বাকের এর ফাঁসির পর মজনু কিছুটা বিহম্মল হয়ে পড়েছে। এলাকায় মতির অনেক নামডাক, বদিতো তাঁর সংসারে ব্যাস্ত। আর বদির প্রতি ভালোবাসার বিন্দুমাত্র নেই, ব্যাটা মতি ও কুত্তাওয়ালী তার টাকার জোরে যা করেছে তার চেয়ে বদি একাই বেশী করেছে। ভাই চলে যাবার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেছে, আগের মামলাগুলো যেন টাকার জোরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মজনু বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের নানা প্রান্তে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। ভাবনা ভারতে পালিয়ে যাবার, সে কারণে সে এখন দিনাজপুর জেলার বিরল সীমান্তে যাচ্ছে।
জীবন আসলেই এভাবে মোড় নিবে, তা কখনো ভাবা হয়নি। টাকার অভাবে আর কিছুটা নিরাপত্তার জন্য ট্রেনের ভ্রমণটাই মজনুর জন্য ভালো ছিল। কিন্তু এতো দীর্ঘ পথ তা ভাবা হয়নি, অনেক কষ্টে সকালে দিনাজপুর রেল স্টেশনে। এই দীর্ঘ ভ্রমনে খাবার তেমন কিছুই হয়নি, ঠিক সকালে ট্রেন যখন পার্বতীপুর দাঁড়িয়েছিল তখন কিছু মাখানো মুড়ি আর পানি। অবশ্য তারপর একটা সস্তা সিগারেট ও খেয়েছিল সে, আসলে মুক্ত বাতাসে সকালে সিগারেটের আগুনে বাকের ভাইকে কেমন দেখাত তাই ভাবছে মজনু। ভাই থাকলে তাকে যেভাবেই হোক মজনু এখানে এনে সিগারেট খাওয়াতো। তবে ভাই আসত কিনা তা ভাবার বিষয়, কারণ এখানে ভাইয়ের সেই প্রাণের গান কে বাজিয়ে শুনাবে! অবশ্য ভাই সাথে থাকতে যেখানে গিয়েছে রাজত্ব করেছে, কিন্তু শেষমেশ বডির কারণে...।।
ষ্টেশনে নেমে মজনু জেনেছে, বিকালে বিরলের ট্রেন আছে। যদিও তা দুপুরের আগেই বিরলে যাবার কথা কিন্তু তা ছাড়তেই নাকি ঢের দেরী। নতুন জায়গায় কেউ চেনার কথা নয়, তবুও শরীরের এই বেহাল দশায় বাইরে যেতে ইচ্ছে হলনা, তাই ট্রেনের এক সিটে গুয়ে শুয়ে পড়ল। গত কয়েকদিনে যা ধকল গেছে, তাতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সেই খেয়াল নেই।
ঘুম ভাঙল মানুষ ও ট্রেনের শব্দে। ট্রেন চলা শুরু করেছে। আজয ট্রেন পানির ব্যাবস্থা নেই, থাকলে মুখ ধোয়া যেত, কেমন যেন খারাপ লাগছে। কিছুক্ষন পরই ট্রেন দাঁড়াল মাঝপথে, ঠিক কোন জায়গায় তা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু জংশন। ট্রেনের মতো জংশনটিও আজব, কোথাও নাম দেখা যাচ্ছে না, তবে লেখা যে খুব অভেলায় মুছে গেছে তা বোজা যাচ্ছে। মজনু পাশে পুকুর দেখে মুখ ধুতে নেমে গেল। কিছুটা ভালো লাগছে তবে তা যে শুধু ফ্রেশ লাগার কারণে তা নয় পুকুরের পানি যে এতো সচ্ছ হয় তা কখনো ভাবেনি। কারণ ঢাকার পুকুর কেন, নদীতেও যা ময়লা ভাষে তাতে মুখ ধোয়ার কথা চিন্তা করা যায় না। ট্রেনে উঠেই দড়জায় পা ঝুলিয়ে আবারও সিগারেটে আগুন দিল মজনু। ট্রেন চলতে শুরু করেছে, ফ্রেশ হয়েই কেন জানি খুব ক্ষুধা অনুভব করছে সে। সিগারেটের স্বাধই কেমন যেন লাগছে। তবে পরিবেশ দেখে তা ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। দূর দূর পর্যন্ত ধানের ক্ষেত, কচি ধান এসেছে, ঘ্রান মন ভরিয়ে দিচ্ছে। ট্রেন দাঁড়িয়েছে বিরল ষ্টেশনে, বেশী কিছু নেই। থাকবে কিভাবে, শালার ট্রেনে তো টিটিই ছিল না, কে আসল আর গেল তাতে কার কি!
নেমেই সে আশে-পাশে দোকান খুজতে লাগল, আছে তবে পেট ভরার মতো কিছু নেই। কি আর করা, দুটা বিস্কুট আর পানি। কেক, বিস্কুট মজনুর সেই খারাপ লাগে, কিন্তু কি করার। মজনুর হাতে লাল চা আর একটা জলন্ত সিগারেট। আর যাই হোক দুইটা বিস্কুট এ ক্ষিধে যায় না কিন্তু চা খেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। দারচিনি, লং, তেজপাতাসহ বানানো চা আসলেই অসাধারন। চা খাবার অনুভূতি টাই বদলে গেল। খাবার যাই হোক রাতেই ভারতে পালিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু অন্ধকারে এখনও অনেক বাকী, যেতে কি কি করতে হবে তা ভালোভাবে জেনেই এসেছে সে। সীমান্তে যাবার জন্য তাকে এবার বাজারে যেতে হবে, তাই সে রেললাইন ধরেই হাঁটা শুরু করল। সামনে খাদ্য গুদাম এর মূল গেট, বাইরে তেমন কেউ নেই কিন্তু একটা সাইকেল পড়ে আছে, সাথে কেউ নেই। তালা ছাড়াই কেউ সাইকেল ভুলে রেখে গেছে কিনা তা মজনু বুঝে উঠতে পারছে না, তাই ভাবল চায়ের দকানে দিয়ে আসলেই হয়। চিন্তা অনুযায়ী সাইকেল নিয়ে চলা শুরু করল। ঢাকায় রেঞ্জার সাইকেল বুঝি গ্রামে খুব বেশী চলে না, এই সাইক্লে অনুযায়ী রেঞ্জার অনেক ছোট। পড়ন্ত বিকালে মজনু কেন জানি সাইকেল চালাতে শুরু করল, ভালোই লাগছে। তাই হসে সাইকেল ঘুড়িয়ে বাজারের দিকে যেতে শুরু করল। গুডামঘরের পাশে একটু তাকিয়ে নিল, যদি কেউ সাইকেলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে তো! নাহ, কেউ নেই।
সাইকেল চালাতে বেশ ভালোই লাগছে, সাম্পনে রেল ব্রীজ। খুব বেশী বড় না, তবে অনেক যুবক বসে আছে, খুব আড্ডা হচ্ছে। অচেনা যায়গায় না দাঁড়িয়ে সে চলে গেল। বাজারের রাস্তায় উঠেছে, রাস্তায় অনেক সাইকেল চলছে। সবই বড় বড়, যাই হোক সে পাকা সড়ক ধরে যেতে লাগল। মাঝে এক চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে লাগল। সেই ফাকে আসলে ঠিক কোথায় গেলে সীমান্তের কাছে যেতে পারবে আর সীমান্ত ফাঁড়িগুলো কোথায় তা জেনে নিল। দোকানদার খোশ গল্প শুরু করার আগেই কেটে পড়ল মজনু। বেচারা এতো উপকার করেছে তাই তার দোকান থেকে কিছু সিগারেট নিয়ে নিল সে। সাইকেল চালিয়ে কোথা থেকে উঠতে হবে তা দেখে আসল। ভাবল সাইকেলতা দিয়েই আসি। যাবার পথে সেই ব্রীজে একটু বসল সে। এখন কেউ নেই, ব্রীজের নাম কি জানা সম্ভব নয়, তবে পাশের রেলের ফলকে ৪১৯ লেখা, হবে হয়তো কোন মাপের জিনিস। এখানেই বসেই সে পরপর দুইটা সিগারেট শেষ করে ফেলল। নাহ, রাত হয়ে গেছে, বের হতে হবে। তার আগে সাইকেল টা দোকানে দিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া অচেনা এলাকা। রাতে রাস্তা হারিয়ে ফেললে সব শেষ।
মজনু দোকানের সামনে এসে গেছে, দিনের চেয়ে ভীড় অনেক। বাতি জ্বালিয়ে ক্যারাম খেলা চলছে, সে সাইকেল এক গাছে হ্যালান দিয়ে রেখে দোকানে ঢুকবে এমন সময় একজন মুরুব্বি মজনুকে ডেকে বসল। নতুন এলাকায় তাকে ডাকার কোন কারণ নেই, তবুও সে ঘাবড়ে গেল। নাহ, তেমন কিছু নয়, সাইকেলে তালা দিতে বলতেই ডেকেছে। বিকালেই একটা সাইকেন চুরি হয়ে গেছে, তাই চাচা সাবধান করে দিল।
মজনু, আল্লাহকে স্বরন করে তাল দিয়ে চাবি হাতে নিয়ে দোকানে গেল। কিছুটা বাধ্য হয়ে একটা বিস্কুট নিল, বিল দেবার সময় চুপ করে চাবি দোকানের টেবিলে রেখে সে দ্রুত কেটে পড়ল। দকান থেকে দূরে এসেই সে কামড় দেয়া বিস্কুটটা ছুড়ে ফেলে দিল, সেই সাথে একটু আগের ভয়। ভাগ্য ভালো, যদি কেউ সাইকেল চোর বলে ধরে পিটুনি দিত তবে বলার কিছু নেই, কারণ তাকে বাচানোর জন্য কেউ আসত না। আর চেহারার যা দষা, তাতে চোর বললে এমনিতেই সবাই বিশ্বাস করবে, সাইকেলসহ ধরা পরার খুব দরকার ছিল না। যাই হক, যা চলে গেছে তা নিয়ে চিন্তা করে কোন লাভ নেই। আরেকটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সে চলা শুরু করল। মৃদ্যু জোছনায় হাটতে গিয়ে কেন জানি আনমনেই ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে, ও তেরা লাল দপাট্টা...।’ গুনগুনিয়ে উঠল। আহ, বাকের ভাইকে সাথে নিয়ে এমন পরিবেশে হাটা গেলে যে ভালো হত! আচ্ছা ভাই কি, মনাকে ছেড়ে এখানে আসত...!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:২২