রাজীব মীর, অতিথি লেখক বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
শিক্ষক,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিরক্তিকর বেদনায় আক্রান্ত। শিক্ষকদের সামান্য বেতন, অসামান্য চাপ। শিক্ষার্থীদের তীব্র আবাসন সংকট, বেতন ভাতা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা। উপরন্তু বাস্তব বিবেচনাবোধ ব্যতিরেকে নতুন আইনে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেবাকে পণ্য বা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা কেনাবেচার হাটে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় চেষ্টা অদ্ভূত এক শিক্ষাদর্শন তৈরি করছে।
এরই মধ্যে ২৭ এর ৪ ধারা বাদ গেলেও নতুন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি না বেসরকারি, বোঝা দুষ্কর। কুড়ি হাজার শিক্ষার্থী কীভাবে আসে, কোথায় থাকে, কী খায় এগুলো নিয়ে শক্তিধরদের কেউ ভাবেন না , ভাবতে চানও না। সেমিস্টারের টাকা যোগানো এবং আবাসন ব্যয় মেটানোর চিন্তায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বারোটা বেজে যায়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার সাধারণ ঘরের এসকল সন্তানের উচ্চ শিক্ষার ব্যয়ভার রাষ্ট্র নিতে চাচ্ছে না, ক্রমশ এড়িয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীকেই চাপ নিতে হচ্ছে যা সইবার ক্ষমতাটুকুও তার নেই। অবশেষে শিক্ষার্থী বনাম রাষ্ট্রের লড়াই, বিরতিহীন বিদ্রোহ ও বিক্ষুব্ধ বিস্ফোরণ বনাম রাষ্ট্রের দমন এবং নিপীড়ন।
স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বয়ঃসন্ধিকালের সকল সমস্যা একে বইতে হয়েছে দিনের পর দিন, আজও বয়ে চলেছে। কলেজের শিক্ষকরা এখানেই থাকবেন নাকি অন্য কলেজে যাবেন, সিদ্ধান্ত নিতে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে, সময় লেগেছে। অবকাঠামোর যথেষ্ট উন্নয়ন ছাড়াই হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছে। শিক্ষকদের অনেকেরই বসার জায়গা নেই, থাকার জায়গা তো দূরের থাক। পুরান ঢাকায় তীব্র ঘনবসতি আর সদরঘাট ও কোর্ট কাচারির ব্যস্ততম ও বাড়ন্ত ভিড়ে এতো-এতো শিক্ষার্থী কোথায় এবং কীভাবে থাকে, স্বয়ং প্রভু কি জানেন! গুলিস্তান থেকে সদরঘাট ,অসীম ও অসহনীয় যানজট লেগেই থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হতে পারে না, শিক্ষকগণও ক্লান্তিতে অবসাদগ্রস্ত হযে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রশ্ন মডারেশন করতে বহির্সদস্য প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ অসহনীয় যাত্রাপথ এড়াতে এখানে আসতে অপারগতা প্রকাশ করে থাকেন। মাঝেমধ্যে উপায় থাকে না, আমাদেরকেই নিয়ম ভেঙে তাদের কাছে যেতে হয়। টিটকিরিও শুনতে হয়: ‘সদরঘাট বিশ্ববিদ্যালয়!’
শিক্ষকদের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থী! হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ঝুলছে, সেই বাস কয়টি ? কে কোথা থেকে আসবে, কখন ক্লাস করবে, মিলছে না। দেরি হলে শিক্ষক ক্লাসে ঢুকতে দিচ্ছেন না ।কী করবে, কাকে বলবে বুঝতে পারে না। কিন্তু তারা জানে একসময় তাদের অগ্রজগণ হলে থাকতেন, নিয়মিত ক্লাশ করতেন, যখন কলেজ ছিলো। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, হলগুলো সব গেলো কোথায়! আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার কোটি টাকার সম্পদ হাতছাড়া। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ এগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দখল করেছেন। কেউ দখল করে অন্যদের কাছে বিক্রিও করে দিয়েছেন। সুরম্য বহুতল বিপণিবিতান তৈরি করেছেন কেউ কেউ। তেরটি হলের এগারোটিই অন্যদের দখলে। যে দুটি দখলে আছে তাও পরিত্যক্ত, আবাস উপযোগী নয়। ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়োগকৃত একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমাকৃত প্রতিবেদন মতে, ছয়টি হলের বৈধ কাগজ আছে। তাদের মতে, সরকারি সম্পত্তি হওয়ায় সরকার চাইলেই এগুলোর দখল বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝিয়ে দিতে পারে। একই বছর শিক্ষার্থী আন্দোলনের পর ছয় সদস্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি পাঁচটি হল বিশ্ববিদ্যালয়কে লিজ দেয়ার পরামর্শ দিলেও এ বিষয়ক কোনও অগ্রগতিই হয় নি।কয়েকদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকে কটাক্ষ করে জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের বক্তব্য প্রদানকে কেন্দ্র করেই ফুঁসে ওঠে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। বেরিয়ে আসে জনাব সেলিমের থলের বেড়াল। পাটুয়াটুলী-ওয়াইজঘাট এলাকায় তিব্বত হলের প্রায় নয় কাঠা জায়গা হাজী সেলিমের গুলশান আরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স আর পুলিশের যৌথ দখলে। বাদবাকি সব হলই এরকম বিভিন্ন রাজেনৈতিক দলের চেনা কারো না কারোর জবরদখলে। এসবই সরকারের খাস জমি। কাজেই দীর্ঘ মেয়াদে লিজ প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগুলো প্রদান করা সরকারের সদিচ্ছার উপরই অনেকাংশে নির্ভর করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক সম্পদ ভোগ করবে এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য আন্দোলন করতে হছ্ছে কেন ? রাষ্ট্র এ ধরণের আন্দোলনে করার অবস্থা কেন তৈরি করছে?
সদ্য আন্দোলনে সাতজন শিক্ষক ও ২২ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ, ৩০০ শিক্ষার্থী আহত। কিন্তু শিক্ষক শিক্ষার্থীগণ গুলি ও টিয়ারশেল দ্বারা আক্রান্ত হন কার নির্দেশে? ইংরেজি বিভাগের চেয়ার নাসির স্যার অত্যন্ত প্রগতিশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব একজন শিক্ষক। তিনি শিক্ষক সমিতি থেকে নির্বাচিত একজন সাহসী নেতাও বটে। পেটোয়া পুলিশবাহিনী আটচল্লিশটি স্প্লিন্টার দিয়ে রক্ত বিছিয়ে তাঁর শরীরে আলপনা এঁকে দিয়েছে। স্কয়ারের ইমার্জেন্সি ডাক্তার এগুলোর এখন কিছুই করা যাবে না বলে দিয়েছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার শিকার মেয়র হানিফের কথা মনে পড়ে যায়। আমৃত্যু সীমাহীন যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিলো তাঁকে। হয়তো নাসির ভাইও ভুগবেন---আজীবন।
একটা কথা মনে পড়ে গেলো। সম্প্রতি জামায়াত-শিবির পুলিশকে যখন আচ্ছা ধোলাই দিলো এবং পুলিশ নিরবে সেই মার খেলো আমরা কিন্তু কড়া প্রতিবাদ করেছি। এই নাসির ভাইয়ের সহযোগিতায় আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষে সুদূর রাজশাহী থেকে ঝর্ণা বেগমকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এনে আক্রান্ত পুলিশ রক্ষায় অবদানের জন্য ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধিত করেছিলাম। কিন্তু হায়! মৌলবাদি জামায়াত-শিবিরের কাছে যারা অসহায়ের মত মার খায়, সেই একই পুলিশ নিরীহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নির্দয়ভাবে পেটায়। এই নির্মমতার করুণ শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেলে কাতরাচ্ছেন নারায়ণ চন্দ্র রাজ। টাংগাইলনিবাসী বাবা গোপাল চন্দ্র সরকার আর মাতা শান্তি রাণীর সর্বশেষ সন্তান, রাজ। চার ভাই বোনের মধ্যে সে-ই শুধু পড়াশোনা করছে। বাবার ছোট ধানের ব্যবসা থেকে ছেলের পড়া-থাকা-খাওয়ার খরচ কুলোচ্ছে না। পুলিশের লাঠির কঠিন আঘাতে রাজের একচোখ নষ্ট হয়ে গেছে, সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। পদার্থবিদ্যায় দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত রাজের অপরাধ, সে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্বার্থে রাষ্ট্রের কাছে থাকবার জায়গা চাইছে। রাষ্ট্রের পেটোয়া বাহিনী এতে বাধ সেধেছেন, তারা এসকল দাবি দাওয়ার ঘোর বিরোধী। তারা ভয়ংকর ক্ষিপ্রতায় হাজার রাজের ওপর নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।লাথি মেরেছেন, পিটিয়েছেন এবং গুলি করেছেন। কিন্তু কেন? সমাবেশ কি অবৈধ ছিলো? কে অনুমতি দিলেন, জানতে পারি কি? নিয়ম এবং আইন মেনে এটা করা হয়েছে নিশ্চয়ই। পুলিশ রেগুলেশন্স -এর কোন প্রবিধান মতে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়াই এধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন গুলির আদেশে লালবাগের পুলিশের ডিসি বা কোতোওয়ালি থানার ওসি অতি উৎসাহিত হলেন। নাকি অন্য কিছু?বুঝি না তো ! দায় তো তুমিও এড়াতে পারো না, প্রিয় রাষ্ট্র। নাকি তুমিও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষক ব্রজেশ্বরেরই মতো-‘‘বিধাতার এই নোংরা পরিবেশটাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারলেই যাঁর জাত বাঁচে ”। তুমি কি শুনবেই না আমাদের কথা, আমাদের ব্যথা? শিক্ষার্থীরা যে বলেই যাচ্ছে, ‘‘রক্ত চাইলে রক্ত নে, তবু মোদের হল দে।’’
মনে রেখো হল প্রদান তোমার দায়িত্ব ছিলো কিন্তু না দিয়ে উল্টো তাদের মেরেছোই যখন, হলের জরুরি ব্যবস্থাকরণ এখন তোমারই দায়। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফরিন নুসরাত তাঁর ফেসবুক স্টাটাসে কাল বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোনো ছাত্রের উপর যখন পুলিশ লাঠিচার্জ করে তখন আমার বিবেক বারবার মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বিবেক ও সাহসের পরাকাষ্ঠা নাসির স্যার যন্ত্রণায় তখন অজ্ঞানপ্রায়। ভালো করে কথা বলতে পারেন নি কিন্তু কী বলেছেন, শিক্ষার্থীরা ঠিক মনে রেখেছে-‘‘আমাকে নিয়ে কেউ ব্যস্ত হয়ো না, আমাকে নিয়ে ছোটাছুটি করলে তোমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে না। কোনওভাবেই পিছু হটো না, তোমরা আমাকে ফেলে সামনে এগিয়ে যাও।” এগুতে গিয়ে রাজের চোখ গিয়েছে, রাষ্ট্র নিয়েছে। রাজ না হয় দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু রাষ্ট্রের তো দেখতে পাওয়ার কথা। কি গো রাষ্ট্র, দেখছো তো!
- See more at: Click This Link