জীবনের যে নানা রঙ হয় তা মজনু ভালোই জানে। আর তা যে ধনী-গরীবের জন্য আলাদা হয় তা সে নিজের জীবন দিয়েই বুঝেছে। নিজের কাছে জীবনের রঙ বলতে শুধুই কালো আর ধূসর, শুনেছিল সবার রক্তের রঙ লাল হয় কিন্তু মূল্যহীন রক্ত লাল বা কালো তার মুল্য নেই। এইতো বছর দুয়েক আগে কোম্পানির ফ্লোরে পা পিছনে মাথা ফেটে তিনদিন বাসায় ছিল, অনুমতি ফ্যাক্টরির বসই দিয়েছিল কিন্তু বেতন তুলতে গিয়ে যখন সেই তিনদিনের হাজিরা কেটে নিল তখনই বুঝল সেই রক্তের দাম নেই। এনিয়ে চুপ থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। কলকাতায় মন টিকাতে না পেরে ৯৭এ নিজে দেশে ফিরলেও, পরিস্থিতি একবারে ভিন্ন ছিল। ব্যাবসা, দোকান সবই করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু মতির প্রভাবে কিছুই টিকেনি। দিনের আলোয় দোকান লুটের মামলা করতে গিয়ে ছয়মাস জেলও থেকেছে।
সব হারিয়ে জেল থেকে ফিরে আর কিছুই করার ছিল না, শেষে অনেক কষ্টে এই কারখানায় লোডিং লেবার এর কাজ করে। আয় বেশি না, কারণ লোডিং এর কাজ সবসময় থাকে না। একটা ঘরের কারণে বা জীবিকার টানা-পোড়নেই হোক শেষমেশ ২০১০ সালের শুরুতেই বিয়ে করে মাজেদাকে।
পরপর দুইটি বাচ্চা নষ্ট হবার পর ২০১৪ তে একটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হয়। বকুলের নামে নিজের মেয়ের নাম রেখেছে। কেননা বাকের ভাই সর্বদা বকুলের সন্মানের কথা বলত, বকুলের আতিথিয়েতার কথা বলতে গিয়ে ভাইয়ের গলা ধরে আসত। বেচে থাকতে বাকের ভাই কোনদিন মজনুকে কষ্ট পেতে দেয়নি।
মেয়েটা গত বছর থেকে সরকারি স্কুলে যেতে শুরু করেছে। লেখা-পড়ার খরচ কম, শুধু চিন্তা ওর দুরন্তপনায়। প্রতি সপ্তাহেই এক-দুইজন নালিষ দেয়, কারো কুমড়ো ফুল তোলা, রাস্তার গর্তে জমে থাকা পানিতে লাফিয়ে অন্যদের কাদা মাখানো। অনেক কষ্টে দুটো জামা কিনে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু দুই জোড়া জুতা কেনার বিলাসিতা মজনুর নেই। নতুন জামা বলতে বছরের শুরুতে একসেট স্কুল জামা আর ইদে কিছু। এছাড়া কোনমাসে বেশি মাইনে এলে মজনু রাস্তার ভ্যান থেকে মেয়ের মায়ের জন্য চুড়ি, লিপিস্টিক কেনে। কিন্তু এই বছর করোনায় ধাক্কায় অতিরিক্ত বেতন তো দুরের কথা মূল বেতনই ঝুলে আছে তাও তিন মাসের। শুনেছিল সকল গার্মেন্টস কর্মীরজন্য বেতন দিতে বিশেষ ঋণ দিয়েছে সরকার কিন্তু সেই ঋণ মজনুর কাছে আসেনি, নানা মাধ্যমে ত্রাণ ও নগদ সহায়তায় নাম দিলেও তা মতির নির্দেশে টিকেনি।
লকডাউনের পর থেকেই বেশ বেকায়দায় পড়েছিল মজনু, নগদ টাকার অভাবে পড়ে মাছ বা মুরগি কোনটাই কেনা হয়নি। প্রথমদিকে সবার
মাঝে খালি পেটে থাকতে লজ্জা হতো কিন্তু রমযান মাস আসায় সেই লজ্জা থেকে বেচে গিয়েছিল মজনু। লকডাউনে অনেকেই নিয়ম ভেঙে রাতে চায়ের দোকানে আড্ডায় গেলেও মজনু বাসাতেই থেকেছে। কিন্তু মেয়ের আবদার মেটাতে কয়েকবার হালকা ইফতার কিনে মেয়েকে খাইয়েছে। ইদের জামার বায়না দোকান বন্ধ দেখিয়ে সামলে নিয়েছিল, মাঝে মাঝে কান্না করলেও বকুল জামার কথা ভুলে চুপচাপ ছিল। তবে যেদিন থেকে ইদের মার্কেট চালু শুনে বকুলের বায়নায় আবারো কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব হাতড়িয়েও ৩২৫ টাকার বেশি কিছু পায়নি। অন্যসময় হলে কারো কাছে ঋণ নেয়া যেত কিন্তু এই সময়ে সবারই বাজে দষা।
মেয়ের বায়নার কাছে হার মেনে মজনু তার বউয়ের চুড়ি দুখানা বন্ধক দিয়ে হাজার আটেক টাকা নিয়েছে। অন্যসময় হলে এই চুড়িতেই পনেরো হাজার টাকা দিত যে কেউ কিন্তু এই দুর্যোগকালে চারজনের পর অতিকষ্টে এই মহাজনকে মানাতে পেরেছে। তাছাড়া টাকার পরিমাণ যতোকম হবে ততো দ্রুত চুড়িগুলো ছাড়াতে পারবে। এতোগুলো টাকা হাতে পেয়ে মেয়ের জামার সাথে একটি রাঙা মেহেদি হাতে বাড়ির পথে হেটে চলল মজনু।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২০ রাত ১:৪৪