আমাদের সকল ভাবনা ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ঢাকার বাইরে থেকে সকল সুবিধা একটু একটু কমতে কমতে অজপাড়াগাঁয়ে যে কি অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে তা জানা খুবই দরকার। তাহলেই নিদিষ্ট সময়ে প্রোডাক্ট বের করার ইচ্ছাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার প্রতি ঝুকত না।
বর্তমান সমাজ কেন জানি অর্থশালী ও উচ্চশিক্ষিতদের সুশীল সমাজ বলে চিহ্নিত করে। যারা এখন আর গ্রামের পথে পা মাড়ায় না। তা না হলে এতোবড় মশকরা চলার কথা নয়।
ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের একটা বড় কারণ ছিল আন্দোলনকারীদের অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবার ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছিল। যারা কোনভাবেই ভ্যাটের নামে শিক্ষা লাভের বিষয়টি যেন সাধ্যের বাইরে চলে না যায় সেটা চায়নি। তবুও নিম্নমুখী শিক্ষ্যামানের উর্ধগতি মূল্যবৃদ্ধি চলছেই। দেশের করোনাময় এই পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীরা অনেকেই নিজগ্রামে চলে গেছে। আর নিজেরে জাহির করার এই যুগে এখনো এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যাদের ল্যাপটপ নেই, কিছু শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন নেই। অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার নামে তাদের মূলত কি অবস্থায় দাড় করানো হয়েছে তা ভাবার দায়িত্ব কার?
আমি নিজের প্রথম স্মার্টফোনটি নিয়েছিলাম স্নাতক জীবনের একবারে শেষের দিকে। তা দিয়ে তোলা প্রথমদিকের ছবিগুলো আমার স্নাতক জীবনের শেষ ছবি। শুধুমাত্র গ্রামের বাসার বাইরেও মেসেঞ্জারে নিজেকে অনলাইনে এক্টিভ রাখা যায়না বিধায় এই লকডাউন এ ঢাকায় আছি চাকরির বাধ্যবাধকতায়। ফোন কোম্পানিগুলোর 'নদীমাতৃক দেশব্যাপী জালের ছড়িয়ে আছে আমাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক' এর চাপা বা সত্যতা যেটাই হোক তার মুল্য!! গড়ে প্রতিদিন মোবাইল ডাটা থেকে গড়ে ২ঘন্টা ভিডিও কলে থাকতে আসলেই কি পরিমাণ খরচ তা আমার জানা নেই (কেউ জানলে কমেন্ট এ জানাবেন), নেহাতই কম নয়।
অনেকেই বলতে পারেন, 'লাখ লাখ টাকায় যারা পড়তে পারে, তাদের কাছে এটা কিছুই না'। কিন্তু আমরা কি জানি গ্রামের কতো বাবা তাদের জমি বেচে বা বন্ধক রেখে সন্তানকে শিক্ষিত করতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছে? সেই বাবারা আজ জমির ফসল ঘরে তুলতে হিমসিম খাচ্ছে, ফসলের নায্য মূল্য পাচ্ছে না। অনেকের পরিবারে আগের সেই নিয়মিত চুলা জ্বলছে না, লজ্জায় অনেকেই অতি কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। আর আমরা অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার নামে সেই পরিবারের উপর নির্মমভাবে কড়া চাপরাচ্ছি, যাতে গায়ের মোটা চামড়াগুলো ফেটে রক্ত বের না হলেও নিকষকালো হয়ে আর ফুলে উঠে জানান ঠিকই দিচ্ছে।
আমাদের সকল স্কুল, কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এমন অবস্থায় সকল শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখতে পারে তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন নয়? বলতে পারেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যক্রম বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীরা টাকা দিবে না, শিক্ষক ও স্টাফ ব্যায় কুলানো সম্ভব হবে না! তাহলে এতোদিনের লাভের গুড় গেল কই? রাস্তার ধারের মাইক নিয়ে গাছ-গাছালি বিক্রি করা লোকটিও লসে ব্যবসায় করে না, আর আমাদের দেশে শিক্ষাখাত এখন ব্যাংক খাতের চেয়েও লাভজনক।
ঢাকার বুকে লোডশেডিংমুক্ত বিদুৎ, উচ্চগতির নেট লাইন বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার ভাবনাটা ঠিক হয়নি। এই করোনার যুগেও হরেকরকম তরকারির স্বাদ নেয়া ছেলেটির সংগে অজপাড়াগাঁয়ের শুধু সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে তুষ্ট থাকা ছেলেটির তুলনা করলে চলবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২০ সকাল ৮:৫৩