সেখানেই তার সাথে প্রথম পরিচিত হই এবং কথার ফাঁকে তার ফোন নম্বরটি নিতে ভুল করিনি।
পরে ফোনালাপে তার সাথে আমার অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকে এবং মাঝে মধ্যেই মন্দিরের পুরোহিতের সুহৃদ্যতায় সেখানে আমাদের দেখা সাক্ষাত হতে থাকে। আমাদের সম্পর্ক যখন ধীরে ধীরে গভীর হয়ে গেল তখন আমি তাকে আমার ধর্মের কথা বলি। সাগর তখন সেখান থেকেই নদীর গতিপথ ফিরিয়ে দিতে চেষ্ঠা করল কিন্তু আমি তা হতে দিলাম না। ততদিনে সে নিজেও ফাঁদে পা দিয়েছে। তথাপি এই প্রেমের পথে প্রতিবন্ধকতা দেখে পরিণতির কথা ভেবে ভয় পেত। সে জানত যে তারা সংখ্যা লঘু সম্প্রদায় এবং ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমানদের দৃষ্টিশূল। আমি তাকে সাহস যোগাতাম বিভিন্ন আঙ্গিকে অঙ্গীকার, প্রতিশ্র“তির মাধ্যমে। আমার কথায় বিশ্বাস আর ভরসা করেই পথ চলায় ব্যপক সতর্কতা অবলম্বন করতে লাগল। ইতমধ্যে আমরা প্রেমের পথ মাস ছয়েকের মত পারি দিয়েছি। আমাদের ফোনালাপ বন্ধ করে দিল সে। ফোনালাপে নাকি আকষ্মিক বিপদের সূত্র থেকে যায়। আমরা সংযমী হলাম দুজনই। সে আবিষ্কার করল আলাপনের নিজস্ব ভাষা। আমিও রপ্ত করে নিলাম তার কাছ থেকে। এর পর ধৈর্যের মধ্য দিয়েই কেটে গেল দুবছর। এর মধ্যে সে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। সংগত কারণেই তাকে বাড়ির বাহিরে থাকতে হয়। আমাদের অপেক্ষা ছিল ও ডাক্তার হয়ে বের হলে বিয়ে করব কিন্তু কয়েকদিন আগে আমার বিয়ের ঘটনাটায় দিশেহারা হয়ে যাই। আমার কোন ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা কেউ জানতে চায় নি। অবশ্য আমার অভিপ্রায় প্রকাশ করলে কানাকড়ি মূল্য কেউ দিতও না। উপরন্তু সাগরের জীবন হয়ে ওঠত দূর্ভিসহ।
ইসলামিক পরিগন্ডিতে বেড়ে ওঠা আমাকে কেউ হিন্দুর হাতে নির্দিধায় অর্পণ করত না। নিজের মধ্যে আন্দোলিত হতে থাকি একাগ্র চিত্তে। পালিয়ে কোর্ট ম্যারিজের কথা ভাবলাম। হিসেব কষে দেখলাম এতে আমার বয়স সাপোর্ট করবেনা। তখনই দূরভিসন্ধিটা মাথায় খেলে গেল। ভাবলাম আমার বিয়ের বয়স হয়নি। সহপাঠী আর চেয়ারম্যান সাহেবের কৃপায় বিয়ের আসর ভন্ডুল হল। এযাত্রায় রেহাই পেলাম। তারপর অস্থির হয়ে ওঠলাম। দ্বিতীয়বার হয়তো এমন সুযোগ নাও মিলতে পারে। আগে পিছে আমাকেত সাগরের হাত ধরে পালাতে হবেই! মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগলাম। চিরকূট লিখে সাগরকে একই গাছের তলায় রেখে সব খোলে বললাম। সপ্তাহের শেষদিনে চিরকূট লিখে এই গাছটির গোড়ায় রাখতাম আমরা। সাগর কে চিরকূট গুলো সরবরাহ করত আমার এক বিশ্বস্ত সহপাঠী। সেদিন সাগরের চিরকূটটা আগে হাতে পাই এবং জানতে পারি সে বিদুনাথ বয়েজ কলেজে রক্তদান কর্মসূচিতে আসছে। তখন মগজে একটা কূটবুদ্ধি খেলে যায়। ঘটনাটাকে লোমহর্ষক করে তুলতেই সাগরকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে আসতে বললাম। সেটা মানুষের আর পশুপাখিরই হোক। সে আমার কথা মতো রক্ত নিয়ে এল। এখন জানি তার নিজের শরীরের রক্তের বিনিময়েই আমার শোবার ঘরটি বিভৎস করে রেখে এলাম। ভাবলাম জীবিত পালায়নের চেয়ে নিজেকে মৃত প্রমাণ করতে পারলে মৃতের প্রতি মায়া ভিন্ন সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে না। আমাদের পিছু কেউ নেবে না। খুন, গুম এসব তদন্ত নিয়ে কিছুদিন সরগরম হয়ে কোন ক্লু খোঁজে না পেয়ে একদিন শান্ত হয়ে যাবে সবকিছু।’
Ñ‘ এক্ষেত্রে আপনার তথাকথিত বরপক্ষ যে বিপদে পড়তে পারে সে কথা কি মাথায় রেখেছেন?’ ডর্ব উর্মীকে জিজ্ঞেস করল।
Ñহ্যা, আমি জানতাম তাঁরা সপরিবারে প্রবাসী এবং দিন পাঁেচক পূর্বেই তাঁরা সপরিবারে বিদেশে পারি দিয়েছেন! বর্তমানেও তাঁরা সবাই সেখানেই আছেন।’
ডর্ব আমার কাঁধে আলতো করে চাপড় দিয়ে বলল,‘ প্রণয়, চল এবার ওঠা যাক, ব্যপারটা একথলে ছেঁড়া সুঁতা নাটাইয়ে গুটানোর মতই জটিল হয়ে গেল। দেখি কতদূর কি করা যায়, কথায় বলেনা, নিজের পাগল নিজেকেই বেঁধে রাখতে হবে।’
পরক্ষণেই প্রেমিক যুগলের দিকে কঠোর দৃষ্টিপাত করে বলল,‘ আবেগহীন মানুষ মৃতের সমান জানি, আবেগ আছে বলেই তাকে লাগামছাড়া করে কৃষ্টিহীন কান্ড ঘটানো ঠিক হয়নি। আবেগকে প্রশ্রয় দেয়ার পূর্বে অন্তত তিনবার ভেবে দেখা উচিত সেটা কতটা ন্যায় সঙ্গত, সাবলীল এবং সংযত। কারণ যেকোন আলোচিত ঘটনাই পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ সংস্কৃতিতে পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। নীতিবাচক প্রভাব পূণ্যেভরা প্রেমেও নিশ্চই সাপোর্ট করেনা।