শুধু কথায় নয় বাস্তবেই বড় হবার সাথেই ঈদের আনন্দ কমতে থাকে, কারণ বয়স বাড়আর সাথেই বাড়তে থাকে 'করতে পার না' এর তালিকা। শিক্ষাসনদ কি বলে তা বাদ দিলে আমার বয়স ২৫ এর দাগ পার করে ফেলেছে, সেই হিসাবে ঈদের আনন্দ আসলেই ভিন্ন হবার কথা।
আমার বাসা ঠিক অজ পাড়াগাঁ বলতে যা বোঝায় সেই গ্রামে। কারণ ডিজিটাল এই যুগেও আমি বাসায় গেলে শহরে আসতে চিন্তায় পরে যাই, যানবাহন ঠিক পাব তো আর পেলেই কি সময়ে যেতে পারব! যেখানে দেশের সব মোবাইল অপারেটর থ্রিজি দিচ্ছে সেখানে বাসা থেকে কথা বলতে আজও কষ্ট হয়। তাই বাসায় গেলে কিছুটা অকারনে হলেও মায়ের কঠাতেই দিন কেটে যায়। যেমন ধরুন সকালে দেরীতে ঘুম থেকে ওঠার বকা, খাবার দেরীতে খাবার বকা, দুপুর পেরিয়ে গেলেও গোসল না করার বকা, রাত জেগে ল্যাপটপ চালু রাখার বকা। বলতে পারেন এওলাকার দুই একজন বাদ দিলে দিনভর কথা বলার মতো বা দেখভাল করার মতো একজনই, আমার মা।
বাবা তো সকালে উঠেই বাইরে যান, এসে কোনরকম গোসল করে, খাবার খেয়েই অফিস ছুট। এর মাঝে কোনকোনদিন সকালে ডেকে তোলার কাজটা করে দেন, তবে তা আর ভয়াবহ হয়। আর ঈদ মানেই তো বাবা সকালে করে ঈদ্গাহে। আমার পরিবার গ্রামে যাবার পর থেকেই বাবা ঈদ্গাহের সভাপতি, তাই ঈদের দিনেও গোসলের জন্য বকা খেয়েছি প্রতিবার।
কিন্তু এইতো গত এপ্রিলে চিকিৎসার জন্য ভারতে থাকাকালীন ব্রেইন স্ট্রোক করায় মায়ের ডানপাশ অবশ হয়ে গেছে, কথা বলতে পারতেন না। আগে যে ঢাকা থেকে নিয়নিত কথা হত তা নয় তবে যেদিন কথা হত একটু দীর্ঘসময়ই কথা হত। কিন্তু কথা না হওয়া আর কথা না বলতে পারার মাঝে অনেক পার্থক্য। গত রমযান ঈদের আগের রাতে মনটা খুব বেশী খারাপ ছিল, কারণ মা থেকে তাঁর হাতের সেমাই খাওয়া হবে না। বাসায় কতো কাজ থাকে, কে সামাল দিবে?
বড় বড় মানুষেরা বলে পুরুষেরা কান্না করা না, তবে আমি কাঁদি, শুধু যে মায়ের জন্যই তা নয়, এর আগেও অনেকবার কেঁদেছি। হয়তো তাঁদের মতে আমি পুরুষ নই বা একজন পুরুষ হবার আগে আমি একজন মানুষ বলে।
ঈদের দিন নিজেই সকালে উঠে চুপ করে ছিলাম, গোসলটা দেরীতেই করেছিলাম। বরাবরের মতো নামাযে যাবার সময় রেখে। স্বাভাবিকভাবে মন ঠিক ছিল না, কারণ মা অসুস্থ হবার পর সেতাই আমার প্রথম ঈদ ছিল। তবে যাবার আগে মায়ের রুমে গেলাম, মা বাবার পকেট থেকে টাকা বের করে দুই ভাইকে দুইটি ৫টাকার কয়েন দিল। এই টাকা দেবার বিষয় যে এই প্রথম তা নয়, ছোত থেই চলে আসছে। তবে তা কোন্দিন সাল্মি ছিল না, কারণ ঈদগাহে যাবার আগে প্রতিবার মা বাবাকে টাকা দেবার কথা বলে দিতেন। আর বাবা টাকা দিতেন, তবে তা প্রথমদিকে ২টাকা থাকলেও মাঝে বেড়ে ২০টাকা পর্যন্ত এসেছিল। তবে ২০১১ এর পর থেকে টাকা আছে কিনা বলেই চলে যেতেন, কারণ সেই সময়ে আমাদের দুইভাইয়ের কাছেই ঈদ্গাহে দেবার টাকা থাকত। ঘটনার উল্টোও হয়েছে কয়েকবার, দেখা গেল বাবা বের হবার আগে আমাদের কাছ থেকে খুচরা টাকা নিয়ে ঈদ্গাহে গেলেন। তবে এমন ঘটনার ব্যাখ্যাও আছে, যেসব বাবা এই যুগেও মধ্যবিত্ত তাঁরা আসলেই অভাগা। সন্তানের ঈদের কাপড়, বাইরের খরচ, সংসার এর বোঝা টানতে গিয়ে তাঁদের জীবন চায়নার প্ন্য হয়ে যায় তবুও চাহিদা শেষ হয় না। আমাদের ঠিকই প্রতিবছর ঈদের খ্রচের টাকা দেন, অথচ তাঁরা নিজেরা এক জুটা কিভাবে ২বছর পার করে আরো বেশীদিন পড়া যায় সেই চেষ্টায় থাকেন।
লিখতে গিয়ে আবারও ভিন্ন দিকে চলে গিয়েছিলাম। যাই হোক আম্র ২৫ বছরের ১০ই যদি বাদ দেন তবুও ১৫ বছরের যে কোন ঈদের তুলনায় এই ঈদ ভিন্ন ছিল, আনন্দময় ছিল। কারণ যেই মমতাকে এতোদিন শুধু মেনে চলেছি সেই মমতা হৃদয়ের গভীরে ছুয়ে গেছে। আর বন্ধুদের হাজার টাকার ঈদ সালামির গল্পে আগে মন খারাপ হত তবে আর কোন্দিন হবে না। কারণ ৫ টাকায় আমি যে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি তা ১০০০ টাকার গোলাপী কাগজে হয়তো নেই।
*আমার মা বর্তমানে নিজেই কষ্টকরে চলাফেরা করছেন, ডান হাত এখনো সম্পূর্ণ আবশ। তবে আধভাংগা করে মধুর কন্ঠে মাঝে মাঝেই নাম ধরে ডাকেন। পৃথিবীর সকল মায়ের কষ্ট লাঘব হোক এই কামনায় শেষ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৫১